জিনিয়াস মাহমুদ

  ২৩ অক্টোবর, ২০২১

তালের পিঠা

লতা। পড়ে তৃতীয় শ্রেণিতে। থাকে ঢাকায়, বাবা-মায়ের সঙ্গে। তার দাদা-দাদি থাকেন গ্রামে। বাবার অফিস যখন বন্ধ থাকে বা লতার স্কুল যখন বন্ধ থাকে তখনই সে গ্রামে যাওয়ার সুযোগ পায়। এ ছাড়া গ্রামে খুব কমই যাওয়া হয়। লতা আজ স্কুল থেকে বাসায় ফিরে কারো সঙ্গে কোনো কথা না বলে চুপচাপ জানালার গ্রিল ধরে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। বরাবর সে স্কুল থেকে বাসায় এসেই হইচই শুরু করে দিত। খেলা করত ছোট ভাই মুহিবের সঙ্গে। আজ হঠাৎ লতার এমন নীরবতা দেখে তার মা নিশিতা আক্তার ছেলে মুহিবকে কোলে করে খাওয়াতে খাওয়াতে লতার কাছে এসে বলেন, লতা মামণি! কী হয়েছে মা তোমার? আজ একেবারে চুপচাপ যে। মন খারাপ? স্যারে কিছু বলেছে মা? লতা কোনো কথা বলে না। মা চলে যান পাশের রুমে।

কিছুক্ষণ পর লতার বাবা সাইফ আকন্দ অফিস থেকে বাসায় ফেরেন। লতা তার বাবাকে দেখে একদৌড়ে বাবার কোলে উঠে পড়ে। তারপর বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে, আচ্ছা বাবা, তুমি আমাকে কতটুকু ভালোবাসো? মেয়ের এমন প্রশ্নে বাবা মুচকি হেসে বলেন, তোমাকে আমি অনেক অনেক অনেক ভালোবাসি মামণি। তুমি হলে আমার মা। আমার কলিজার টুকরা। আমার নিঃশ্বাস। আমার চোখের মণি। এবার তুমি বুঝে নাও যে, তোমাকে আমি কতটুকু ভালোবাসি! লতা মাথা নেড়ে বলে, হুঁ। বাসো। তবে...। তবে কী মামণি? তুমি যদি আমাকে সত্যিই অনেক অনেক অনেক ভালোবাসো, তাহলে তোমাকে আজ আমার একটা আবদার রাখতে হবে। বলো বাবা, রাখবে? একটা কেনও মামণি, তোমার সব আবদার আমি রাখব। এবার বলো যে, তোমার সেই আবদারটা কী? বাবা, আমি গ্রামে যাব। দাদা-দাদির কাছে। বলো না তুমি আমাকে নিয়ে যাবে? বলো না বাবা। অবশ্যই নিয়ে যাব মা। আমারও কদিন ধরে তোমার দাদা-দাদিকে দেখতে মনটা কেমন যেন ছটফট করছে। কিন্তু অফিসের ব্যস্ততার জন্য আর যেতে পারছি না। আজ আমার মামণি যখন বলছে তখন তো আর না গিয়ে থাকতে পারি না। আমি কালই তোমাকে নিয়ে গ্রামে যাব, তোমার দাদা-দাদির কাছে। বাবার কথা শুনে লতার মন-প্রাণ খুশিতে নেচে ওঠে। মুখে ফোটে মিষ্টি হাসি। হাসতে হাসতে বাবাকে বলে, সত্যি বলছো বাবা? সত্যি সত্যি, একশোবার সত্যি। আমি জানতাম বাবা, তুমি না করবে না। এজন্যই তোমাকে আমি অনেক অনেক অনেক ভালোবাসি। বলেই লতা তার বাবার দুগালে চুমো দেয়। যা দেখে বাবা মুচকি হাসেন।

তারপর লতাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলেন, আচ্ছা মামণি, আমরা তো আগামীকাল গ্রামে যাবই, তবে তার আগে আমাকে একটা কথা বলো তো, হঠাৎ করে তুমি গ্রামে যেতে চাচ্ছো কেন? লতা বলে, তোমাকে এখন বলব না বাবা। গ্রামে দাদা-দাদির কাছে গিয়ে তারপর সব বলব। মেনে নিলাম। তবে গ্রামে গিয়ে বলবে তো? অবশ্যই অবশ্যই অবশ্যই বলব। এই বলে লতা আবারও তার বাবার দুগালে চুমো দেয়। বাবাও মেয়ের কপালে চুমো দেয়। পরে দুজনেই একসঙ্গে হেসে ওঠে।

