জুয়েল আশরাফ

  ১৪ মে, ২০২২

সমুদ্র আর বুড়ি

সুদূর সমুদ্রে একটি দ্বীপ। এই দ্বীপে এক বুড়ি একা একা থাকে। নাবিকরা এই দ্বীপটিকে বুড়িদ্বীপ বলে। দ্বীপটি আগ্নেয় শিলা দিয়ে তৈরি। একটি অংশে কয়েকটা নারকেলগাছ আছে। এ ছাড়া আর কিছুই বাড়েনি। পাথরগুলো পানির নিচে যথেষ্ট দূরে ছড়িয়ে। পাশ দিয়ে যাওয়া অনেক জাহাজ পাথরের আঘাতে ডুবে যায়। কখনো কখনো একটি ভুলে যাওয়া জাহাজ মিষ্টি পানির জন্য সেখানে নোঙর করে, বুড়ি তাদের সাহায্য করে।

নির্জন দ্বীপে বুড়িকে দেখে নাবিকরা খুব অবাক হয়। তারা জিজ্ঞাসা করে, বুড়ি, তুমি এখানে একা থাকো কীভাবে?

এ কথা শুনে বুড়ি চুপ করে থাকে। এক দিন একজন নাবিক অনেক কিছু জিজ্ঞেস করল। বুড়ি বলল, অনেক বছর আগে আমার পুরো পরিবার জাহাজে যাচ্ছিলাম। আমাদের জাহাজ এই দ্বীপের পাথরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে পড়ে। সবাই ডুবে গেল, শুধু আমি বেঁচে গেলাম। এখন আমি কোথায় যাব?

বলতে বলতে বুড়ি চোখের পানি মুছল। তারপর আবার বলল, আর যদি আমি চলে যাই, যারা আসবে তাদের কে বলবে মিষ্টি পানি কোথায়?

একবার দ্বীপে বৃষ্টি হয়নি। গর্তে ভরা বৃষ্টির পানি শুকিয়ে গেছে। এটা দেখে বুড়ি চিন্তিত হয়ে পড়ল। সে ভাবতে লাগল, এই পানি শুধু আমার জন্য কম হবে। এখানে আসা নাবিকদের তৃষ্ণা কীভাবে মেটাব!

সেই রাতে বুড়ি ঘুমাতে পারল না। অস্থিরভাবে সমুদ্রে ঘুরে বেড়াল। সমুদ্রের পানি চাঁদের আলোয় রুপোর মতো জ্বলজ্বল করছে। হঠাৎ ঢেউ নাড়ল। বুড়ি দেখল কেউ ঢেউ থেকে বেরিয়ে আসছে তার দিকে। সে অবাক হয়ে গেল! কে হতে পারে? কিছুটা ভয় হলো। তারপর ব্যক্তিটি সমুদ্র থেকে বেরিয়ে তার কাছে এলো।

বুড়ি দেখল একটি লোকের কপালে চকচকে মুক্তার মালা আর হাতে বিশাল আকৃতির ঝিনুকের খোসা। লোকটি বলল, বুড়ি, আমি সমুদ্র!

বুড়ি অবাক গলায় বলল, সমুদ্র! তুমি সমুদ্র!

হ্যাঁ, আমি তোমাকে প্রতিদিন দেখি। কষ্টের পরও, যারা এখানে আসে তাদের তৃষ্ণা নিবারণ করো। আমি পানিতে ভরা, কিন্তু আমি কারোর তৃষ্ণা মেটাতে পারি না। আমি তোমার দুঃখ বুঝি। আমি তোমাকে মিষ্টি পানি পেতে একটি কৌশল বলতে পারি। আমার পানি নাও তারপর গরম করো। তার বাষ্প সংগ্রহ করো। এটি ঠাণ্ডা হয়ে মিষ্টি পানিতে পরিণত হবে।

বলতে বলতে সাগর পানিতে ডুবে গেল।

বুড়ি তৎক্ষণাৎ পাত্রের মধ্যে সমুদ্রের পানি নিয়ে গেল। সাগরের কথামতো কাজ শুরু করল। পানি গরম করার ফলে যে বাষ্প উঠল তা অন্য একটি পাত্রে সংগ্রহ করল। পরে যখন দেখল সেই হাঁড়িতে পানি। সেই পানি পান করল আর আনন্দে নাচতে শুরু করল। সত্যিই লবণ পানি মিষ্টি পানিতে পরিণত হয়েছে!

প্রতিদিন বুড়ি সমুদ্রের পানি থেকে মিষ্টি পানি প্রস্তুত করে তা সংগ্রহ করে। যখনই জাহাজের নাবিকরা দ্বীপে আসে, তখন সে তাদের মিষ্টি পানি পান করতে দেয়।

নাবিকরা বুড়িকে বিভিন্ন উপহার দেয়, কিন্তু বুড়ি তা প্রত্যাখ্যান করে। সে বলে, উপহারের সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক?

