শাহনাজ খান
দেশের একজন সফল নারী উদ্যোক্তা
নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে দেশের ফ্যাশন পরিমণ্ডলে শুরু হলো এক নারী উদ্যোক্তার নিজস্ব ফ্যাশন হাউসের যাত্রা। ১৯৯৩ সাল তখন। সে সময় মেয়েদের পক্ষে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা চাট্টিখানি কথা ছিল না। সঙ্গে ছিলেন তার জীবনসঙ্গী খালিদ মাহমুদ খান। দেশীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড কে-ক্র্যাফটের স্বত্বাধিকারী শাহনাজ খান। একজন নারী হিসেবে সফল উদ্যোক্তা হওয়ার পথ তৈরি করে কীভাবে দীর্ঘ তিন দশক পার করলেন তিনি, সেই গল্পই জয়িতার পাঠকদের জন্য রইল আজ
শাহনাজ খান বলেন, ‘১৯৯২ সালে বিয়ে হলো আমাদের। ছিমছাম সুন্দর দুজনের সংসার। এর পরের বছরেই ইচ্ছা হলো নিজে কিছু একটা শুরু করি। সে আজ থেকে ৩০ বছর আগের কথা। পরিবার থেকে চাইত পড়াশোনা শেষ করে হয়তো কোনো বড় চাকরিতে ঢুকে যাব। চাকরি করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু বেশ কয়েকটা ইন্টারভিউ দেওয়ার পর মনে হলো নিয়মের বেড়াজালে আটকে আমি চাকরি করব না। নিজের মতো করে কিছু করব।’
শাহনাজ খান জানান, এ ক্ষেত্রে নিজে সৃজনশীল কিছু করার সঙ্গে সঙ্গে অন্যদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরির কথাও তিনি ভেবেছিলেন। জানালেন, পুরোনো দোতলা বাড়ির একতলায় থাকতেন তারা আর নিচের তলাটায় তিনি কে-ক্র্যাফটের শোরুম শুরু করলেন।
নারী উদ্যোক্তা কথাটি আজকে সবার মুখে মুখে ঘুরছে। অনলাইন মাধ্যমের বদৌলতে তা অনেকটা বেড়েছে করোনা মহামারির সময়ে। আর এখানেই এ দেশের নারীদের সৃজনশীলতা পাখা মেলেছে, বলছিলেন শাহনাজ। সবার ভেতরেই কিছু না কিছু সুপ্ত সৃজনশীল প্রতিভা থাকে। তবে বিগত কয়েক বছরে ফ্যাশন খাতে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা বেড়েছে বেশ।
শাহনাজ খানের কাছেই জানা গেল, আজ থেকে ৩০ বছর আগে ফ্যাশন হাউসের ধারণাটি এখনকার মতো এতটা বাণিজ্যিক ছিল না। পোশাকের সঙ্গে সঙ্গে লাইফস্টাইলের বিভিন্ন পণ্যের পসরা থাকবে একটি বুটিকে, ক্রেতারা সময় নিয়ে সবকিছু হাতে ধরে দেখবেন ও কেনাকাটা করবেন- এ রকমই চিন্তা ছিল তার।
শাহনাজ সফল উদ্যোক্তা হতে পেরেছেন শুধু তার প্রবল ইচ্ছাশক্তি, অধ্যবসায় আর ধৈর্যের গুণে। তিনি বলছিলেন, সফল হওয়ার কোনো সংক্ষিপ্ত বা সহজ রাস্তা নেই। তাই এর পূর্বশর্ত হিসেবে প্রয়োজন জানা আর শেখার আগ্রহ। সেখান থেকেই শাহনাজ খান নিজে সেলাই মেশিন চালিয়ে তৈরি করা শিখেছিলেন নানা ডিজাইনের পোশাক। পোশাক তৈরি করতে কোন ফেব্রিক ব্যবহার করবেন, সেই ফেব্রিক কোথায় পাওয়া যায়, কীভাবে তৈরি হয়- সবটা জেনেছেন নিজ আগ্রহে, বললেন তিনি।
নারীর ক্ষমতায়নের সত্যিকারের একটি চিত্র উঠে এলো শাহনাজ খানের গল্পে। অত্যন্ত সন্তুষ্টি নিয়ে তিনি জানালেন, কে-ক্র্যাফটের ৮০ শতাংশ কর্মীই নারী। কেউ নকশার কাজ করছেন, কেউ কাপড় কাটছেন, কেউ সেলাই করছেন। তবে তার কথায়, শুধু নারীরা কাজ করলেই হবে না, সেই সঙ্গে দিতে হবে সুন্দর, স্বাভাবিক নারীবান্ধব পরিবেশ।
