মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
পম্পি নন্দীর জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার গল্প
কণ্ঠনালির ক্যানসারে তার স্বামী মারা যায়। ছয় বছরের একটি শিশুসন্তান রেখে। স্বামী হারিয়ে পম্পি নন্দী তখন খুব একা। অসহায় এক নারী। হাতে টাকাপয়সা নেই মোটেই। আর ১০টা নারীর মতো এ অবস্থায় তিনি ভেঙে পড়েননি। নিজেকে যোগ্য করে তুলেছেন। কর্মক্ষেত্র খুঁজে নিয়েছেন। জীবন সংগ্রামে তিনি জয়ী এক নারী। তার জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়ার গল্প আজ অন্য নারীর জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে।
পম্পি এক দিন বান্ধবীদের নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছিলেন। সেখানেই এক বৃদ্ধের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়। এরপর বিভিন্ন সময় টুকটাক কথাবার্তা হতো। সেই বৃদ্ধই প্রস্তাব পাঠালেন, তার ছেলের সঙ্গে পম্পির বিয়ের। পম্পি তখন পড়াশোনা করে। তার বাবা বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। মধ্যবিত্ত পরিবার। কিন্তু ছেলেপক্ষ বেশ পয়সাওয়ালা। কলকাতায় বাড়ি আছে। পম্পি বলেন, প্রথমে মায়ের আপত্তি ছিল এ বিয়েতে। পরে অবশ্য রাজি হন। ১৯৯৮ সালের আগস্ট মাসের ১২ তারিখে পম্পির বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ে হলেও পম্পির পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ছিল। বিয়ের পরে কলকাতা স্বামীর কাছে চলে যান তিনি। সেখানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়েন তখন। প্রথম সন্তান আসার সুখবর পান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি মৃত সন্তান প্রসব করেন।
পম্পি বলেন, সন্তান হারানোর পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। স্বামী তখন পাশে এসে দাঁড়ায়। দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নিই পড়াশোনা শেষ করার পর বাচ্চা নেব। ২০০৬ সালে পম্পি সফলতার সঙ্গে মাস্টার্স শেষ করেন। ২০০৬ সালের শেষের দিকে পম্পি আবার মা হন। স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে তখন তিনি বাংলাদেশে থাকেন। সুখেই কাটছিল তাদের দিনগুলো। কিন্তু হঠাৎ এক দিন তার স্বামীর দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত পড়া শুরু হয়।
পম্পি বলেন, শুরুতে ভাবছিলাম ও কিছু না। ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খেতে দিই। কিছুদিন পর আবার রক্ত পড়া শুরু হয়। স্বামীকে চিকিৎসা করাতে মুম্বাই নিয়ে গেলেন। ক্যানসার ধরা পড়ল। পম্পির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। ডাক্তার কোমোথেরাপি দিলেন। পম্পি বললেন, আমি একাই স্বামীকে নিয়ে বাংলাদেশ থেকে ছোটাছুটি করেছি। একটি মানুষও পাশে ছিল না। বিপদের সময় আপনজনও যেন আর আপনজন থাকেনি। ডাক্তার জানালেন, ছোট-বড় প্রায় ৯টি টিউমার হয়েছে। টিউমার অপসারণ করা হলেও পম্পির স্বামী আর বেঁচে থাকেননি। ক্যানসার ধরা পড়ার মাত্র তিন মাসের মধ্যে পম্পি স্বামীকে হারান।
পম্পি বললেন, স্বামীকে হারিয়ে যখন বাংলাদেশে চলে আসি। তখন সত্যিকার অর্থে আমি স্বামীহারা এক অসহায় নারী।
স্বামীর শেষকৃত্য শেষ করে পম্পি দেশে ফিরলেন। সঙ্গে ছোট্ট শিশুসন্তান। হাত একদম খালি। স্বামীর চিকিৎসায় তিন মাস সতেরো দিনে তিনি খরচ করেন প্রায় বারো লাখ টাকা। শ্বশুরবাড়ির লোকজন তার ফিরে আসাটা ভালোভাবে নেননি। কেউ কেউ তাকে আড়ালে-আবডালে অপয়া বলল। যেন স্বামীর মৃত্যুর জন্য তিনিই দায়ী। পম্পি বলেন, এক দিন হাউমাউ করে কাঁদছিলাম। তখন ছেলে জড়িয়ে ধরে বলে, মা তুমি এভাবে কান্না করো কেন। ছেলের এ কথা পম্পিকে প্রচন্ড নাড়া দিল। তিনি ভাবলেন, ছেলেকে মানুষ করতে হলেও তাকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। বিভিন্ন জায়গায় চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিলেন। এক দিন ক্লিফটন গ্রুপের এক জিএমের বউয়ের সঙ্গে তার দেখা হলো। তিনি পম্পিকে ক্লিফটন গ্রুপে চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেন। পম্পি ক্লিফটন গ্রুপে এইচআর কমপ্লেইন্সে এখন কর্মরত। এই গ্রুপে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার নারীশ্রমিক কাজ করেন।
পম্পি বলেন, চাকরিতে জয়েন করে অফিসে বসে প্রায়ই কান্না করতাম। আমি ভাবতাম, আমার মতো দুঃখী এ জগতে কেউ নেই। কিন্তু নারীশ্রমিকদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখলাম। তারা কেউই আমার চেয়ে কম দুঃখী না। কারো স্বামী নেই, কারো সন্তান নেই বা মারা গেছে, কেউবা নির্যাতিত। পম্পি আরো বলছিলেন, এসব নারীশ্রমিক যেন আমার খুব আপন। সব সময় তারা আমার, আমার ছেলের খবর নেয়। আমিও তাদের মাতৃত্বকালীন ছুটি, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন সুবিধা নিশ্চিত করতে কাজ করি। তখন সত্যিই মনটা আনন্দে ভরে যায়। পেছনের জীবনের কথা আর মনেই পড়ে না। পম্পি আজ অনেকের অনুপ্রেরণায় পরিণত হয়েছেন। সব হারিয়েও তিনি নিজেকে ভেঙে পড়তে দেননি।
পম্পি বলেন, আমাদের জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতেই পারে। সে জন্য পিছিয়ে পড়া যাবে না। প্রত্যেকটা নারীকে দাপটের সঙ্গে মাথা উঁচু করে চলতে হবে। কোনো কাজকেই ছোট ভাবা যাবে না। নারীরা যেন শুধু পুরুষের ওপর নির্ভরশীল হয়ে না চলেন। স্বামী বা নিকটতম আপনজন ক্যানসারে আক্রান্ত হলে তাকে মনোবল দিতে হবে। প্রাথমিক অবস্থায় ক্যানসার ধরা পড়লে চিকিৎসা করে দীর্ঘদীন সুস্থ থাকা যায়। একটু ভালো মনে হলে চিকিৎসা বাদ দেওয়া যাবে না। ডাক্তারের পরামর্শ পুরোটাই মেনে চলতে হবে। এসবই হচ্ছে ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের স্বজনদের জন্য পম্পির পরামর্শ।
"