কাগজের নৌকা
সানজিদা আকতার আইরিন
আজ নতুন ফ্ল্যাটে উঠেছে এনিরা। তবু তার মন ভালো নেই। মা-বাবা নতুন ঘরদোর, আসবাব গোছাতে ব্যস্ত। দক্ষিণ জানালার পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে আকাশ পানে চেয়ে আছে এনি। মেঘের আড়ালে কোথায় লুকিয়ে আছে দাদাভাই। যদি একবার দেখা মিলত। চোখ থেকে কষ্টের জল গড়িয়ে পড়ল এনির।
এনির দাদার মৃত্যুর পর দাদি ছোট চাচার সঙ্গে প্রবাসে থাকেন। আবাসন ব্যবস্থা উন্নত করতে এনিদের বাড়িটি দেওয়া হয় বিল্ডার্স কোম্পানিকে। ঢাকার বুকে এনির দাদা-দাদির স্বপ্নের বাড়িটি ছিল ছবির মতো। নানা ফুল আর ফলে ভরা ছিল সেখানে। ডাসা পেয়ারা আর সতেজ কামরাঙায় মন কেড়ে নিত সবার। এ বাড়ির লালছে করমচা আর মিষ্টি চালতার স্বাদ ছিল সবার চেনা। সতেজ পাতার ফাঁকে তাজা সবজির বাড়াবাড়ি ফলন দেখেই বোঝা যেত কত যতেœর বাগান এটি। এনির দাদি প্রতিবেশী আর আত্মীয়দের এসব বিলিয়ে তৃপ্তি পেতেন। গোলাপ আর চাঁপার হাসিতে ঝলমল করত বাড়িটি। রাতের বেলা হাসনাহেনার গন্ধমাখা হাওয়ায় দুলে ঘুমের পরী স্বপ্ন লেপে দিত এনির চোখের পাতায়। এ বাড়ির মাটি আর প্রকৃতির মাখামাখিতেই হাঁটতে শিখেছে এনি। ঢাকায় জন্মে ও সবুজের মমতায় বেড়ে ওঠা তার। প্রকৃতির চাদরে জড়ানো আবেশটুকু শক্তি ছিল তার বড় হওয়ার। তাই এই বাড়িটিই ছিল এনির স্বর্গরাজ্য। গত চার বছর আগে বাড়িটি যখন ছেড়ে যায়, কষ্টের কালো চাদরে ঢেকে যায় এনির মন। ঘাসফড়িংয়ের সঙ্গে খেলা করা ফোকলা দাঁতের এই মেয়েটির বয়স তখন ছয়।
চার বছর ধরে ডানা ঝাপটানো ব্যাকুলতায় কিছুতেই ভালো থাকে না এনির মন। তাই এই বাড়িটির নতুন ফ্ল্যাটে উঠে হৃদয় কেঁদেই চলছে তার। সবুজেঘেরা বাড়িটি লুকিয়ে আছে তার মনের গভীরে। ফ্ল্যাটের বারান্দার দক্ষিণা বাতাসেও তার হৃদয় স্পর্শ করে না। জানালার অনাবিল প্রশান্তির হাওয়া, রোদ আর আলোর মায়াময় খেলা তাকে শান্ত করে না কিছুতেই। চকচকে নতুন ফ্ল্যাটে ভীষণ এক আভিজাত্যের ছাপ। বাবা-মায়ের দীর্ঘদিনের নিগূঢ় পরিকল্পনায় বেশ দামি হয়ে উঠেছে ফ্ল্যাটটি কিন্তু এনির কাছে এসব নিষ্প্রাণ মেকি মনে হয়। এত সুন্দর পরিপাটি গোছানো বাসা পেয়েও তার হৃদয় খুঁজে ফেরে সেই দাদির যতেœ সাজানো সবুজ পাতার মায়াময় ঘ্রাণ। দাদা ভাই বেঁচে থাকলে বাড়িটি আগের মতোই থাকত হয়তো। দাদাভাইয়ের কথা মনে হতেই আবার ভিজে উঠে এনির চোখ। কঠিন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে এনি হারাল দাদা-দাদির আদর। সুদূর প্রবাসে থাকা দাদির চুম্বনটুকুও আজ আটকে যায় দূর আলাপন যন্ত্রের পর্দায়, যা তার স্নেহের ক্ষুধা বাড়িয়ে দেয় বহু গুণ। বিকালে যখন ছোট ভাইকে নিয়ে ছাদে যায় এনি, আশপাশের বাড়িগুলোকে অনেক ছোট মনে হয়। কত উঁচু তাদের বাড়ি অথচ চার বছর আগেও তাদের বাড়ির তুলনায় ওগুলো ছিল বিশাল বড়। মায়ামাখা রোদে পাকা উঠানে যখন ভাই-বোন নিয়ে এনি খেলা করত, আশপাশের বড় বড় বাড়ির জানালা দিয়ে ছেলেমেয়েরা চিড়িয়াখানায় আটকে থাকা প্রাণীদের মতো দেখত তাদের। এনির খুব ভালো লাগত। নিজেকে খুব স্বাধীন মনে হতো। কিন্তু আজ সেও সুন্দর খাঁচার বন্দি পাখি। স্বপ্ন আকাশে ওড়ার পথ বন্ধ। নিষ্ঠুর কঠিন ইমারতগুলো কেড়ে নেয় তার মতো হাজারো শিশুর সবুজ শিশুকাল।