পরের দিন লতা গ্রামে যাওয়ার জন্য তাদের জামা-কাপড় গোছাচ্ছে। সঙ্গে বাবাও। এমন সময় লতার মা এসে বাধা দিয়ে বলেন, এখন গ্রামে যাওয়া যাবে না। তোমার স্কুল খোলা। যখন স্কুল বন্ধ দেবে তখন না হয় আমরা সবাই একসঙ্গে গ্রামে গিয়ে বেড়িয়ে আসব। লতা তার মায়ের কথায় কান না দিয়ে সে তার মতো করে জামা-কাপড়সহ যা যা সঙ্গে নেবে তা গোছাতেই ব্যস্ত থাকে। সে জানে যে, বাবা যখন একবার বলেছে তাকে গ্রামে নিয়ে যাবে তখন আর কোনো বাধা নেই। লতার অভিযোগ- তার মা তাকে এখন আর আগের মতো আদর করেন না। আগের মতো ভালোবাসেন না। খাইয়ে দেন না। গোসল করিয়ে দেন না; ঠিক যখন থেকে তার ছোট ভাই মুহিবের জন্ম হয়। মা নাকি সারাক্ষণ মুহিবকে নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। এসব কথা সে তার বাবাকে রোজই বলে। সে আরো বলে, তার বাবা তাকে সবচেয়ে বেশি আদর করেন। ভালোবাসেন। বাবার কাছে সে যা চায় বাবা তাকে তাই এনে দেন। বাবা তাকে নিজ হাতে প্রতিদিন খাইয়ে দেন। গোসল করিয়ে দেন। প্রতিদিন স্কুলের ড্রেস পরিয়ে দেন। আরো কত কি। কিন্তু মা সব সময় ব্যস্ত থাকেন মুহিবকে নিয়ে। তার কোনো কথাই রাখেন না। লতার মা যখন লতাকে গ্রামে যেতে না করছেন তখন লতার বাবা বলে ওঠেন, শুনো নিশিতা, লতাকে যখন আমি কথা দিয়েছি গ্রামে নিয়ে যাব, তখন যাবই এবং আজই। তোমার কোনো কথাই আর আজ আমরা কানে নিচ্ছি না। আমি বুঝে গেছি, তুমি এখন আর আমার মামণিটাকে একটুও ভালোবাসো না। তুমি ভালোবাসো তোমার ছেলেকে। এই বলে বাবা লতার দিকে তাকিয়ে বলেন, ঠিক বলেছি না লতা মামণি? লতা ডানহাতের তর্জনী আঙুল নাড়িয়ে বলে, একদম ঠিক বলেছো বাবা। মা এখন আর আমাকে একদম আদর করে না। ভালোবাসে না। লতার মা লতার কথা শুনে মিটমিট করে হাসেন। লতার বাবা আবারও বলেন, তুমি যেমন তোমার ছেলেকে আদর করো, ভালোবাসো। ঠিক তেমনি আমিও আমার মেয়েকে আদর করি, ভালোবাসি। তুমি থাকো তোমার ছেলেকে নিয়ে। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে গ্রামে বেড়াতে গেলাম। অবশ্য তুমি চাইলে আমাদের সঙ্গে যেতে পারো। যাবে?

বাবার সঙ্গে লতাও সুর মিলিয়ে বলে ওঠে, যাবে তুমি মা? গেলে অবশ্য আমাদের সঙ্গে যেতে পারো। আমরা না করব না। লতার মা ছেলেকে কোলে করে পাশের রুমে যেতে যেতে বলেন, তোমরা বাপ-বেটি যাও। আমি এখন যাব না। মুহিব যখন হাঁটতে শিখবে তখন যাব। এই বলে তিনি পাশের রুমে চলে যান। লতা তার মাকে উদ্দেশ করে বলে, হ্যাঁ-হ্যাঁ তুমি পরেই যেয়ো। এখন আমরা গ্রাম থেকে বেড়িয়ে আসি। এ কথা বলে লতা তার বাবার দিকে তাকায়। পরে বাপ-বেটি একসঙ্গে হেসে ওঠে। কিছুক্ষণ পরই লতা তার বাবার সঙ্গে গ্রামের উদ্দেশে রওনা দেয়। দুপুরের পরপরই তারা গ্রামে গিয়ে পৌঁছায়। লতার দাদা-দাদি লতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করে। লতাকে কাছে পেয়ে দাদা-দাদির যেন আনন্দের সীমা নেই। লতার দাদা বিকালবেলা লতাকে পুরো গ্রাম ঘুরে দেখান। লতা তার দাদার কাছে নানা রকম প্রশ্ন করে আর দাদা তার জবাব দেন। কখনো পাখি দেখে বলে, এই পাখিটার নাম কী? কখনো ফুল দেখে বলে, এটা কী ফুল? গাছপালা-ফলমূল আরো কত কি। দাদা এক-এক করে সব বলেন।

ধীরে ধীরে সন্ধ্যা হয়। রাতে সবাই একসঙ্গে খেতে বসেন। লতার দাদি লতাকে নিজের হাতে খাইয়ে দেন। মাঝে মাঝে তার দাদাও তাকে খাইয়ে দেন। নাতনির প্রতি এমন ভালোবাসা দেখে লতার বাবা সাইফ আকন্দের আনন্দে যেন দুচোখ ছলছল করে ওঠে। খাওয়া শেষে লতা তার দাদা-দাদির সঙ্গে শুয়ে পড়ে। আর তার বাবা শুন পাশের রুমে। লতার দাদা শুয়ে শুয়ে নানারকম গল্প বলতে থাকেন। লতা তা গভীর ধ্যানে শুনে। গল্প শুনতে শুনতে একসময় লতা ঘুমিয়ে পড়ে।

