রেজাউল করিম খোকন

  ১৬ অক্টোবর, ২০২১

স্বপ্নের গীমানায়

বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক আগেই। কিন্তু তৃণার চোখে ঘুম নেই। অনেক আনন্দ আর উত্তেজনায় ঘুম আসছে না তার। তৃণার কাছে রাতটা অনেক দীর্ঘ মনে হচ্ছে। কোনোভাবেই যেন রাতটা পেরোতে চাচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করছে সে ঘুমোতে। কিন্তু সব চেষ্টাই ভেস্তে গেছে। এখন বিছানায় শুয়ে কেবলই ছটফট করছে তৃণা। কাল তার জীবনে একটি বিশেষ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। যার অপেক্ষায় তার এই উত্তেজনা। অনেক আনন্দ তাকে জড়িয়ে আছে। আগে এত আনন্দ পায়নি সে কোনো কিছুতেই।

কমলগঞ্জ গার্লস হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী ফারজানা রহমান তৃণা রাজধানী ঢাকার বাইরে সাধারণ এক মফস্বলের বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী হলেও অনেক মেধাবী সে। ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল বলে তার আলাদা একটা পরিচিতি রয়েছে। স্কুলের শিক্ষকরা সবাই তাকে বেশ পছন্দ করেন। এর পেছনে অবশ্য ফার্স্ট গার্ল হওয়াটাই প্রধান কারণ নয়। শুধু পড়াশোনায় নয়, এর বাইরে সৃজনশীল সাংস্কৃতিক নানা কর্মকাণ্ডে নিয়মিতভাবে সক্রিয় তৃণা। স্কুলের রচনা প্রতিযোগিতা, বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতা, আবৃত্তি গান সবকিছুতেই অংশ নেয় সে। প্রতিবারই অনেকগুলো পুরস্কার জিতে নেয়। উপজেলা, জেলাপর্যায়েও একজন চৌকস, মেধাবী ছাত্রী হিসেবে তৃণার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়েছে এর মধ্যে।

মফস্বলের মেয়ে বলে কোনোভাবেই পিছিয়ে থাকতে রাজি নয়। এরই মধ্যে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে সে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে অনেকগুলো পুরস্কার জিতেছে। তার কারণে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে কমলগঞ্জ গার্লস হাইস্কুলের পরিচিতি ছড়িয়ে পড়েছে। তৃণাকে নিয়ে ওর এলাকর সবাই গর্ব অনুভব করে এখন।

কয়েক মাস আগে ‘সুন্দর পরিবেশ, সুন্দর পৃথিবী’ বিষয়ে জাতিসংঘ আয়োজিত একটি রচনা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল তৃণা। ওদের স্কুল থেকে একমাত্র সেই অংশ নিয়েছিল। এত বড় আয়োজনের কোনো প্রতিযোগিতায় আগে কোনো সময় অংশ নেয়নি সে। সারা দেশ থেকে কয়েক শ ছাত্রছাত্রী এই রচনা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল। আশপাশে তেমন বড় লাইব্রেরি না থাকায় জেলা শহরের পাবলিক লাইব্রেরি পর্যন্ত ছুটে গেছে তৃণা। অনেক বইপত্র ঘেঁটে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে রচনাটি লেখার জন্য। অনেক পরিশ্রম করে রচনাটি লিখেছে সে। তারপর স্কুলের হেডস্যারকে দেখিয়েছে। তার স্কুলের একজন ছাত্রীর মেধা এবং সৃজনশীলতার চমৎকার প্রকাশ দেখে অনেক খুশি হয়েছেন তিনি।

ঢাকায় জাতিসংঘ অফিসে রচনাটি পাঠানোর পর কয়েক মাস পেরিয়ে গেছে। প্রথম কিছুদিন পাঠানো রচনাটি নিয়ে চিন্তাভাবনা হলেও এরপর প্রায় ভুলতে বসেছিল তৃণা। শত শত ছাত্রছাত্রীর পাঠানো রচনার ভিড়ে তার লেখা রচনা হয়তো কোথায় হারিয়ে গেছে। বিচারকদের মনোযোগই আকর্ষণ করতে পারেনি। দেশের সেরা সব স্কুলের মেধাবী, চৌকস ছাত্রছাত্রীরা এই প্রতিযেগিতায় অংশ নিয়েছে যেখানে, সেখানে তার মতো অতি সাধারণ, মফস্বলের একজন স্কুলছাত্রী কী পেরে উঠবে প্রতিযোগিতায়- এসব ভেবে ভেবে মন খারাপ হয়েছে তার বেশ কিছুদিন। এরপর প্রায় ভুলেই গিয়েছিল তৃণা ব্যাপারটা। স্কুলের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে আবার। মফস্বল শহরের নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে তৃণা। ওর বাবা ঢাকায় একটা সরকারি অফিসে সাধারণ চাকুরে। সৌরভ তৃণার একমাত্র বড় ভাই। প্রতিবন্ধী বলে সে কোনো দিন স্কুলে যেতে পারেনি। সারা দিন বাড়িতে বসে থাকে। কিছুই করতে পারে না। এ নিয়ে বাবা-মায়ের মনে অনেক দুঃখ। সুস্থ থাকলে সৌরভ এত দিনে ভার্সিটিতে পড়ত। এরপর পাস-টাস করে চাকরি-বাকরি ধরত। তৃণা তার জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখে আসছে বড় ভাই সৌরভের অসুস্থতা আর নানা বিড়ম্বনা তাকে নিয়ে।

