জুয়েল আশরাফ

  ৩০ জুলাই, ২০২২

সাঁতার

রাহাতদের বাড়ির পাশেই ইছামতী নদী। নদীটি তেমন বড় না হলেও দেখতে কিন্তু অপূর্ব। বর্ষায় নদীর আসল রং রূপ লাবণ্য প্রকাশ পায়। সারা বছরের হাড় জিরজিরে নদীটি যখন বর্ষার পানি পেয়ে ফুলে ফেঁপে ওঠে, তখন দেখা যায় বড়শি অথবা জাল ফেলে মাছ ধরার মোহময় দৃশ্য! আরো আছে নৌকা ভ্রমণের উৎসব। প্রতি বর্ষায় এখানে নৌকাবাইচ হয়।

এই নদীতেই রোজ গোসল করে রাহাত। রাহাতের বয়স এখন এগারো বছর। নয় বছর বয়স থেকে সাঁতার শিখেছে সে। সে জানে কীভাবে হাত-পায়ের কৌশল অবলম্বন করে, শরীরের ভারসাম্য ঠিক রেখে সাঁতরাতে হয়। রোজ দলবল নিয়ে গোসলে এসে ডুব মেরে খেলা, কখনো নদীর এপার থেকে ওপারে যাওয়ার প্রতিযোগিতা। দলের সবাই ভালো সাঁতার জানে। এজন্য পানিতে ডুবে যাওয়ার ভয় নেই কারোর। তবু বাড়ি থেকে সাবধান করে দেওয়া থাকে। ইছামতী নদীতে স্রোত তেমন নেই, তাই সাঁতরাতে বেশ আনন্দ।

আজ সকাল থেকেই রাহাত কলাগাছ নিয়ে মহাব্যস্ত। কলাগাছ কেটে ভেলা বানাবে। সেই ভেলায় চড়ে সাগরকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরবে। সাগর খালাতো ভাই। সে সাঁতার জানে না। তারা ঢাকায় থাকে। দুদিন হলো খালার সঙ্গে বেড়াতে এসেছে। ছোট বোন মিতুও এসেছে। মিতু পড়ে ক্লাস থ্রিতে। সে কলাগাছ দেখেই জিজ্ঞেস করল, এগুলো দিয়ে কী করবে ভাইয়া?

রাহাত বলল, ভেলা বানাব। গাঙে ভাসাব। চড়ে বেড়াব।

মিতু বলল, গাঙ মানে কী?

রাহাত বলল, গাঙ মানে নদী।

মিতু ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, নদীকে গাঙ বলো কেন? নদীকে গাঙ বলে কেউ?

কেউ বলে কি না জানে না, কিন্তু রাহাত বলে। গাঙ বলে আরাম পায়। মিতুর মেজাজ খিট খিট করে ওঠে। তার সামনে কেউ অশুদ্ধ বাংলা বললে সে তেড়ে আসে মারের ভঙ্গিতে। কিন্তু রাহাতকে সে মারতে পারে না, রাহাত পড়ে ক্লাস সিক্সে, আর সে থ্রিতে। নিচের ক্লাসের হয়ে ওপরের কাউকে মারতে হয় না। মিতুর মারপিটের হাত ভালো, আশপাশের অশুদ্ধ কিছু পেলেই মারপিট করার ইচ্ছে তার। রাহাত ওপরের ক্লাসে পড়লেও তাকে মারতে ইচ্ছে করছে। সে ভীষণ রেগে গিয়ে বলল, না, নদীকে গাঙ বলবে না। বলো নদী।

রাহাত বলল, একশোবার গাঙ বলব। গাঙ গাঙ গাঙ...।

মিতু ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। রাহাতের খালা দৌড়ে এসে বলল, কী হয়েছে মিতু? কাঁদছিস কেন?

মিতু বলল, রাহাত ভাইয়া নদীকে গাঙ বলেছে। আমি নিষেধ করার পরও বলবে।

মিতুর মা হেসে বলল, বোকা মেয়ে, নদীকে গাঙ বললে কী হয়েছে? তুইও তো বইয়ের ছবি দেখে বলিস গাঙচিল। নদীচিল কখনো পড়েছিস?

কান্না থামিয়ে মিতু ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকাল। তাই তো, সে তো বইতে পড়ার সময় গাঙচিল পড়েছে, নদীচিল কখনো পড়েনি। বিষয়টা মনেই ছিল না।

কলাগাছ দিয়ে ভেলা বানানো শেষ। এ সময় সাগর এসে দাঁড়াল। খালা বলল, এটাতে কতজন ওঠা যাবে রে রাহাত?

রাহাত বলল, দুই থেকে তিনজন। আমি আর সাগর বেড়াব এখন।

মিতু বলে উঠল, মা আমিও উঠব।

খালা বলে উঠল, না না, দরকার নেই। সাঁতার জানিস না। এই সাগর সাবধান! তুইও সাঁতার জানিস না।

সাগর বলল, আমি পানিতে পড়ব না। চুপচাপ বসে থাকব।

পানিতে নামানো হলো ভেলা। সাগর চড়ে বসল মাঝখানে জড়সড় হয়ে। রাহাত লম্বা একটি বাঁশ নিয়ে বইঠার মতো ঠেলে ঠেলে ভেলা ভাসিয়ে চলল। পাড়ে দাঁড়িয়ে মিতু আর খালা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে আনন্দ পাচ্ছে।

ভেলা নিয়ে নদীর মাঝখানে যাওয়ার সাহস পেল না রাহাত। সাগর সাঁতার জানে না। কোনো রকম দুর্ঘটনা ঘটে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে, এই ভেবে সে নদীর কিনারেই বেড়াল। কিন্তু দুর্ঘটনা যা ঘটার কিনারেই ঘটল। একটা কাইকলা মাছ ভেলার পাশ দিয়ে যেতে দেখে সাগর চিৎকার করে উঠেই দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পানিতে দিল ঝাঁপ। আচমকা দুর্ঘটনায় কী করবে রাহাত, কিছু বুঝে উঠতে না পেরে হাতের বাঁশ ফেলে দিয়ে সেও পানিতে দিল ঝাঁপ, সাগরকে বাঁচাতে হবে। খালা পানিতে নেমে সাঁতরে এগিয়ে এলো। মিতু পাড়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার আর কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে। বাড়ির ভেতর থেকে রাহাতের বাবা-মা সঙ্গে প্রতিবেশী কয়েকজন ছুটে এলো। সাগরকে পানি থেকে টেনে তোলা হয়েছে। খালা আর রাহাতই টেনে তুলল। কিনারে নিয়ে এলো। পানি খেয়ে খুক খুক কাশছে সাগর। ভয় আর আতঙ্কে তার চোখমুখ কী রকম দেখাচ্ছে! সবাই রাহাতকে দোষারোপ করল।

খালা বলল, ওর কোনো দোষ নেই। সাঁতার শেখা থাকলে পানির নিচে ডুবে যেত না। আর তোকেও বলছি, কাইকলা মাছ দেখে ভয় পাওয়ার আছে কী? চুপচাপ বসে থাকতি, পানিতে ঝাঁপ দিলি কেন?

ধমক খেয়ে সাগর নড়েচড়ে বসল মাটিতেই। আজ সে বুঝতে পেরেছে, সাঁতার শেখা দরকার। এবার সাঁতার না জানা পর্যন্ত ঢাকায় যাবে না। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি সাঁতার শিখব। কিন্তু কাইকলা মাছ সাঁতরে যদি আবার আমার কাছে আসে!

কথা শেষ হতেই হেসে উঠল সবাই।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close