অরুণ বর্মণ

  ২৯ জানুয়ারি, ২০২২

পিঁপড়া ও কাঠঠোকরা

এক দিন এক কাঠঠোকরা একটি শিরীষগাছের মরা ডালে এসে বসল ঠোকানোর উদ্দেশ্যে। কাঠঠোকরার স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যই হলো বড় কোনো গাছের গায়ে বসে তার শক্তচক্ষু দ্বারা ঠুকিয়ে ঠুকিয়ে গর্ত করা। সেটা খাবার সংগ্রহের উদ্দেশ্যেই হোক বা বাসা তৈরির উদ্দেশ্যেই হোক অথবা আনন্দের খোরাক জোগাতে হোক। কাঠ ঠোকায় বলেই স্বভাবের সঙ্গে মিল রেখে পাখিটার নাম হয়েছে কাঠঠোকরা।

গাছটির ওই মরা ডালে ছিল একঝাঁক পিঁপড়ার আবাসভূমি। পিঁপড়ারা ওই মরা ডালটার শুকনো বাকলের মধ্যে অথবা কাণ্ডের ফাটার মধ্যে বাসা তৈরি করে বাচ্চা-কাচ্চা আত্মীয়স্বজন নিয়ে বেশ সুখে-শান্তিতে বসবাস করছিল। সেখানে শীতের জন্য বহু খাদ্যও সঞ্চয় করে রেখেছিল। হঠাৎ কাঠঠোকরাটিকে এই ডালটিতে বসতে দেখে পিঁপড়ারা ভয় পেয়ে গেল। ভাবল আজ সব শেষ। কাঠঠোকরাটি তাদের বাচ্চা-কাচ্চা, ডিম শীতকালীন খাদ্য সব তো খেয়ে ফেলবেই বরং তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই যে ক্ষুদ্র্র বাসাটি সেটাও নিশ্চিহ্ন করে ফেলবে।

তারা কী করবে ভেবে কুল পাচ্ছে না।

এমন পরিস্থিতিতে এক পিঁপড়া সাহস করে কাঠঠোকরাটির সামনে এসে দাঁড়াল। বলল-

- কাঠঠোকরা তুমি এই ডালটিতে ঠুকিও না। এখানে আমাদের অতি নগণ্য বাসা। আমরা বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে এখানে বসবাস করি। তোমার তো গাছের অভাব নেই। তুমি অন্য কোথাও অন্য কোনো গাছে যাও।

- কাঠঠোকরাটি বলল, এই ডালটিই আমার পছন্দ হয়েছে। আমি এখানেই ঠুকাব। আর তোদের মতো ক্ষুদ্র প্রাণীই তো আমার খাদ্য। তোদের সন্ধান পেয়েই তো আমি এখানে এসেছি।

পিঁপড়া অনুনয় করে বলল, দেখো আমরা ক্ষুদ্র প্রাণী।

আমরা তো তোমাকে কোনো ক্ষতি করিনি তাহলে তুমি আমাদের ক্ষতি করবে কেন? তুমি অন্যত্র চলে যাও।

কাঠঠোকরাটি হুংকার দিয়ে বলল, আমি এগাছেই ঠুকাব। তোদের বাচ্চা-কাচ্চা, ডিম, খাবার ওগুলোই তো আমার খাবার। ওগুলোই তো আমি খাব। সুতরাং আমাকে ক্ষ্যাপাস না, এখান থেকে চলে যা।

পিঁপড়া তখন রাগতস্বরে বলল, আমরা ক্ষুদ্র হলেও সংঘবদ্ধ। আমরা নিরীহ প্রাণী। নিজেদের মতো নিজেরা চলি। কাউকে বিরক্ত করি না। কিন্তু কেউ যদি আমাদের বিরক্ত করে তাহলে তাকে আমরা ছেড়ে দিই না। তোমাকে সাবধান করছি তুমি এখান থেকে চলে যাও।

কাঠঠোকরাটি বিদ্রূপের হাসি হেসে বলল, তোরা যতই সংঘবদ্ধ হোস না কেন আমার কাছে তুচ্ছ। আমাকে তোরা কিছুই করতে পারবি না।

- আমি এখানেই ঠুকাব এবং তোদের বাসা, বাচ্চা-কাচ্চা, সঞ্চিত খাদ্য সব খেয়ে তছনছ করে দেব। আর বেশি কথা বললে তোদেরও খেয়ে ফেলব।

- পিঁপড়া তখন চিৎকার করে বলল আমাদের আবাসস্থল অত সহজে কাউকে ধ্বংস করতে দেব না। প্রয়োজনে জীবন দেব তবু বিনা যুদ্ধে পরাজয় স্বীকার করব না। আমি আসছি...