বাবা-মায়ের অসহায়ত্ব তৃণাকে বেদনার্ত করে, অনেক কষ্ট দেয় মনে। সৌরভের অসুস্থতা বাবা-মাকে সব সময় অস্থির করে রাখে। বড় ভাইটির চিকিৎসার পেছনে প্রতি মাসে অনেকগুলো টাকা খরচ করতে হয়। সরকারি চাকুরে বাবার আয় খুব বেশি নয়, এটা জানে এবং বোঝে তৃণা। তার সামর্থ্যরে সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করে সে এই বয়সেই। যে কারণে অহেতুক বাড়তি কোনো বায়না করে না সে বাবা-মায়ের কাছে। তবে মাঝেমধ্যে বই কেনার জন্য টাকা চায় বাবার কাছে। বিভিন্ন বিষয়ের নানা ধরনের বই পড়ায় তার অনেক আগ্রহ। বিভিন্ন জনের কাছ থেকে এনে, কিংবা স্কুলের লাইব্রেরি থেকে এনে নিয়মিত বই পড়ে তৃণা। এর বাইরেও কিছু কিছু বই কিনে পড়ার জন্য। বাড়িতে একটা ছোটখাটো লাইব্রেরি গড়ে তুলেছে সে এর মধ্যেই।

গত সপ্তাহে জাতিসংঘ আয়োজিত ‘সুন্দর পরিবেশ, সুন্দর পৃথিবী’ রচনা প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। ঢাকা থেকে আয়োজক সংস্থা টেলিফোনে এবং ই-মেইলে স্কুলের হেড স্যারের কাছে জানিয়েছে, তৃণার লেখা রচনাটি সেরা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এশিয়া অঞ্চলের আরো বিশটি দেশে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা একইভাবে বিষয়টির ওপর আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল। বিশ দেশের সেরা বিশজন ছাত্রছাত্রীকে পুরস্কার নিতে আমেরিকার নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে যেতে হবে। আয়োজক সংস্থা তাদের খরচে পুরস্কার বিজয়ীদের জাতিসংঘে নিয়ে যাবে।

গ্রীষ্মকালীন স্কুল ছুটি থাকায় হেডস্যার নিজেই তৃণাদের বাড়ি এসে সুখবরটি দিয়ে গেছেন। পুরো এলাকাজুড়ে খবরটি ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগেনি। সেই থেকে তৃণাদের বাড়িতে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন সহপাঠী বন্ধু-বান্ধবদের পদচারণে মুখরিত হয়ে উঠেছে। সবার মুখে এখন তৃণার এত বড় পুরস্কার অর্জন নিয়ে আলোচনা। সবাই উচ্ছ্বসিত, আনন্দিত। এত কম বয়সে একজন মেয়ে হয়ে দেশের জন্য, এলাকার জন্য সম্মান বয়ে এনেছে তৃণা। সবাই এজন্য গর্ব অনুভব করে। এত বড় প্রাপ্তির কথা ভাবতে পারেনি তৃণা। আনন্দে তার চোখ দুটি ছল ছল করে ওঠে।

ঢাকার জাতিসংঘ অফিস থেকে তৃণাকে ডাকা হয়েছে। তাদের সঙ্গে দেখা করে আমেরিকা যাওয়ার কাগজপত্র তৈরি করতে বলা হয়েছে। এজন্য কাল সকালে বাবার সঙ্গে ঢাকা যাবে তৃণা। এজন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে সে। এদিকে মা উপজেলা মার্কেট থেকে তৃণার জন্য একটি সুন্দর ডিজাইনের হাল ফ্যাশনের জামা কিনে এনেছেন। এ রকম দামি সুন্দর একটি জামা পরে সে ঢাকা যাবে, ভাবতেই তৃণার মনটা অনেক আনন্দে নেচে ওঠে। তৃণা তার জন্য কেনা নতুন জামাটি অনেকক্ষণ নেড়ে চেড়ে দেখে। তারপর বালিশের পাশে রেখে শুয়ে পড়ে। একসময় রাজ্যের ঘুম এসে ভর করে তৃণার দুচোখে। একটি সুন্দর সকালের স্বপ্নের বিভোর হয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে থাকে সে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close