কিন্তু নাবিকরা রাজি নয়। দ্বীপে প্রচুর খাদ্যসামগ্রী রেখে দেওয়া হয়। একবার দ্বীপের কাছে অনেক জাহাজ এসে থামল। বুড়ি নাবিকদের পানি পান করেতে দিল। বুড়ি বলল, তোমরা কিছুক্ষণ থাকো। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে মিষ্টি পানি প্রস্তুত করব।

বুড়ি তীরে গেল। কেউ তার হাত ধরলে পাত্রটি পানিতে ডুবে যায়। বুড়ি ভয় পেয়ে গেল। তারপর সাবধানে তাকিয়ে দেখল সমুদ্রের মুখ। সমুদ্র বলল, বুড়ি, পানি নিও না, নাবিকরা তৃষ্ণায় মরে যাক।

কেন?

এই জাহাজগুলো চিনির বস্তাভর্তি। আমি জাহাজ ডুবিয়ে দেব। পুরো জাহাজ আমার লবণ পানিতে দ্রবীভূত হবে। পানি মিষ্টি হবে।

এ কথা বলে সাগর হেসে উঠল।

বুড়ি তার কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। সে বলল, তুমি কী বলছো? তুমি খুব বড়। তোমার লবণাক্ততা মাত্র একটি জাহাজের চিনিতে কোথায় দূর হবে?

সমুদ্র বলল, আমাকে বোঝাতে এসো না। তুমি যদি আমার কথা না শোনো, আমি তোমার চুলার আগুন নিভিয়ে দেব, তাহলে তুমি মিষ্টি পানি কীভাবে প্রস্তুত করবে?

বুড়ি কী বলবে বুঝতে পারল না! তার চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে লাগল। বুড়ি বলল, ঠিক আছে, তোমার লবণ পানি কেড়ে নিতে দিও না। আমি তোমাকে অভিশাপ দিলাম তুমি সর্বদা লবণাক্ত থাকবে! দ্বীপে যতটা তাজা পানি আছে, আমি এসব নাবিকের পান করার জন্য পানি দেব। এমনকি যদি আমি আমার জীবন হারাই তবুও দেব। আমি নাবিকদের তোমার সম্পর্কে বলব। আমি তাদের জন্য সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করব। তুমি আল্লাহর চেয়ে বড় নও।

পানির পাত্র সেখানে রেখে বুড়ি কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এলো।

নাবিকরা বুড়িকে কাঁদতে দেখে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার? কিন্তু বুড়ি কী বলবে? সে চুপ করে কাঁদতে থাকে। তার পুরোনো ক্ষত আবার সবুজ হয়ে গেল। সে নাবিকদের বলল, আমার সঙ্গে চলো। দ্বীপে একটু মিষ্টি পানি আছে। তোমরা এটা পান করো।

বুড়ি নাবিকদের মিঠাপানির জায়গা দেখিয়ে ফিরে আসে আর তীরে বসে কাঁদতে শুরু করে। সে ভাবল, সমুদ্রের কী হয়েছে? কেন সে এত স্বার্থপর হয়ে উঠল? প্রথমে সে বলেছিল কীভাবে লবণপানি মিষ্টি বানানো যায়।

বুড়ি! একটা আওয়াজ এলো। সমুদ্রের আওয়াজ, কিন্তু বুড়ি সমুদ্রের ডাক উপেক্ষা করল। তখন বুড়ি দেখল সমুদ্র তার কলস নিয়ে আসছে। সমুদ্র কলসি নামিয়ে দিল। তাতে পানি আছে। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর বলল, বুড়ি, তুমি কি রাগ করেছো? আমাকে ক্ষমা করো। সত্যিই তুমি ঠিক বলেছো। মিষ্টি পানি প্রস্তুত করো আর নাবিকদের দাও। আমি তোমাকে কখনো বাধা দেব না। তোমার হৃদয়কে আঘাত করার জন্য আমি লজ্জিত। তুমি আমার নুনের পানি মিষ্টি করতে পারো, অন্যথায় আমার পানি লবণাক্ত থাকবে।

সমুদ্রের কথা শুনে বুড়ির কান্না থেমে গেল। সে হাসল। সমুদ্র থেকেও হাসির শব্দ ভেসে এলো। বুড়ি দেখল, সমুদ্র হাসতে হাসতে ফিরে যাচ্ছে।

নাবিকরা যখন সেখানে এলো, তারা দেখল বুড়ি খুব খুশি। অনেক চুলা জ্বলছে। সমুদ্রের পানি চুলার ওপর উত্তপ্ত হচ্ছে। নাবিকরা বুড়ির কাছে সমুদ্রকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। তারা তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে থাকল, কিন্তু বুড়ি চুপ করে থাকল। সমুদ্রের লবণাক্ত পানিকে যতটা সম্ভব মিষ্টি করতে লাগল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close