- কাঠঠোকরা তাচ্ছিল্যস্বরে বলল, আরে যা যা! তোদের মতো তুচ্ছ প্রাণীদের আমি ভয় পাই না।

পিঁপড়া চলে গেল অন্য পিঁপড়াদের কাছে।

সবাইকে ডেকে এক জায়গায় করে বলল-

শোনো পিঁপড়ারা আমাদের আবাসস্থল এখন হুমকির মুখে। আমাদের এটা রক্ষা করতেই হবে। কাঠঠোকরাটিকে আমাদের তাড়াতেই হবে। সে যতই শক্তিশালী হোক আমরা যদি সংঘবদ্ধভাবে আক্রমণ করতে পারি সে পরাজিত হবেই। সত্য ও সুন্দরের কাছে মিথ্যা সব সময়ই পরাজিত হয়। আমাদের যুদ্ধ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের যুদ্ধ, আমাদের যুদ্ধ বেঁচে থাকার যুদ্ধ, আমাদের যুদ্ধ বাসস্থান রক্ষার যুদ্ধ। আমাদের ইচ্ছা সৎ তাই আমাদের জয় হবেই। হয়তো অনেকের অনেক কিছু ক্ষতি হবে তবু আমরা জিতব?। মনোবল শক্ত রাখো।

তোমাদের যার যা আছে তাণ্ডই নিয়ে চলো আমরা এখনই কাঠঠোকরাটিকে আক্রমণ করব।

পিঁপড়ারা দল বেঁধে এগিয়ে চলল।

গিয়ে দেখল কাঠঠোকরাটি তাদের বাসার পাশেই কাঠ ঠোকাচ্ছে।

পিঁপড়ারা কিছু না বলে সরাসরি তাকে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিল।

পিঁপড়ারা ভাবল, কাঠঠোকরাটি যে ঠোঁট দিয়ে ঠোকাচ্ছে। ওই ঠোঁটেই প্রথমে আঘাত হানতে হবে। পিঁপড়ার দল কাঠঠোকরার ঠোঁটের চারধারে ঘিরে ধরল। ঠোঁটটা পিঁপড়ার স্তূপ দ্বারা আটকে ফেলল, কিন্তু কাঠঠোকরার ঠোঁট এত শক্ত যে হুল ফুটাতে পারল না। বরং কিছু পিঁপড়া হাত-পা ভেঙে পঙ্গু হলো। কিছু পিঁপড়া কাঠঠোকরার গলাধঃকরণ হলো। ফলে এ আক্রমণ ব্যর্থ হলো।

কাঠঠোকরা বিদ্রূপাত্মক হাসি হেসে বলল ওরে পুঁচকে পিঁপড়ার দল তোরা আমাকে ঘায়েল করতে চাস? তোরাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবি। অতএব চলে যা এখান থেকে।

পিঁপড়ারা মনোবল হারাল না।

এবার চিন্তা করল, কাঠঠোকরাটি যে পায়ের সাহায্যে শক্ত করে গাছে বসে আছে ওই পা দুটোতে আক্রমণ করতে হবে।

পিঁপড়ার দল কাঠঠোকরার দুই পা ঘিরে আঁকড়ে বসল। কামড়ানোর প্রচণ্ড চেষ্টা করল। কাঠঠোকরার পা দুটোও এত শক্ত যে এখানেও হুল ফুটাতে পারল না। এ আক্রমণও ব্যর্থ হলো। কাঠঠোকরার পদপিষ্ট হয়ে অনেক পিঁপড়ার প্রাণ গেল।

কাঠঠোকরা আরো স্বদর্পে হুংকার দিতে লাগল। পিঁপড়াদের ওপর প্রচণ্ড ক্ষেপে গেল। তাদের বংশ ধ্বংস করার হুমকি দিল।

কিন্তু পিঁপড়ার দল ভয় পেল না। তারা কাঠঠোকরার দুর্বল স্থান খুঁজে বের করার চেষ্টা করল।

অবশেষে তারা সিদ্ধান্ত নিল এবার তারা কাঠঠোকরার ঘাড় ও গলায় আক্রমণ করবে।

যে কথা সেই কাজ। কাঠঠোকরার ঘাড় গলার চারপাশে পিঁপড়ারা সারি বেঁধে আক্রমণ করল। কাঠঠোকরার পুরো গলায় যেন পিঁপড়ার মালা তৈরি করে ফেলল। এবার পিঁপড়ারা সহজে হুল ফুটাতে পারল। তারা কাঠঠোকরার গলাটি কামড়ে কামড়ে জর্জরিত করে ফেলল।

কাঠঠোকরা যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল। সে শ্বাস নিতে পারছে না। তার দম আটকে আসছে।

গলা যেন ছিঁড়ে পড়ছে।

অবশেষে কাঠঠোকরা পরাজয় স্বীকার করল।

অনুনয় করে বলল পিঁপড়ারা আমাকে ছেড়ে দাও। আমি ভুল করেছি?। আমি তোমাদের মতো নিরপরাধ নিরীহ প্রাণীকে উত্ত্যক্ত করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও।

তোমাদের ঐক্যবদ্ধ আক্রমণে আমি পরাজয় স্বীকার করলাম।

আমি এ গাছ ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছি। তোমরা তোমাদের পরিবার নিয়ে শান্তিতে বসবাস করো।

পিঁপড়ারা কাঠঠোকরাটিকে ছেড়ে দিল। কাঠঠোকরা দ্রুত উড়ে অন্যত্র চলে গেল।

পিঁপড়ারা তাদের বাসস্থান উদ্ধার করতে পেরে আনন্দোল্লাস করতে থাকল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close