জুয়েল আশরাফ
দৌড়
স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই তালহা খুব দুঃখী হয়ে বসে আছে। তাকে মন খারাপ দেখে বাড়ির সবাই জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? ঠিক করে বলো। তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?
তালহা বলল, কিছুদিন পর আমাদের স্কুলে একটি ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হবে। তোমরা সবাই জানো আমি খেলা দেখতে আর খেলতে কতটা ভালোবাসি। কিন্তু...!
এই বলেই তালহা বিষণœ চিত্তে পায়ের দিকে তাকাতে থাকে। সে দুঃখিত হবেই তো। কারণ তার পুরোপুরি চলার শক্তি নেই। দৌড়ানো তো অনেক দূরের ব্যাপার, সে ঠিকমতো হাঁটতেই পারে না। বাঁকা হেঁটে ধীরে ধীরে খেলার প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার কথা ভাবতে পারা মনোবল ছেলে সে। আসলে তালহার একটা রোগ আছে। তার পা সম্পূর্ণ ভেতরের দিকে বাঁকানো, স্বাভাবিক পা নয়, যাকে ক্লাব ফুট বলে। এ রোগে শিশুর পা জন্মের পর থেকেই বেঁকে যায়। যার কারণে সে তার ভারসাম্য ঠিকমতো রাখতে পারে না। এ ধরনের শিশুদের পায়ের গোড়ালি মাটি থেকে উঁচু থাকে। তাদের জুতা পরেও ভারসাম্য বজায় রাখা খুব কঠিন হয়। স্কুলে ক্রীড়া প্রতিযোগিতার কথা শুনে তালহা খুশির পরিবর্তে দুঃখ অনুভব করল। অন্য শিশুদের মতো সে এবারও ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবে না।
এমন সময় তালহার মা ঘরে আসেন। তালহাকে বললেন, আমার মিষ্টি ছেলের কী হয়েছে? দুঃখজনক। এবারও আমার ছেলে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারছে না। তাই সে দুঃখিত। দুঃখ পেয়ো না বাবা, আমার মিষ্টি ছেলে। মনোবল হারাবে না। এবার তুমি দৌড়াবে। নিশ্চয়ই প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে।
তালহা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, আমি কীভাবে দৌড়াব মা?
মা বললেন, আমার মিষ্টি ছেলে, আমি তোমার সঙ্গে আছি। তুমি চেষ্টা করো। তোমার পায়ে সমস্যা হলে কী হবে। তুমি আবার চেষ্টা করো, ছেলে। আমি কাল থেকে তোমার সঙ্গে অনুশীলন করতে যাচ্ছি।
মা আবার বললেন, তুমি একবার পড়বে। দুবার পড়বে। বারবার পড়বে। হাঁটতে পারবে না। তারপর একটা মুহূর্ত আসবে যখন তুমি দৌড়ে গিয়ে মানুষের জন্য উদাহরণ তৈরি করবে। তোমার মনোবল উঁচু রাখো, ছেলে। তোমাকে গন্তব্যে নিয়ে যাবে। চেতনাকে উড়ান দাও। মোটেও ঘাবড়াবে না। আমি সব সময় তোমার সঙ্গে আছি।
মায়ের এমন উৎসাহমূলক কথা শুনে তালহার দুঃখিত হৃদয়ে আশার আলো জেগে ওঠে। তার বিষণœ মুখে কুঁড়ির মতো হাসি দেখে মায়ের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। যে মায়ের ছেলে জন্ম থেকেই নিখুঁত নয়। তার হৃদয়ে নিশ্চয়ই কী ঘটেছে। এটা একমাত্র মা বুঝতে পারেন। কিন্তু মা ঠিক করলেন এবার তিনি হাল ছাড়বেন না। তালহাকেও হাল ছাড়তে দেবেন না। তালহা চেষ্টা করবে, হাল ছাড়বে না।
পরদিন স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পর তালহা ঘরে আসে। সে একজোড়া নতুন ধরনের জুতা দেখতে পেল। জুতাজোড়া মা তার পায়ের আদলে বিশেষভাবে তৈরি করেছেন। জুতা দেখে তার চোখ চকচক করে ওঠে, এখন সে দেখছে তার ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের স্বপ্নপূরণ হতে যাচ্ছে। বিকালে সবাইকে চা খাওয়ানোর পর মা তালহাকে বললেন, আমার সৈনিক প্রস্তুত হও।
তালহা বলল, মা, আমি পুরোপুরি প্রস্তুত।
মা-ছেলে দুজনেই কাছের মাঠে অনুশীলনের জন্য যায়। অনুশীলনের সময় তালহার অনেক কষ্ট হয়। প্রথম দিনেই মনে হচ্ছে দৌড়ে অংশগ্রহণ করা অসম্ভব। কিন্তু মায়ের বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেল। এটা দেখে তালহা তার বিশ্বাস হারাল না। সে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে চেষ্টা করতে লাগল। তার চেষ্টা দেখে মায়ের বিশ্বাস অটুট হয়ে যায়।
পরের দিনই তালহা স্কুলে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় নাম লেখাল। প্রথমে তাকে অংশগ্রহণ করতে নিষেধ করা হলো। কিন্তু তার অটল বিশ্বাসের কারণে হেড স্যার তাকে অনুমতি দিলেন। তারপর প্রতিদিন তালহার অনুশীলন চলতে থাকে।
চূড়ান্ত খেলার দিনটিও ঘনিয়ে এলো। তালহাকে উৎসাহ দিতে তালহার পুরো পরিবার স্কুলে এসেছে। যে মনোভাব নিয়ে তালহা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে, এটা দেখার মতো দৃশ্য। সব শিশু খুব দ্রুত দৌড়াচ্ছে। কিন্তু তালহা তাদের সবাইকে অনেক পেছনে ফেলে দৌড়। দৌড়ানোর জন্য তালহার উদ্যম তার মা এবং তার বাবার জয়ের চেয়েও বেশি। উপস্থিত সব দর্শক করতালির ধ্বনিতে তাকে স্বাগত জানাল।
দৌড় শেষ হওয়ার পর মা গিয়ে তালহাকে জোরালোভাবে জড়িয়ে ধরলেন। দুজনের চোখ থেকে মুক্তোর মতো আনন্দের অশ্রুধারা প্রবাহিত হচ্ছে। মা তালহার কপালে চুমু দিয়ে বললেন, তুমি জয়ী হয়েছো, আমার ছেলে, আমার সৈনিক!
হেড স্যার বক্তৃতায় বললেন, তালহা স্টেডিয়ামে সবার জন্য উদাহরণ তৈরি করেছে। সে সবার জন্য একটি ভালো উদাহরণ স্থাপন করেছে।
হেড স্যার তালহার উচ্চাভিলাষী মনোভাব দেখে তাকে ট্রফি দেন। পরদিন তালহার চিকিৎসা করা হয়। এই চিকিৎসা কিছুটা হলেও পায়ের সমস্যার সমাধান করেছে।
"