reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

ঘরে বসেই স্বাবলম্বী সাবিকা

উচ্চশিক্ষা নিয়েও অনেক নারী চাকরি করার ফুসরত পান না। পড়াশোনা শেষ করে তারা সংসার সামলান। ফলে চাকরি করে স্বাবলম্বী হওয়ার যে স্বপ্ন সেটা অধরাই থেকে যায়। কিন্তু কিছু কিছু নারী আছেন যারা অদম্য। স্বামী, সংসার, সন্তানদের দেখভাল করেও তারা ঘরে বসেই স্বাবলম্বী হতে চান। মেধাকে কাজ লাগিয়ে নিজের চেষ্টায় হয়ে ওঠেন অনুকরণীয়। এদেরই একজন মাহমুদা ইয়াসমিন সাবিকা। যিনি ঘরে তৈরি করা খাবার অনলাইনে বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। এমনই একজন সফল নারী উদ্যোক্তার গল্প জানাচ্ছেন মো. মাসুদ হোসেন

বগুড়া সদর উপজেলার দত্তবাড়ি এলাকার মেয়ে মাহমুদা ইয়াসমিন সাবিকা। দুই ভাই-বোনের মধ্যে ছোট সাবিকা ২০১৩ সালে এসএসসি পাস করেন নিজ এলাকার কাটনার সেন্ট্রাল বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে। পড়াশোনার একপর্যায়ে অনার্স তৃতীয় বর্ষে থাকাকালীন ২০১৮ সালে পছন্দের এক বেকার ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। কর্মহীন ছেলেকে বিয়ে করায় মেনে নেয়নি সাবিকার পরিবার। এর মধ্যে তাদের দুজনের সাংসারিক জীবন কাটাতে হচ্ছে অর্থসংকটের মধ্য দিয়ে। স্বামীর বেকারত্ব আর সাংসারিক খরচ মেটাতে না পেরে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান পড়াশোনা জানা এই নারী। কোনো উপায় না পেয়ে শখের বসে খাবারের ওপর প্রশিক্ষণ নেওয়া ব্যবসা করার ইচ্ছে জাগে তার। বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে খাবারের প্রচার শুরু করে দেন তিনি। হঠাৎ এক দিন সবজি শিঙাড়ার অর্ডার পান এই নারী। মায়ের কাছ থেকে ধার নেওয়া ৪০০ টাকা দিয়ে শুরু করেন শিঙাড়া তৈরির কাজ। দ্রুত সময়ে রুচিসম্মত এই খাবারটি ডেলিভারি দিয়ে প্রশংসিত হন ক্রেতার কাছ থেকে। ২০১৯ সালে শুরু করা ব্যবসার কয়েক মাস পর সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও নেমে আসে মহামারি করোনা ভাইরাস। সাবিকার এই ব্যবসার প্রচার যখন বগুড়বাসীর কাছে পৌঁছাতে থাকে তখন নিজ পরিবার, আত্মীয়স্বজনসহ প্রতিবেশীরা বিষয়টি ভিন্ন চোখে দেখত। সাহস জোগানোর পরিবর্তে কটূক্তি করতে থাকে সবাই। বেকার স্বামীর অনুপ্রেরণায় ঘরবন্দি এ সময় দুজনে মিলে ব্যবসার পরিধি বাড়াতে থাকেন তারা। একসময় সাবিকার এই ব্যবসার লভ্যাংশ থেকে চলতে থাকে তাদের দুজনের সাংসারিক জীবন। করোনা পরবর্তী সময়ে দেশ যখন কিছুটা স্বস্তিতে ফিরে আসে তখন একটি কোচিং সেন্টারে ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন সাবিকার স্বামী ওমর ফারুক।

খাবারের ওপর টিএমএসএস থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করা শখের ব্যবসার জন্য প্রথমে ৯ হাজার ও পরে ৫০ হাজার টাকা সরকারি অনুদান পান এই নারী উদ্যোক্তা। ক্রমান্বয়ে তার ব্যবসার এমন সফলতায় পরিবারসহ সবাই খুশি। এর মধ্যে বগুড়া আজিজুল হক কলেজ থেকে সমাজকর্মের ওপর মাস্টার্স পাস করেন সাবিকা। ংধনরশধ’ং ভড়ড়ফ ঝযড়ঢ় নামে প্রায় ৫ হাজারের ফলোয়ারের ফেসবুক পেজে চলে তার ব্যবসার চাকা। কাস্টমাইজ দেশি খাবার, পোলাও, বিরিয়ানি, খিচুড়ি প্যাকেজ, বিভিন্ন স্ন্যাকস আইটেম, ডেজার্ট আইটেম, শীতের পিঠা, গরুর মাংসের আচারসহ প্রায় ৩০ ধরনের খাবার নিয়ে কাজ করছেন এই নারী। তার এই ব্যবসায় নিয়োজিত আছেন ৬ জন সহযোগী। শূন্য থেকে উঠে আসা শিক্ষিত এই নারী উদ্যোক্তা এখন প্রতি মাসে আয় করছেন প্রায় ৪৫ হাজার টাকার মতো। হোমমেড খাবার তৈরি করে এবং যথাসময়ে ভোক্তার কাছে পৌঁছে দিয়ে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছেন বগুড়াবাসীর কাছে। বিভিন্ন মেলায় অংশগ্রহণ করে অর্জন করেছেন সম্মাননা। খাবারের ওপর প্রায় ৮-১০টি প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে ঘরে বসেই ব্যবসা করছেন সাবিকা। মেয়ের এমন সাফল্যে গর্বিত বাবা নাসিমুল গনি। মেনে নিয়েছেন তাদের বিয়ে।

