আরাফাত শাহীন
মা পাখি
মা পাখিটা বাসা ছেড়ে উড়াল দিতেই কিচিরমিচির করে ডেকে ওঠে ছানারা। ছানাগুলো কিছুতেই চায় না মা পাখিটা ওদের ছেড়ে দূরে কোথাও যাক। ভীষণ ভয় করে ওদের। কিন্তু মা পাখিটার কোনো উপায় নেই। বাইরে গিয়ে খাবার খুঁজে নিয়ে না এলে বাচ্চাদের সে খাওয়াবে কী! এভাবে ওদের ফেলে রেখে যেতে মা পাখিটারও খুব কষ্ট হয়। ওদের বাবা বেঁচে থাকলে কোনো সমস্যাই ছিল না। একজন খাবার আনতে গেলে অন্যজন বাসায় থেকে ছানাদের দেখাশোনা করতে পারত। কিন্তু সে কপাল কি আর ওদের আছে!
ছানাগুলো যেদিন ডিমের খোসা ভেঙে বাইরের আলো-বাতাসের মুখ দেখল, ঠিক সেদিনই কোথায় যেন হারিয়ে গেল বাবা পাখিটা। সকাল হলেই সে মা পাখিকে ডেকে বলল, ‘আজ আমাদের ছানারা বাইরে বের হয়ে আসবে। ওদের জন্য পৃথিবীর প্রথম খাবারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তুমি ডিমে ঠিকমতো তা দাও। আমি গিয়ে কিছু খাবার জোগাড় করে আনি।’ ‘দূরে কোথাও যেও না। কাছে-পিঠে গিয়ে খাবার নিয়ে দ্রুত ফিরে এসো।’ লম্বা ডানা দুটি হাওয়ায় ভাসিয়ে বাবা পাখিটা খাবারের খোঁজে বেরিয়ে গেল।
বাবা হারানোর পর বেশ কয়েক দিন কেটে গেছে। এই কদিনে মায়ের আনা খাবার খেয়ে বেশ নাদুসনুদুস হয়ে উঠেছে ছানাগুলো। তবে মা পাখিটা যখন বাসা ছেড়ে খাবার আনতে চলে যায়, তখন ওদের বড্ড ভয় করে। মা না থাকার সুযোগে কেউ যদি ওদের ছোঁ মেরে নিয়ে চলে যায়! আজ মা পাখিটা চলে যাওয়ার পর ওদের সবারই কমবেশি ভয় করে ওঠে। পাখির ডিম সবগুলো একসঙ্গে ফোটে না। ফলে ছানাদের মধ্যেও ছোট-বড় থাকে। একেবারে ছোট ছানাটি কান্না করে বলে ওঠে, ‘মা এখনো বাসায় ফিরে আসছে না কেন? আমার ভীষণ ভয় করছে।’ ‘চুপ। কান্না বন্ধ করো। মা এখনই ফিরে আসবে।’ ধমক মারে সবচেয়ে বড় ছানাটা। বাকিরা চুপ করে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে ভয় পেয়ে চেঁচামেচি করলেই বরং সমস্যা। বড় ছানাটির ধমক খেয়েও ছোটটির কোনো ভাবান্তর নেই। তার কান্নার শব্দ বেড়েই চলেছে। বড় পাখিটা আবার বলে, ‘এভাবে চিৎকার করে কাঁদতে থাকলে সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না। শিকারি কোনো পাখির শব্দ শুনে এসে ছোঁ মেরে আমাদের তুলে নিয়ে যেতে পারে। সেদিন মা বাজপাখির গল্প বলেছিল, মনে নেই?’ বাজপাখির কথা শুনে ছোট ছানাটি একদম চুপ হয়ে যায়। মা পাখিটা ওদের বাজপাখির গল্প শুনিয়েছে। বাজপাখি হলো ছানাদের সবচেয়ে বড় শত্রু। সুযোগ পেলেই সে ওদের ধরে নিয়ে যাবে।