ছোট্টবেলার বাড়িটিতে পাতার ফাঁকে চালতার সাদা ফুলের উঁকি দেওয়ার সুখে গাছটির অহংকার যেন বেড়ে যেত বহু গুণ। কদমগাছের বড় ডালে জঞ্জাল কাকের বাসা দৃষ্টি এড়াত না কারো। বসতরত কাকেরা কা-কা আলাপনে কান ঝালাপালা করে দিত। চৈতালি দুপুরের হাওয়ায় ভেসে আসত আমের মুকুলের গন্ধ। গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে কচি আম কুড়িয়ে খেলা করা সেদিন এনির জীবনে ফিরবে না আর কখনো। পাখির আধখাওয়া ফলে সয়লাপ গাছের তলায় ঘুরে ঘুরে পেয়ারা আর কাঠবিড়ালির মিতালি দেখে ফোকলা দাঁতে এনি হেসেছে কতবার। তাকে দেখে কতবার কত বেজি দৌড়ে পালিয়েছে গর্তের কোণে, তার কোনো শেষ নেই। লাউ-কুমড়ার পাতার ফাঁকে ছোট্ট চড়–ইয়ের শিকার খোঁজা, কিংবা পাতার গায়ে লেগে থাকা বর্ষার জল টুপ করে মাটিতে ঝরে পড়া এসব এখন এনির চোখের ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। লাউডগা কেটে রান্না করে আদর করে কোলে বসিয়ে খাওয়াতেন দাদি। বিরক্ত লাগত খেতে, তবু দাদির আদরে সোনামুখ করে খেয়ে নিত সব। আজ লাউয়ের ডগার সেই স্বাদ আর কোথায় পাবে এনি? জবাগাছের কালো পিঁপড়ার কামড় উপেক্ষা করেও ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথত সে। বাবার কাছে বায়না ধরত লিচুর ডালের ছোট্ট টুনটুনির ছানা দেখার। এসবই এখন স্মৃতির খাতায় আঁকা ছবি। শুকনো পাতাগুলো যেমন ফুরফুর করে বাতাসে উড়ে বেড়াত, ঠিক তেমনি এনির মনের বাতাসে এখনো উড়ে সেই বাড়িটির এঁদো মাটির সোদা গন্ধ। আজ এই ফ্ল্যাটের নিষ্প্রাণ ইট, রড আর বালুর নিচে চাপা পড়েছে এনির সোনালি শিশুকাল।
আজ তপ্ত ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে বহু দূর দেখা যায় বটে, তবে এনির স্মৃতির পাতায় আঁকা সেই রূপময় বাড়িটি কোমল হৃদয়ে হাহাকার জাগায়। নরম মাটির বুক চিড়ে বেড়ে ওঠা এই দৈত্য বাড়িটি কেড়ে নিয়েছে এনির ছোট্ট উঠানটুকু। যেখানে মায়াবি চাঁদ জোছনার চাদর বিছিয়ে দিত সারা রাত। বারবার মনে হয় কি, এমন যদি থাকত ওই ছোট্ট বাড়িটি, যেখানে নরম কাদায় সবুজ ঘাসে পা টিপে টিপে হাঁটত এনি। খুব কি ক্ষতি হতো যদি থাকত জানালার ফাঁকে কাঠবিড়ালির লুকোচুরির খেলা? নাইবা হতো অট্টালিকা, তবু থাকত সিক্ত ঘাসে লাল-কমলা শিউলির লুটোপুটি। কিংবা যত্রতত্র বেড়ে ওঠা আগাছার বাড়াবাড়ি। থাকত তবু চড়–ই পাখির ফুড়–ত ফুড়–ত আনাগোনা। অথবা রাতে গাছের ডালে জ্বলজ্বলে চোখের লক্ষ্মীপ্যাঁচার ডাক।
প্রবল বর্ষায় আটকে থাকা পানিতে কাগজের নৌকা ভাসিয়ে মনে মনে দেশ-বিদেশে ঘুরত এনি। জলে ভিজে নৌকা উল্টে গেলে চোখের জলে বুক ভাসত তার। তখন ধৈর্য নিয়ে মা আবার কাগজের ভাঁজে বুনে দিতেন স্বপ্নের বীজ। আবার নৌকা ভাসত। মায়ের মমতায় বানানো কাগজের নৌকায় স্বপ্নের দেশে আর কোনো দিন যাওয়া হবে না এনির। দশতলা দানব বাড়িটি কেড়ে নিল তার স্বপ্নের নিলয়, শিশুবেলার সুখ। আজ এখানে প্রাচুর্য আছে ঠিকই, সবুজ আর মাটির মাখামাখিটুকু নেই মোটেই। যখন-তখন প্রজাপতির পেছনে ছুটে বেড়ানো এনির হৃদয়ে এখনো ভেসে বেড়ায় সেই কাগজের নৌকা।
"