সকাল হলো। পাখির কিচিরমিচির শব্দ আর পিঠার মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে আসতেই ঘুম ভেঙে যায় লতার। সে উঠে একদৌড়ে চলে যায় রান্নাঘরে। গিয়ে দাদিকে জড়িয়ে ধরে। মুখে মিষ্টি হাসি। লতার হাসি দেখে দাদিও হাসেন। দাদি একটা পিঁড়ি টেনে লতাকে তাতে বসতে বলেন। লতা বসে। বসে বসে দাদি কীভাবে পিঠা বানাচ্ছেন তা দেখে। তার মনে যেন আজ আনন্দের জোয়ার বইছে। সে আজ তার দাদির হাতে বানানো গরম-গরম পিঠা খাবে। কিছুক্ষণ পর লতার দাদা আর তার বাবাও বিছানা থেকে ওঠে পড়েন। লতা তার দাদার সঙ্গে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে আসে। এরই মাঝে দাদির পিঠা বানানোও শেষ হয়। দাদি রান্নাঘরের মেঝেতে একটা পাটি বিছিয়ে দেন। লতার দাদা আর বাবা তাতে বসেন। লতা বসে তার দাদির কোলে। দাদি স্টিলের একটা বড় বাটিতে বাটিভর্তি গরম-গরম তালপিঠা আর তালবড়া তাদের সামনে রাখেন। লতা বাটি থেকে একটি তালপিঠা হাতে নিয়ে খেতে শুরু করে। তারপর এক এক করে সবাই।

লতা পিঠা খেতে খেতে বলতে থাকে, আহ! কী স্বাদ! আজ আমি অনেক পিঠা খাব। এখানে আমি যত দিন থাকব প্রতিদিন শুধু পিঠা আর পিঠা খাব। দাদির হাতের পিঠা অনেক অনেক অনেক মজা! লতার বাবা লতার দিকে তাকিয়ে বলেন, হ্যাঁ। তুমি ঠিক বলেছো লতা। তোমার দাদির হাতের পিঠা অনেক মজা! আজ কত দিন পরে তোমার দাদির হাতের পিঠা খাচ্ছি। তুমি আসতে না চাইলে তো এখন আসাই হতো না। খাওয়াও হতো না আর এমন মজার পিঠা। এরই মাঝে লতার দাদি বলে ওঠেন, তোমরা এখানে যত দিন থাকবে প্রতিদিনই আমি তোমাদের জন্য পিঠা বানাব। যত খুশি খাবে। মনভরে খাবে। আগামীকাল তোমাদের জন্য অন্যরকম স্বাদের আরেকটা পিঠা বানাব। আর তা হলো কলাপাতার তালপিঠা। খেলেই বুঝতে পারবে কেমন মজা! লতা এবার কী মজা! কী মজা! বলে হাততালি দিয়ে লাফিয়ে ওঠে। লতার বাবা এবার বলে ওঠেন, মামণি, এবার বলো তো, হঠাৎ করে গত পরশু গ্রামে আসার জন্য এতটা অস্থির হয়েছিলে কেন? তুমি কিন্তু আমাকে কথা দিয়েছিলে, এখানে এসে সব বলবে। মনে আছে তো?

লতা বলে, হ্যাঁ, বাবা। মনে আছে।

তাহলে শুনো, ওইদিন আমাদের স্কুলের শারমিনা ম্যাডাম ক্লাসে এসে বলেছিলেন, প্রকৃতিতে এখন শরৎকাল। ভাদ্র মাস। আর এই ভাদ্র মাসে গাছে গাছে তাল পাকে। পাকা তাল দিয়ে পিঠা বানানো যায়। যাকে আমরা তালপিঠা বলি। খেতে খুব মজা! আর এই তালপিঠা গ্রামে গেলে খাওয়া যায়। শহরে তো তালগাছ নেই। তাই শহরে তালপিঠা খুব একটা দেখা যায় না। ম্যাডামের মুখে তালপিঠার কথা শুনে তখনই আমার দাদির কথা মনে পড়ে। আর দাদির হাতের মজার এই তালপিঠা খেতে সাধ জাগে। তাই আমি তোমাকে বলেছিলাম আমাকে এখানে নিয়ে আসতে। যাতে করে মনভরে পিঠা খেতে পারি। আচ্ছা বাবা, এবার তুমিই বলো, যদি আমরা গ্রামে দাদা-দাদির কাছে না আসতাম তাহলে কি এমন মজার মজার পিঠা খেতে পারতাম? পারতাম না। লতার বাবা মুখে পিঠা দিতে দিতে বলেন, ও...তাহলে এই কথা! হ্যাঁ, বাবা। এই কথা। এই বলে লতা বাটি থেকে আরেকটি পিঠা হাতে নেয়। তারপর তা খেতে খেতে সুরে সুরে গাইতে থাকে-

দাদির হাতের পিঠা, খেতে ভারী মিঠা! খেতে ভারী মিঠা! দাদির হাতের পিঠা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close