দুপুর গড়িয়ে গিয়ে বিকালের রোদ এসে পড়েছে ছানাদের মুখে। খিদেয় সবাই বড্ড কাতর। মায়ের ফিরে আসতে তো এত সময় লাগার কথা নয়! সেই কখন খাবারের সন্ধানে বেরিয়েছে। ছানাগুলো অধৈর্য হয়ে ওঠে। ছোট ছানাটি আর চুপ করে থাকতে না পেরে বলে ওঠে, ‘মা এখনো কেন ফিরছে না? ক্ষুধায় আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তোমাদের কষ্ট হচ্ছে না?’ সবাই একযোগে বলে, ‘হ্যাঁ।’ ‘মা ফিরে না আসায় আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। কোনো বিপদ-আপদ হলো নাকি আবার?’ ছানারা সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ে। চিন্তার অবশ্য কারণও আছে। এখনো ওদের কারো পাখা গজায়নি ঠিকমতো। উড়তে পারে না কেউই। বাবা নেই; মা ছাড়া ওরা একেবারেই অসহায়। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে শুরু করেছে। সারা দিন না খেয়ে থেকে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ছানারা। এমন সময় বাসায় ডানা ঝাঁপটানোর আওয়াজ পেয়ে ধড়মড় করে জেগে ওঠে ওরা; চোখ পিটপিট করে তাকায়।
বাসায় ওদের মা ফিরে এসেছে। মায়ের এমন বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত চেহারা কখনো দেখেনি ওরা। মা হয়তো ভয়ানক কোনো বিপদ পাড়ি দিয়ে এসেছে। ভয়ে ওরা কেউ কথা বলতে পারে না। ‘কী হয়েছে মা? তোমাকে এমন বিপর্যস্ত দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।’ একেবারে ছোট ছানাটি বলে ওঠে। মা ওর দিকে তাকায়। বুকটা ছটফট করে ওঠে তার। ফুটফুটে ছানাগুলো সারা দিন না খেয়ে থেকে কেমন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। মা পাখিটা বলতে শুরু করে, ‘আজকাল কাছে-পিঠে খাবার পাওয়া খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। আমাকে খাবার খুঁজতে যেতে হয়েছিল দূরের মাঠে। আমার সঙ্গে আরো অনেক পাখি ছিল। তারাও খাবারের খোঁজে বেরিয়েছিল। মাঠে গিয়ে বেশ ভালো খারারই পেলাম। আমি পেটপুরে খেয়ে তোদের জন্য খাবার নিয়ে ফিরতে শুরু করলাম। মাঠের মাঝামাঝি আসতেই বিপত্তি। কিছু দুষ্টু লোক জাল পেতে রেখেছিল। আমি সোজা গিয়ে জালে আটকা পড়লাম।’ মায়ের গল্প শুনে আঁতকে ওঠে সবাই। ছোট ছানাটি প্রশ্ন করে, ‘তুমি জাল দেখতে পাওনি?’ ‘না। একদমই না। জালের সুতো এতটাই মিহি যে দেখতে পাওয়া যায় না। আরো অনেক পাখি আটকা পড়ে আছে।’ ‘তাহলে তুমি কীভাবে বের হয়ে এলে?’ তর সইছে না ছোট ছানাটির। বড্ড ছটফটে সে। মা পাখিটা ছোট ছানাটির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘মানবজাতির মধ্যেও কিছু ভালো মানুষ রয়েছে। একটা ছোট্ট শিশু আমাকে আলতো করে জাল থেকে ছাড়িয়ে দিল। যতক্ষণ আটকে ছিলাম, শুধু তোদের কথা মনে পড়েছে। সারা দিন না খেয়ে খুব কষ্ট পেয়েছিস তোরা। ফেরার পথে তোদের জন্য আর খাবার আনতে পারিনি। একটা রাত তোরা না খেয়ে কাটাতে পারবি না?’ ‘অবশ্যই পারব। তুমি ফিরে এসেছো এতেই আমরা খুশি। তুমি না থাকলে আমরা কিছুই করতে পারি না।’ ছানাগুলো সমস্বরে বলে ওঠে। পরদিন ভোরেই মা পাখিটা ওদের জন্য খাবার নিয়ে আসে। ছানাগুলো পেটপুরে খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে।
"