ইমতিয়াজ সুলতান ইমরান

  ২৮ মে, ২০২২

আদরি

তখন মধ্যরাত। গভীর ঘুমে মগ্ন। মোবাইল ফোনের কলে হঠাৎ ঘুম ভাঙে। রিসিভ করে ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বললাম, হ্যালো...। অপর প্রান্ত থেকে বলল, ‘দুলাভাই, আমি রাজুর বাবা। সানু। সানু মণ্ডল।’ কী ব্যাপার ভাই? এত রাতে? ‘ভাই, আপনি আমার পাশের ডাক্তার। তাই আপনাকেই বিরক্ত করতে হচ্ছে।’ কী হয়েছে বলুন? ‘রাজুর মা খুব অসুস্থ! পেটে নাকি প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে!’ মাথা ঠাণ্ডা রাখুন। আমি আসছি।

ওরা আমাদের পাড়ায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে এসেছে মাস দুই হবে হয়তো। প্রতিবেশী এবং একজন পল্লীচিকিৎসক হিসেবে আমি জানি, রাজুর মা সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মহিলা আমার স্ত্রীকে আপা ডেকে বেশ ভাব জমিয়েছে। প্রায়ই বাসায় আসে। এসে সময় কাটায়। আমার স্ত্রীর সঙ্গে নানা গল্প করে। আমার স্ত্রীর মাধ্যমেই মহিলার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। ডাক্তার হওয়ায় তার শারীরিক অবস্থাও আমাকে শেয়ার করে।

পেশাগত এবং মানবিক কারণে আমাকে যেতেই হচ্ছে। কিন্তু মনে মনে বলছিলাম, মরে যাক শালি। ওই শালারও একটা শিক্ষা হওয়া দরকার। বড় বউটাকে বাপের বাড়িতে রেখে আরেকটা বিয়ে করেছে। সাত-আট বছরের মাসুম বাচ্চা, সৎ মেয়েটিকে সঙ্গে রেখে বাসায় কাজের মেয়ের মতো খাটাচ্ছে। মেয়েটি নীরবে সহ্য করে যাচ্ছে সৎমার নিষ্ঠুর নির্যাতন। আর নিজের ছেলে রাজুকে রেখেছে মাথায় তোলে। এমন পাজি ছেলে আমার জীবনে দ্বিতীয়টি দেখিনি। মাত্র এক মাসের মধ্য আমার বাসায় এসে গেম খেলার বায়না ধরে দুটা অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ভেঙেছে। এত দুষ্টু! এত অবাধ্য! দেখলেই ভয় লাগে! ঘরে এলে রীতিমতো ভূমিকম্প শুরু হয়ে যায়! ঘরটা এক্কেবারে মাথায় তোলে নেয় ছেলেটি! মোবাইল সেট নিয়ে কাড়াকাড়ি করে! মা সঙ্গে থাকলেও ছেলেকে তেমন কিছু বলে না! মায়ের আদর পেয়ে এই ছেলেটি যে এক দিন মারাত্মক বখাটে হবে এর শতভাগ গ্যারান্টি দিলেও ভুল হবে না! দিনে কতবার যে আসে এর হিসাব রাখা দায়! এত জ্বালায় ছেলেটি! ইচ্ছে হয় মেরে হাড্ডিগুড্ডি ভেঙে দিই! কিন্তু বাচ্চা ছেলে! গায়ে হাত তুলি কী করে? এটাও ঠিক হবে না।

রক্তচাপ ২২০-১২০! পেটের ব্যথায় ছটফট করছে। বেশ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আজ বিকালেও আমার বাসায় মহিলাকে সুস্থ দেখেছি। মনে হচ্ছে, পেটে কোনো আঘাত পেয়েছে। কিন্তু রোগী তা বলেনি। আমি রোগীকে হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শ দিয়ে বেডরুম থেকে ড্রয়িংরুমে এসে বসলাম।

আদরি আমার কাছে এসে বলল, ‘আংকেল আপনি ঠিকই ধরেছেন। রাজু আম্মুর পেটে আজ জোরে লাত্থি মেরেছিল। তখন থেকেই ব্যথা হচ্ছে।’ হুম। আজ তোমাকে মারেনি? ‘আম্মু অসুস্থ হয়ে আজ আরো বেশি মারছেন। বারবার মারছেন।’ বারবার মারছেন কেন? ‘এখন এটা তখন সেটা করতে বলছেন। দেরি না করলেও বলেন, এত দেরি কেন? বলেই রাগে চুলে ধরে চড়-থাপ্পড় মারছেন।’ আমি আদরিকে সান্ত¡না দিয়ে বললাম, তুমি কষ্ট পেও না মা। তোমার আম্মু তো অসুস্থ। তাই বুঝতে পারছে না।

বাবা আসছে আভাস পেয়েই আদরি চলে গেল। আদরির বাবা এসে বলল, ‘দুলাভাই, আপনি তো ডাক্তার মানুষ। এসব ব্যাপারে আপনার ধারণা আছে। তা ছাড়া আপনাদের এলাকায় সব জায়গা আমার পরিচিত নয়। আমি আপনার দুটো পায়ে ধরি, আপনি একটা উপায় করে দিন।’ আমি সাহস দিয়ে বললাম, ‘আপনি শান্ত থাকুন। আমি দেখছি।’

কয়েক জায়গায় ফোন করে একটা সিএনজির ব্যবস্থা হলো। রোগীকে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললাম। কিন্তু আমি ছাড় পেলাম না। আমাকেও যেতে হলো তাদের সঙ্গে। মনে মনে নিজের ওপর নিজের খুব রাগ হয়েছিল। কেন যে বড় ডাক্তার হতে পারলাম না। কেন যে গ্রাম্যডাক্তারে মতো একজন হাতুড়ে ডাক্তার হলাম। বড় ডাক্তার হলে কি এই মাঝরাতে যে কেউ আমাকে ফোন দেওয়ার সাহস পেত? রাতের ঘুম হারাম করে রোগীর সঙ্গে মেডিকেলে যেতে হতো? তাও আবার ফি ছাড়া। শুধুই মানবিক কারণে। কী লাভ? কী দাম পাচ্ছি এই হাতুড়ে চিকিৎসক হয়ে?

রোগীকে লেবার ওয়ার্ডে ভর্তি করালাম। কর্তব্যরত ডাক্তার রোগীর দেখভাল করছেন। স্যালাইন লাগিয়ে ওষুধ দিয়েছেন। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। সকালবেলায় বড় ডাক্তার এলেন। রোগী দেখে বললেন, অবস্থা ভালো নেই। মাকে বাঁচানোর চেষ্টা করলে, বাচ্চা পাবেন না। বাচ্চাকে বাঁচাতে গেলে মাকে বাঁচানো কঠিন হবে। আপনারা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিন, আমরা কোনটা করব? (চলবে)

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close