সফলতার পেছনে তার ব্যর্থতার কথা তুলে ধরে মাহমুদা ইয়াসমিন সাবিকা বলেন, ‘এত বছরের ব্যবসায় ব্যর্থতা যেমন ছিল সফলতাও তেমন পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ। তবে অন্য ১০ জন নারীর মতো বিয়ের পর বাচ্চা নেওয়ার পরিকল্পনা নিতে পারিনি আমি। প্রথমে অভাবের সংসার ও পরে স্বাবলম্বী না হতে পারার কারণে এই স্বপ্নকে পিছিয়ে দিতে হয়েছে। কেননা ব্যবসার প্রথম দিকে পরিবারসহ প্রতিটি মানুষের কাছ থেকে পেয়েছি বাধা এবং হতাশামূলক কথা। সামাজিকভাবে প্রথমপর্যায়ে নারী হয়ে এমন কাজ কখনো ভালো চোখে দেখেনি কেউ। কিন্তু বর্তমানে পারিবারিক সব বাধা পেরিয়ে সামাজিকভাবেও অনেক সম্মান পাচ্ছি।’

সাবিকা বলেন, ‘ব্যবসাটা শুরু করি মাত্র ৪০০ টাকা দিয়ে। অথচ গত ছয় বছরে এত ভালো বিক্রি হবে তা ভাবিনি। এ পর্যন্ত রিপিট কাস্টমার পেয়েছি হাজারের বেশি। তবে বিজনেসটা শুরু করেছিলাম একটা স্বপ্ন থেকে শখের বশেই। প্রথম যেদিন নিজহাতে বানানো খাবার কাস্টমারের হাতে পৌঁছে দিই, সেই অনুভূতিটা ছিল অসাধারণ। কাস্টমারের কাছ থেকে পাওয়া ফিডব্যাক ছিল কাজের প্রতি অনেক বড় অনুপ্রেরণা। নিজ হাতে রান্না করে প্রথম উপার্জন ছিল সামান্য। সেই সামান্য উপার্জন আমার কাছে অনেক বড় পাওয়া। আগে বাবার পরিচয়ে বড় হয়েছি, এখন নিজের পরিচয়ে সমাজে আরো বড় হতে চাই। হোমমেড খাবারের জগতে একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে আরো বড় বড় স্বীকৃতি অর্জন করতে চাই।’ অন্যরকম কিছু করার ইচ্ছে নিয়েই ছোট থেকে বেড়ে ওঠা এই নারী উদ্যোক্তা আরো বলেন, ‘অনেকের ইচ্ছাই থাকে পড়াশোনা শেষে চাকরি করবে কিন্তু আমার কখনো চাকরি করার ইচ্ছা জাগেনি। চারপাশে হাজারো মানুষের চাকরির জন্য দিনরাত পড়াশোনা এবং আর্তনাদ দেখে চাকরির ওপরে আগ্রহ হারিয়ে গিয়েছে। পরিবার থেকে চাকরির কথা বললেও ব্যবসা শুরুর পর আর কখনো চাকরির দিকে তাকাতে হয়নি। এ ছাড়া নারীদের আত্মসম্মানহীন ঘটনার কথা চিন্তা করে বাড়ির বাইরে গিয়ে কাজ করার মানসিকতাও আমার নেই। ঘরে বসেও যে একজন নারী ভালো ইনকাম এবং সব ধরনের প্রয়োজন পূরণ করতে পারে তার উদাহরণ আমি নিজেই।’

দেশের বেকার সমস্যা নিরসনে মাহমুদা ইয়াসমিন সাবিকা বলেন, ‘বেকার সমস্যা নিরসনে সরকার যথেষ্ট সুযোগ ও সব ধরনের সহায়তা করছে এবং অনেকগুলো সেক্টরে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। যার যে বিষয়ে ভালো লাগে, সে সেটিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষ হয়ে কাজে নেমে পড়তে পারে। তবে আজ কাজ শুরু করলাম, আগামীকাল লাভবান হব, এমন নয়। কমপক্ষে এক বছর লেগে থাকতে হবে এবং নিজেকে একজন দক্ষ কর্মী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। অন্যের ওপর ভরসা করা যাবে না। নিজে চেষ্টা করলে, আমার মনে হয়, অসাধ্য বলে কোনো কিছু নেই।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close