অনিন্দ্য আনিস

  ১৮ জুন, ২০২২

অনিক আর পোকার গল্প

রাত জেগে জেগে বই পড়া অনিকের অভ্যাস। বই হাতে নিয়ে পড়তে পড়তে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। রাত তখন বারোটা ছুঁইছুঁই। বাড়ির সামনের ডিউটি লাইটটা জ্বলছে। তার চারদিকে অসংখ্য রাতের পোকা উড়ছে। পোকারা কেন আলোর কাছে ছুটে আসে ভাবছে অনিক! আর মনোযোগ দিয়ে ওদের ওড়াউড়ির দৃশ্য দেখছে। কিছুক্ষণ পরে অনিকের মা এসে বলল, আর পড়তে হবে না। এখন ঘুমাও। সে বলল, না আম্মু, কাল বিজ্ঞান পরীক্ষা। তুমি তো জানো, রাত গভীর না হলে আমার পড়ায় মন বসে না।

আম্মুু তুমি ঘুমাতে যাও! আমার আরো পড়তে হবে। অনিকের আম্মুু আমেনা বেগম চলে গেল নিজ রুমে। অনিক পড়ার রুমে ফিরে দেখে তার টেবিলের নিচে পাকা ফ্লোরে একটি তেলাপোকা চিৎ হয়ে আছে। স্বাভাবিক হওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই উঠতে পারছে না। আর কেউ তাকে সাহায্যের জন্যও আসছে না।

­এই পরিস্থিতিতে অনিকও তেলাপোকাটিকে সাহায্য করল না।

সে প্রায়ই তেলাপোকার চিৎ হয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে থাকে। আজ সে দেখতে চায় পোকাটি কতক্ষণ এভাবে বেঁচে থাকতে পারে।

অনিক আরো কিছুক্ষণ পড়ার পর ঘুমিয়ে পড়ল। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখল পোকাটিকে পিঁপড়ার দল টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। পিঁপড়ার দলটি বেশ বড়। এত সংখ্যক পিঁপড়া তেলাপোকাটিকে খামচে ধরেছে যে পোকাটিকে চেনা মুশকিল। পিঁপড়ার এই দলটি কালো পিঁপড়ার দল। পিঁপড়ার দল পোকাটিকে টানতে টানতে রান্নাঘরের কাঠের বাক্সের পেছনে নিয়ে গেল।

অনিক পিঁপড়ার এই দৃশ্য দেখার পর তাদের পুকুর পাড়ে চলে গেল। সবজিখেতের পাশে তাদের সানবান্ধা পুকুর। অনিক ব্রাশ করছে আর সবজিখেত দেখছে। নানা প্রকার সবজি রয়েছে, তার মধ্যে পালংশাক, পুঁইশাক, ডাঁটাশাক, ঢ্যাঁড়স, লালশাক, ওলকপি, ফুলকপি, বাঁধাকপি, বিটকপি, মাচায় লতিয়ে ওঠা লাউ। শীতের সকালে সবজিখেত দেখতে সুন্দর লাগে। অনিক দেখতে পেল ফুলকপির নরম পাতার ওপর লাল রঙের অনেক পোকা।

পোকাগুলোর মাথার রং কালো। দেখতে কুচের মতো। কুচের আকৃতি ছোট, অনেকটা ছোট পুঁতির দানার মতো। মুখটা কালো সমস্ত শরীর লাল। দুটি ডানা কিন্তু যখন বন্ধ থাকে তখন বোঝা যায় না। তখন মনে হয় একটি কুচ। এরা উড়তে পারে এদের ডানা ও তেলাপোকার ওপরের অংশের মতো তেলতেলা শক্ত। অনিক দেখল প্রতিটি ফুলকপিতে ৬-৮টি পোকা কচ্ছপের মতো হেঁটে হেঁটে পাতার রস খাচ্ছে। যে অংশ দিয়ে খেয়ে যাচ্ছে সে অংশে একটি দাগ পড়ে যাচ্ছে।

- অনিক?

