চণ্ডীচরণ দাস

  ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১

গোঁফ চুরি

এক ছিল রাজা। তার ছিল বিরাট একটা সোনার চূড়ো দেওয়া রাজপ্রাসাদ। সেই রাজপ্রাসাদ লোক-লস্কর, পাইক-বরকন্দাজ, চাকর-বাকরে সব সসময় গমগম করছে। রাজার হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া, আর খাজাঞ্চিখানা মোহরে ভরা। রাজা খুব ভালো মানুষ, সবাইকে খুব ভালোবাসেন, প্রজারা তার রাজত্বে সুখে শান্তিতে আছে।

রাজার ছিল নাকের নিচে ইয়া বড় এক জোড়া পেল্লায় গোঁফ। দুজন লোক দুদিক থেকে দুবেলা সেই গোঁফে যত্ন করে তেল লাগিয়ে দিত। রাজসভায় কাজের ফাঁকে রাজা মাঝে-মাঝে তেল চকচকে সাধের গোঁফে তা দিতেন। গোঁফ নাচিয়ে যখন কাউকে বকতেন সে ভয়ে পেচ্ছাপ করে ফেলত। আবার গোঁফের নিচে দাঁত বের করে হেসে যখন ঠাট্টা-তামাশা করতেন তখন রাজসভার সবাই আনন্দে ‘হো’ ‘হো’ করে হেসে উঠত। একদিন হলো কী, সকালে রাজার গোঁফে তেল দিতে এসে দুজনের একজন রাজার মুখের সামনে থমকে গেল। রাজামশাই আশ্চর্য হয়ে ব্যাপার কী জিজ্ঞাসা করতেই সে ‘ভ্যাঁ’ করে কেঁদে উঠে বলল, ‘রাজামশাই, নেই!’

‘কী নেই রে?’ প্রশ্নে সে ভয়ে ভয়ে বলল, ‘আপনার একখানা গোঁফ নেই।’ ‘সে কী?’ বলেই রাজামশাই লাফিয়ে উঠলেন। ভেবে দেখলেন কাল তো নাপিতও আসেনি গোঁফ ঠিক করতে। রাতে শুতে যাওয়ার আগেও তো গোঁফ দুটো ঠিকঠাকই ছিল। তাহলে রাতের মধ্যে একটা গোঁফ গেল কোথায়? সবাই তটস্থ হয়ে উঠল এ ঘটনায়। রানি তো কেঁদে অস্থির, রাজপ্রাসাদে আসা ইস্তক এই গোঁফজোড়া নিয়ে কত হাসি, কত তামাশা চলত রাজার সাথে, এগুলো ছিল তার গর্ব। রাজার গোঁফ না থাকলে তিনি এখন কী নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করবেন? মন্ত্রী শুনে বলে, ‘কার এত সাহস যে রাজামশাইয়ের গোঁফ চুরি করে নিয়ে যায়?’ চর বলে, ‘এর যথাযথ তদন্ত হওয়া দরকার। আমি এখুনি চারদিকে লোক লাগাচ্ছি, ব্যাটা গোঁফ নিয়ে রাতের মধ্যে পালাবে কোথায়?’ সেনাপতি তলোয়ার উঁচিয়ে বলে, ‘নেহি ছোড়েঙ্গা। একবার ধরতে পারলে এক কোপে ব্যাটার ধড় থেকে মুণ্ডু নামিয়ে দেব।’ বলে সবাই চোরের সন্ধানে নেমে পড়ল, কিন্তু চোর ধরা পড়ল না। রাজামশাই মনমরা হয়ে খাসমহলেই সারাদিন বসে রইলেন, লজ্জায় রাজসভায় গেলেন না। রানি এসে অনেক বোঝালেন, কিন্তু রাজার মনে শান্তি এলো না। ভালো করে খাওয়া-দাওয়াও করলেন না।