কথা প্রসঙ্গে শাহনাজ খান জানান, একজন উদ্যোক্তাকে সবকিছু জেনেই মাঠে নামতে হবে। একজন ফ্যাশন উদ্যোক্তাকে জানতে হবে, তার জামা বানাতে কতটুকু কাপড় লাগছে। তা ছাড়া উদ্যোক্তা যদি নিজে জামা তৈরির পুরো প্রক্রিয়াটা জানেন, তাহলে দর্জিকে ডিজাইন বুঝিয়ে দিতেও সুবিধা হবে। তার মতে, মোদ্দাকথা হলো, যেকোনো কাজেই পড়াশোনার প্রয়োজন রয়েছে। ফ্যাশন খাতে উদ্যোক্তা হতে চাইলে অবশ্যই এর সবদিক সম্পর্কে জানতে হবে, যার চিন্তায়, পণ্য বা সেবার ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য থাকবে। নতুন নতুন কাজ যারা করে যাবেন, দীর্ঘ মেয়াদে তারাই টিকে যাবেন। চলার পথে কোথায় কোথায় বাধা এলো আর কোথায়ই-বা তিনি খুঁজে পেলেন এতটা পথ চলার অনুপ্রেরণা, এ ক্ষেত্রে শাহনাজ বললেন, অনেক ধরনের বাধা আসা সত্ত্বেও তার স্বপ্নপূরণে স্বামীর সহযোগিতা পেয়েছেন গোড়া থেকেই। একজন নারী উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার পেছনে জীবনসঙ্গীর সহযোগিতা খুব জরুরি বলে মনে করেন তিনি। শাহনাজ খান এর সঙ্গে আরো যোগ করেন, ‘আমার এই অর্জনের সঙ্গে যেমন আমার স্বামী জড়িয়ে আছেন, তেমনি শত শত নারী কর্মীও আছেন। শুরুর সময়ের পাঁচণ্ডছয়জন কর্মীর সংখ্যা এখন পৌঁছেছে পাঁচ হাজারে।’
শাহনাজ খান বলেন, আজ থেকে ৩০ বছর আগে ইন্টারনেট ছিল না। তাই কোন এলাকায় কী হচ্ছে, কোন কাপড় কোথায় পাওয়া যেতে পারে- এসব তথ্য জোগাড় করা সহজ ছিল না। এর ফলে জানার আগ্রহ থেকেই এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম, বাংলাদেশের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে তাকে। গল্পের ধারাবাহিকতায় তিনি বললেন, ‘নিজের চোখে দেখতাম, কীভাবে বয়নশিল্পীরা কাপড় বুনছেন, জামদানি শাড়ি কীভাবে তৈরি হচ্ছে। বেশ কয়েক দিন ওখানেই পড়ে থাকতাম কাপড় চেনা ও বোঝার জন্য।’ এমনই একটা ঘটনার কথা মনে করে শাহনাজ খান বলেন, ‘ভোর চারটায় অন্ধকারের মধ্যে টাঙ্গাইলের হাটে গিয়েছি। এই হাট সূর্যের আলো ফুটতে ফুটতে শেষ হয়ে যায়। ভয় পেলেও এটা এক ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল। এর জন্য শিখতে পেরেছি অনেক কিছু।’
শাহনাজ খান বলেন, একুশ শতকে এসে একজন নারী উদ্যোক্তা তার উদ্যোগ শুরু করার সময় সহজেই গুগল সার্চ করে সব তথ্য জেনে ফেলছেন নিমেষেই। ইন্টারনেটের কল্যাণে সবার সঙ্গে যুক্ত হওয়াটাও বেশ সহজ এখন। তা ছাড়া পরিবারের সমর্থনও আগের চেয়ে অনেকটা জোরালো হওয়ায় নিজের পেশা বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা নেই তেমন।
শাহনাজ বলেন, দিবসভিত্তিক পোশাক তৈরির চল অনেক আগে থেকেই এ দেশে। বর্তমান উদ্যোক্তারাও বিভিন্ন দিবসকে কেন্দ্র করে পোশাকের পসরা সাজান। এর পেছনে থাকে অনেক পরিশ্রম। তবে পোশাকের সংখ্যা বাড়ানোর চেয়েও বেশি মন দিতে হবে পণ্যের মানের দিকে। ক্রেতার বিশ্বাস অর্জন করাটাও উদ্যোক্তার এক ধরনের অর্জন। যেহেতু ফ্যাশনশিল্পে উদ্যোক্তার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাই রং নির্বাচন থেকে শুরু করে ফেব্রিক, মোটিফ, প্যাটার্ন- সবকিছুতেই হতে হবে অন্যদের চেয়ে আলাদা, ইউনিক। আর এই সবকিছুর জন্য একজন উদ্যোক্তার প্রয়োজন প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি ও ধৈর্য।
শেষে এসে শাহনাজ খান জানান তার সুচিন্তিত মতামত। বলেন, আগে প্রতিযোগিতা কম ছিল, কিন্তু এখন টিকে থাকতে হলে শুধু দেশেই নয় বরং বিশ্বজুড়ে কী কী হচ্ছে, সেটা জানতে হবে। ট্রেন্ডে কী চলছে, সেটা অজানা বা আন্দাজের ভিত্তিতে হলে পিছিয়ে পড়তে হবে। যেহেতু উদ্যোগটা নিজের স্বপ্ন, তাই সেই দায়িত্ব থেকেই সৎভাবে নিজের অবস্থান জোরালো করতে হবে নারী উদ্যোক্তাদের।
তথ্য : সংগৃহীত
"