মুহম্মদ রাসেল হাসান
রংতুলির আঁচড়ে গল্প বলেন রিয়া
বর্তমানে পৃথিবীতে সাত হাজারের অধিক ভাষা রয়েছে। ভাব প্রকাশের এত ধ্বনি, শব্দ বা ভাষা অথচ কেউ কেউ প্রকৃতির অবিচারে নির্বাক। আবার কেউ কেউ বাকসম্পন্ন হলেও শ্রবণশক্তিহীন। আর যে এই দুটি শক্তিহীন- তার জগৎটা কেমন! আপাততদৃষ্টিতে এটা বড় বাধা মনে হলেও কেউ তো বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংও হন। সবাই হয়তো স্টিফেন হকিং হন না। হন স্বতন্ত্র, নির্মাণ করেন শিল্প। এমনই এক নাম সুরাইয়া রহমান রিয়া। যার ভাব বোঝার মাধ্যম ইশারা আর গল্প বলার মাধ্যম চিত্রাঙ্কন। স্নিগ্ধ ও রোদ রঙের সুদর্শনা এই তরুণীর ডাগর ডাগর চোখের চাহনিতে সব সময় থাকে দূরদৃষ্টি, বুকে আত্মবিশ্বাস এবং মনে স্বনির্ভর হওয়ার পণ। আর হাতে রংতুলি নিয়ে ক্যানভাসে লিখেন গল্প।
তার এসব গল্পে উঠে আসে প্রকৃতির অর্থবহ চিত্র, উঠে আসে সমাজে সুবোধ জাগরণের আহ্বান। প্রকাশ হয় মনের অব্যক্ত কথা। চিত্রাঙ্কনের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি কিউব ইভেন্টস নামক একটি সংগঠন থেকে স্বাধীনতা দিবস স্বর্ণপদক-২০১১-সহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। ক্রেস্ট ও সনদে এখন তার বাসার আলমারি বলছে, ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই, ছোট সে তরী’। ২০১৬ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঈদ শুভেচ্ছা কার্ডে তার আঁকা ছবি নকশা হিসেবে ব্যবহার করেন এবং তার হাতে এক লাখ টাকা পুরস্কার তুলে দেন।
রিয়া ১৯৯৮ সালের ২৮ জুলাই বগুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা জাহেদুর রহমান ও মা মাসুদা রহমান। দুবছর বয়সে তারা রিয়ার বাক ও শ্রবণশক্তি নেই বলে জানতে পেরে অদ্যাবধি চিকিৎসা করালেও লাভ হয়নি। তবে এই প্রতিকূলতা রিয়াকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে পারেনি। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায়ও তার সাফল্য উল্লেখযোগ্য। প্রাথমিকে বৃত্তিসহ জেএসসি ও এসএসসিতেও তিনি জিপিএ ৫ পেয়েছেন। রিয়া স্থানীয় আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি সম্পন্ন করে বর্তমানে বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজে ভূগোল এবং পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগে শেষ বর্ষে অধ্যয়ন করছেন।
তার সঙ্গে একান্ত লিখিত কথোপকথনে তিনি তার সম্পর্কে মৌলিক অনেক কথা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘চিত্রাঙ্কন বা পেইন্টিং সৃজনশীলমূলক ব্যায়াম হওয়ায় এটি জটিল চিন্তা বা আবেগ প্রকাশ করতে সাহায্য করতে পারে। এই কাজটি ব্যক্তির নিজেকে এবং নিজের ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা, অনুভূতি ও ইচ্ছাগুলো আরো ভালোভাবে বুঝতে সহায়তা করে। মনের যত্নে তাই পেইন্টিং হতে পারে।’ রিয়া মনে করেন, ইচ্ছাশক্তি, আত্মবিশ্বাস এবং পরিশ্রমের সঙ্গে পরিবারের সমর্থন থাকলে কোনো বাক, শ্রবণ বা দৃষ্টিগত অন্তরায় এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।
রিয়ার মা বলেন, ‘ও সবার মধ্যে থাকতে থাকতে ঠোঁট নাড়ানো দেখে অনেক কিছু বুঝে গেছে। ওর জানার খুব আগ্রহ। তিনি আরো বলেন, রিয়া প্রকৃতি দেখতে ও ভ্রমণ করতে খুব ভালোবাসে। একটানা পোশাক কিনে দেওয়ার এবং বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতে বায়না করে। পড়াশোনা করতে করতে এখন সে অনেক বোঝে। আমরা বিয়ের কথা বললে ও না করে। প্রতিষ্ঠিত না হয়ে করবে না বলে।’
রিয়ার আঁকা ছবি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এবং জাতীয় জাদুঘরসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শিত হয়েছে। তার এতসব গুণে মুগ্ধ না হয়ে কেউ পারে না। তিনি জানান, কিছুক্ষণ পরপর অন্য বাড়ি থেকে একটি বিড়াল তার সঙ্গে এসে স্বাচ্ছন্দ্যে খেলা করে, খাবার খায়, আদর নেয়। রবীন্দ্রনাথের সুভা গল্পের সুভার মতোই যেন নির্বাক রিয়া। যার প্রকৃতিপ্রেম এবং বিড়ালের মতো নির্বাক প্রাণীপ্রেমসহ আছে সর্বপ্রাণ প্রেম। যার আপন জগৎ সংকীর্ণ নয়, নিয়মিত পড়া ও কল্পনায় বোধের পরিসর ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। দুটি ইন্দ্রিয় নিষ্ক্রিয় তো কী, তার চেয়েও বেশি যে শুনে ইন্দ্রিয়াতীত শক্তি দিয়ে, তারও প্রবল গল্প যে অনুধাবন করে আর রংতুলি দিয়ে পরিবেশন করে ক্যানভাসে।
"