জোবায়ের রাজু

  ১৫ জানুয়ারি, ২০২২

কমলা রঙের জাম্পার

পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী লুবনা। এবার বার্ষিক পরীক্ষায় সে প্রথম হয়েছে। এই আনন্দে তার বান্ধবীরাও বেশ খুশি। লুবনার বাবা এনায়েত আলীও মেয়ের এমন সাফল্যে সন্তুষ্ট। বাবাকে পা ছুঁয়ে সালাম করতেই এনায়েত আলী লুবনার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। খুশিতে বাবাকে জড়িয়ে ধরল লুবনা।

এনায়েত আলী হাসিমুখে মেয়েকে বললেন, ‘তুই তো ভালো পাস করেছিস মা। এ উপলক্ষে আমি তোকে কিছু দিতে চাই।’ বাবার কথা শুনে আনন্দে চোখণ্ডমুখ চিকচিক করে উঠল লুবনার। বাবা কখনো তাকে এ রকম কথা বলেছেন, এমন কোনো স্মৃতি তার মনে পড়ে না।

অনেকক্ষণ ভেবেচিন্তে লুবনা বাবাকে বলল- ‘তাহলে আমাকে একটা জাম্পার কিনে দাও বাবা। শীত চলে এসেছে।’ মেয়ের কথা শুনে এনায়েত আলী হো হো করে হেসে বললেন- ‘সত্যি তো মা। শীত চলে এসেছে। তোর মনের আশা পূর্ণ হবেরে মা। আরো দু-চার দিন পর তোকে একটা সুন্দর দেখে জাম্পার কিনে দেব।’ খুশিতে লুবনা বাবাকে আবার জড়িয়ে ধরল। বাবা সত্যি তাকে কত্ত ভালোবাসে।

এনায়েত আলীর পানের ব্যবসা। বেশ বড়-সড় ব্যবসা তার। গঞ্জে সবাই তাকে একজন সফল পান ব্যবসায়ী হিসেবে চিনে। পনেরো বছর ধরে পানের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকলেও এনায়েত আলী কখনো পান খান না। যদিও একবার খেয়েছিলেন। কিন্তু প্রচণ্ড ঝালে জিহ্বা পুড়তে লাগল আর পিক না ফেলে সেগুলো খেয়ে ফেলতেই মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে গেল এনায়েত আলী। পরে গঞ্জের কয়েকজন লোক তার মাথায় পানি ঢালতেই তিন মিনিটের মাথায় জ্ঞান ফিরল। বাড়িতে এনায়েত আলী এ ঘটনা বললে তার স্ত্রী আর দুই মেয়ে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায়।

এনায়েত আলীর দুই মেয়ে। লোপা আর লুবনা। লোপা পাশের গ্রাম পালপাড়ার চৌধুরী বাড়ির মামুন চৌধুরীর ঘরে কাজ করে। লুবনা পড়ালেখায় ভালো বলে এনায়েত আলী ঠিক করেছেন এ মেয়েকে তিনি পড়ালেখা শেখাবেন।

তিন দিন পার হয়ে গেল। এনায়েত আলী এখনো লুবনাকে তার আবদারের জাম্পার কিনে দেননি। আসলে এনায়েত আলী অনেকটা ভুলো মনের মানুষ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার স্মৃতিশক্তিও দিন দিন কমে আসছে। এই বলেন তো এই ভুলে যান। রাতে বাসায় এসে এনায়েত আলী দেখেন মেয়েটা হালকা কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে। ভোররাত থেকে প্রচণ্ড শীত পড়তে শুরু করে। সকালে লুবনা শীতে কাঁপতে কাঁপতে মক্তবে আরবি পড়তে যায়। গায়ে থাকে মায়ের পুরোনো হালকা চাদরখানা, যা দিয়ে শীত দূর করা যায় না।

এনায়েত আলী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মেয়ের জন্য তিনি রাতে জাম্পার কিনে বাড়ি ফিরবেন। আমিশাপাড়া বাজারের সাহা ক্লথ স্টোরে অনেক ধরনের শীতের সোয়েটার আর জাম্পার ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। সেখানে লাল রঙের যে জাম্পারটি এখনো বিক্রি হয়নি, কাল রাতেও দেখেছেন এনায়েত আলী, আজ সেটা লুবনার জন্য কিনে আনতেই হবে। সকালবেলা বাবা বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় লুবনাকে ডেকে বললেন- ‘আজ তোর জন্য জাম্পার নিয়ে ফিরব। তোর কোন রং পছন্দ মা?’ লুবনা হেসে ছটফট উত্তর দিল, ‘কমলা রঙের জাম্পার চাই বাবা। রাতে আমি কিন্তু তুমি না আসা পর্যন্ত বসে থাকব।’ এনায়েত আলী হো হো করে বললেন, ‘ঠিক আছে। ঠিক আছে মা। কমলা রঙেরই আনব। তুই আমার আসার অপেক্ষায় বসে থাকিস। ঘুমাসনে।’ বাবার কথা শোনে লুবনার মনের মধ্যে সুখের কাঁপন উঠল। খুশিতে তার চিৎকার দিতে ইচ্ছে করছে।

অন্ধকার রাত। সাড়ে ৯টা বাজে। এনায়েত আলীর হাতে একটা শপিং ব্যাগ। ব্যাগে একটা জাম্পার। কমলা রঙের। লুবনার জন্য। শীতের পোশাক। মনে আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরছেন এনায়েত আলী। মেয়েটা আজ এই জাম্পার থেকে খুশিতে কী কাণ্ডই না ঘটিয়ে ফেলে, কে জানে। মনে মনে হাসলেন এনায়েত আলী।

অন্ধকার পথে হঠাৎ কারা যেন এনায়েত আলীর পথ আগলে দাঁড়াল। হাতে ধারালো অস্ত্র। অন্ধকারে তাদের মুখ দেখা যায় না। এনায়েত আলী বুঝে গেলেন বড় বিপদে পড়েছেন তিনি। ছিনতাইকারীরা তাকে না জানি কতটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়ে। অস্ত্র হাতে তিন অচেনা যুবক এনায়েত আলীকে জব্দ করতে থাকে। সঙ্গে কী কী আছে, টুঁশব্দ ছাড়া সব বের করে দেওয়ার হুংকার তাদের তিনজনের। পকেটে ৭৩৪ টাকা আর হাতের শপিং ব্যাগটা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি এনায়েত আলীর কাছে। তারা অস্ত্র ঠেকিয়ে এনায়েত আলীর টাকা আর শপিং ব্যাগটি নিয়ে উধাও...। হায় কী হবে এখন! লুবনার জাম্পার! মেয়েটা যে জাম্পারের জন্য অপেক্ষায় বসে আছে।

খালি হাতে বাসায় ফিরলেন এনায়েত আলী। বাবার মুখটা বেশ মলিন দেখাচ্ছে। বাবা খালি হাতে কেন? জাম্পার আনার কথা ছিল তার। জাম্পার কই? কমলা রঙের জাম্পার! মশারির ভেতরে পাতলা কাঁথা গায়ে দিয়ে বসে আছে লুবনা। বাবাকে খালি হাতে দেখে বলল- ‘জাম্পার কই বাবা?’ এনায়েত আলী কোনো কিছু না বলে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। তার চোখে পানি ছল ছল করছে। মেয়েকে কী জবাব দেবেন, বুঝতে পারছেন না!

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close