রানি তখন রাজ-জ্যোতিষীকে ডাকালেন। রাজ-জ্যোতিষী টিকি দুলিয়ে মোটামোটা পেল্লায় সাইজের বইপত্র নিয়ে এসে মাথা নেড়েনেড়ে অনেকক্ষণ ধরে গণনা করে শেষে বলল, ‘হুঁ, গম্ভীর ব্যাপার। রাজপ্রাসাদের ওপর কুদৃষ্টি পড়েছে, অনেক শান্তি-স্বস্ত্যয়ন প্রয়োজন। তবেই কুদৃষ্টি কাটবে আর মন্ত্রের প্রভাবে চোরও নিজেই এসে গোঁফ দিয়ে যাবে।’ বলে বিরাট আয়োজন করে রাজ-জ্যোতিষী তার কাজে লেগে পড়ল। কিন্তু ফল কিছুই হলো না। সারাদিন রাজার মন ভারি! অভ্যাসবশত গোঁফে হাত বুলাতে গিয়ে মনটা হু-হু করে ওঠে। শেষে রানির অনেক পীড়াপীড়িতে রাতে কিছু খেয়ে রাজামশাই শুতে গেলেন। চারদিকে জবরদস্ত পাহারা মোতায়েন হলো, যাতে চোর কোনোভাবে ঘরে না ঢুকতে পারে।

শুয়ে শুয়ে রাজামশাইয়ের খালি গোঁফের চিন্তা, ঘুম আর আসে না। অনেক রাতে কখন চোখে ঘুম এসেছিল কে জানে, পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতে দেরি হলো। সকালে গোঁফে তেল দেওয়া লোক দুটোর কান্নায় রাজা মশাইয়ের ঘুম ভেঙে গেল। ধড়ফড় করে উঠে বসে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী রে, এই সাতসকালে কাঁদছিস কেন তোরা?’ লোক দুটো আরো জোরে কেঁদে উঠে বলল, ‘রাজামশাই, আপনার দুটো গোঁফই নেই।’ ‘তাই নাকি বলে রাজামশাই গোঁফে হাত বুলিয়ে দেখেন সত্যিই তো, দ্বিতীয় গোঁফটাও নেই! শুনে রানিমায়ের কান্না আরো বেড়ে গেল। এদিকে রাজামশাই তো রেগে আগুন। চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, ‘অপদার্থ সব, সামান্য একটা গোঁফ চোরকে ধরতে পারে না। আমার খাস কামরায় চোর ঢুকে চুরি করে নিয়ে চলে যাচ্ছে, আর এরা কিছুই করতে পারছে না! দরকার নেই আমার কাঁড়িকাঁড়ি মোহর খরচ করে এই অপদার্থগুলোকে পুষে।’ বলে একে একে চর, সেনাপতি, চাকর-বাকর সক্কলকে বিদায় করলেন। শেষে মন্ত্রীকে ডেকে বললেন, ‘একদিনের মধ্যে যদি গোঁফ চোরকে হাজির না করতে পারো তো তোমারও ছুটি, এই বলে দিলাম।’ রাজসভায় ফিরে এসে চাকরি যাওয়ার চিন্তায় মন্ত্রী মাথায় হাত দিয়ে বসে বসে ভাবতে লাগল এখন কী উপায়, কী করা যায়? ভাবতে ভাবতে শেষে একটা মতলব মাথায় এলো। বাইরে গিয়ে চতুর্দিকে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন যে রাজামশাইয়ের গোঁফ চোরের সন্ধান দিতে পারবে তাকে এক শ মোহর পুরস্কার দেওয়া হবে।