জি আপু, কী করো খেতের মধ্যে। আপু এসে দেখে যাও মজার বিষয়। দেখো এই পোকারা দল বেঁধে আমাদের ফুলকপির পাতায় বসে রস খাচ্ছে। এ আর মজার কী হলো। তাদের খিদে পেয়েছে তারা খাচ্ছে। না আপু! মজার বিষয় নয়, আশ্চর্য বিষয় হলো এদের পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা। কী রকম আমি দেখলাম একটি পাতায় একটি লাল কুচ রঙের পোকা চিৎ হয়ে পড়ে আছে, পোকাটি জীবিত কিন্তু সোজা হতে পারছে না, সোজা হতে পারলে পোকাটি উড়ে যেত। তো কী হয়েছে? আমি দেখলাম একটি পোকা তার গোত্রের, উড়ে এসে উড়ন্ত অবস্থায় ওর সবগুলো পা হেলিকপ্টারের মতো মেলে দিল আর চিৎ পোকাটি তার মেলে দেওয়া পাগুলো আঁকড়ে ধরল।

- এভাবে কয়েকবার চেষ্টা করার পরও চিৎ পোকাটি সোজা হতে পারল না। তারপর! তারপর দেখলাম পোকাটি উড়ে গেল আরো একটি ফুলকপির পাতায়। সেখানে কী দেখলে ভাইয়া? দেখলাম...

পোকাটি উড়ে গিয়ে বসল পাতার ওপর, সেখানে আরো ৬-৮টি পোকা বসা ছিল। তারা রস খাচ্ছিল। এই পোকাটি যাওয়া মাত্র তারা সব রস খাওয়া থেকে বিরত হলো। তারপর দেখলাম ওদের মাথার শিং নেড়ে নেড়ে কী যেন আলোচনা করল। আমি ওদের শিং ও পাখনা নাড়ানাড়িতে বুঝলাম, উড়ে যাওয়া পোকাটি বলছে আমার স্ত্রী ও আমি দক্ষিণ পাশের অংশে ফুলকপির পাতায় বসে রস খাচ্ছিলাম। হঠাৎ বাতাসে পা ফসকে আমার স্ত্রী চিৎ হয়ে পড়ে।

আমি একা একা অনেকবার চেষ্টা করেছি কিন্তু সোজা করতে পারলাম না। উড়ন্ত অবস্থায় আমি আমার সব পা মেলে ধরলাম তাও সে সোজা হতে পারল না।

- বেশ মজার ঘটনা তারপর কী হলো ভাইয়া? আমি ব্রাশ করছি আর দেখছি পোকাগুলো কী করে। এবার দেখলাম মিটিং শেষ করেই সব পোকা একসঙ্গে উড়ে গেল, আমাদের আর একটি কচি ফুলকপির পাতার ওপর। সবাই মিলে কচি পাতার এক টুকরো অংশ ছিঁড়ে নিয়ে উড়ে এলো সেই চিৎ পোকার কাছে। যখন ওরা সবাই মিলে কচি পাতার এক টুকরো অংশ উড়ে নিয়ে যাচ্ছে তখন আমার ভেতরে এক অদ্ভুত চেতনা নাড়া দিয়ে উঠল, বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ওদের ভেতর এত সুন্দর ইউনিটি। ওদের বুদ্ধিমত্তার বিষয়টি আমাকে অবাক করল। পাতার অংশটি দেখে মনে হচ্ছিল একটি জীবন্ত পাতা উড়ে যাচ্ছে। তারপর সবাই মিলে পাতার অংশটি চিৎ পোকার পায়ের কাছে ধরল, সঙ্গে সঙ্গে চিৎ পোকা তার পা দিয়ে পাতার অংশ আঁকড়ে ধরল। আর সেই মাত্র সোজা হয়ে গেল। সে কি আনন্দ সবাই মিলে একসঙ্গে উড়ে গেল। চলতে চলতে আমার দৃষ্টির সীমানার বাইরে চলে গেল। যত দূর দেখলাম ওরা একটি বিন্দুতে পরিণত হলো। একতা থাকলে সব সম্ভব। কোনো বাধায় দমিয়ে রাখতে পারবে না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close