সারা দুপুর গড়িয়ে গেল, কারো দেখা নেই। হতাশ মনে মন্ত্রী মশাই রাজসভায় মাথায় হাত দিয়ে বসে বসে ভাবছে আর বুঝি শেষ রক্ষা হলো না, রাত পোহালেই তার চাকরি নট। বিকালবেলা হঠাৎ হাতে একটা ছোট লাঠি আর কাপড়ের থলি নিয়ে ছেঁড়া কাপড় পরা, ধুলা মাখা পায়ে একটি রাখাল ছেলে এসে হাজির। বলল, ‘চোর রাজপ্রাসাদেই আছে, আমাকে এক শ মোহর দিলে আমি চোর ধরে দিতে পারি।’ মন্ত্রী ছেলেটিকে দেখে আশ্চর্য হলো। পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে নিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘মশকরা করছিস নাকি? প্রাসাদে এত লোকলস্কর কিছু করতে পারল না, আর তুই এই পুঁচকি লাঠি দিয়ে ধরবি চোর?’ কিন্তু আর কোনো উপায় না দেখে শেষে বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, ধর চোর। কিন্তু বলে দিলাম চোর ধরতে না পারলে তোর গর্দান যাবে।’ ‘ঠিক আছে, তাই গর্দান নিও’ বলে ছেলেটি কাজে লেগে গেল। রাতে ছেলেটি হাল্কা আলো জ্বালিয়ে রাজার বিছানার পাশে ঘরের এক কোণে বসে রইল। রাজাকে বলল, ‘আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমান, সকালে উঠে দেখবেন বমাল চোর আপনার কাছে হাজির।’ ছেলেটির কথা শুনে রাজামশাইয়ের হাসি পাচ্ছিল। তবু ভাবলেন দেখাই যাক না এর কেরামতি। ‘ঠিক আছে’ বলে খেয়েদেয়ে রাজামশাই চললেন ঘুমাতে।

সকাল হতেই বিছানায় উঠে বসে হাই তুলে রাজামশাই দেখলেন ছেলেটি বসে তার দিকে চেয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। ‘কীরে, চোর কোথায়?’ রাজামশাইয়ের প্রশ্নে ছেলেটি উঠে এলো। তার এক হাতে কালো মতো কিছু একটা জিনিস মুঠো করে ধরা, আর অন্য হাতে লেজ ধরে ঝোলানো একটা ইঁদুর। বলল, ‘এই নিন আপনার চুরি যাওয়া গোঁফ জোড়া, আর এই হলো গোঁফ চোর।’ রাজামশাই আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘এটা কীরকম? ইঁদুর কী করে আমার গোঁফ চুরি করল? খুলে বলতো বাপু ব্যাপারখানা কী?’ রাখাল ছেলে বলল, ‘ঘটনাটা শুনেই বুঝেছিলাম এ কোনো দুপেয়ের কাণ্ড নয়, আর বাইরের কারো নয়, ভেতরেরই কোনো চারপেয়ের কাণ্ড। কাল মাঝরাতে হঠাৎ দেখি এই চোর বাবাজি এদিক-ওদিক শুঁকেশুঁকে এসে বিছানায় উঠে আপনার মাথার কাছে ঘুরঘুর করছে। শেষে আপনার মুখের কাছে গিয়ে বসে মুখ তুলে আপনার নাকের দিকে খানিকক্ষণ দেখল। তারপর আস্তে আস্তে নেমে এসে ঘরের কোণের দিকে যেতে লাগল। আমিও পেছন পেছন গেলাম। আমার আসা টের পেয়ে ব্যাটা সুড়ুৎ করে পুরোনো রাজপোশাকের তোরঙ্গটার মধ্যে ঢুকে গেল। বুঝতে পারলাম এই হলো সেই চোর, তেল মাখানো গোঁফ দেখে আর লোভ সামলাতে পারেনি, খাবার জিনিস ভেবে কেটে নিয়ে গিয়েছে। আস্তে আস্তে তোরঙ্গটা খুলেই দেখি আপনার গোঁফজোড়াটার পাশে বাবু চুপটি করে বসে। কায়দা করে ব্যাটাকে ধরে ওই থলিটার মধ্যে রেখে দিয়েছিলাম, আর তোরঙ্গের ভেতর থেকে বের করে আনলাম গোঁফজোড়াটা।’ রাজামশাই চোর আর গোঁফজোড়া পেয়ে তো মহাখুশি। বললেন, ‘এই রাখাল ছেলেটার যা বুদ্ধি, এতগুলো মস্তমস্ত মন্ত্রী-সান্ত্রীদের তা নেই। বেকার এদেরকে পোষা।’ বলে সব্বাইকে রাজপ্রাসাদ থেকে বিদায় করলেন, আর রাখাল ছেলেকে করে দিলেন নতুন মন্ত্রী।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close