দারিদ্র্যবিমোচনে তৃষা
মানুষের বিপদে পাশে থাকতে চান আজীবন। এটাই তার ধ্যান, জ্ঞান। এরই মধ্যে সে অসংখ্য মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন ওয়ার্কস ফর হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠন। টাকাপয়সা দিয়ে সাময়িক মানুষকে সাহায্য করা যায়। কিন্তু এতে সমস্যা থেকেই যায়। টাকা শেষ হলে মানুষটি হাত পাতে অন্যদের কাছে। কিন্তু যদি এমন কিছু করে দেওয়া হয়। যাতে সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। নিজের আয়ে চলতে পারে। তাহলেই মিলবে স্থায়ী সমাধান। এমনটিই তিনি ভেবেছেন। সেভাবেই কাজ করছেন। অদম্য এই সমাজকর্মীর নাম তাহমিনা তৃষা। তাকে নিয়ে লিখেছেন মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
মা, বাবা থেকেই
গরির, দুঃখী, অসহায় যারা। তৃষার মা, বাবা তাদের সাহায্য করতেন। বিভিন্ন সময়, বিভিন্নভাবে। কাউকে ফেরাতেন না। মা, বাবার এই কাজ তৃষার মনে জায়গা করে নেয়। বড় হয়ে তিনিও ভাবলেন, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা। গতানুগতিক নয়। একটু ব্যতিক্রম তার ভাবনা, তার কাজ। তিনি বলেন, কেউ সাহায্য চাইলে ৫০-১০০ টাকা দেওয়া সহজ। টাকা শেষ হলে সে আবার হাত পাতবে। কিন্তু এমন কিছু তাকে দেওয়া হোক। যাতে সে নিজের আয়েই চলতে পারে। অন্যের কাছে হাত পাততে হবে না। এই ভাবনা মাথায় রেখে ২০১৪ সাল থেকে তার কার্যক্রম শুরু। দিন, রাত নেই। ছুটি বেড়িয়েছেন দেশময়। উদ্দেশ্য হলো অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো।
মানবকল্যাণই তার ধ্যান
১৬ জুলাই, ২০১৬ সালে তাহমিনা তৃষা ওয়ার্কস ফর হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। সংগঠনটির চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তৃষা। পরে তার সঙ্গে কো-ফাউন্ডার মেসবাহ মুন্না, ফয়সাল হোসেন, নুরুল ইসলাম, সৌরভ শেখ, সুজন পাটোয়ারী, কাওসার খানসহ অনেকেই যুক্ত হন। কাজটাই তৃষার কাছে মূল বিষয়। কাজগুলো এবং টিমের নাম দেওয়া প্রয়োজন। সে কারণেই সাংগঠনিকভাবে রূপ দেন। তৃষা বলেন, মানুষের জন্য কাজ করতে চাইলে কোনো সংগঠনের প্রয়োজন নেই। সংগঠন ছাড়াও কাজ করা যায়। তবে বৃহত্তরভাবে রূপ দিতে চাইলে তখন একটি প্রাতিষ্ঠানিক নামের প্রয়োজন হয়।
পথ মসৃণ নয়
মুখে মানুষ অনেক কিছুই বলে। সামাজিক মাধ্যমে লেখালেখির শেষ নেই। প্রশংসাও করেন অনেকে। তবে যারা সমাজের জন্য কাজ করছে, তাদের পাশে সহযোগিতার হাত নিয়ে দাঁড়াচ্ছে কম মানুষই। তৃষা বলেন, ওয়ার্কস ফর হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন যখন যাত্রা শুরু করে, সে সময় স্পন্সরশিপের জন্য আমরা একটি কোম্পানিতে যাই। তারা তখন আমাদের মিটিং শিডিউল দিতেই রাজি হননি। তিন বছর পরের ঘটনা। ওই প্রতিষ্ঠান আমাদের কাছে স্পন্সরশিপ চায়। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ সামাজিক সংগঠনের কাজে বেশি সম্পৃক্ত থাকে। যাদের খুব নামণ্ডধাম করেছে, পরিচিতি পেয়েছে। তাদের বেশি সহায়তা করতে দেখা যায় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে। কিন্তু আরো যারা সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনে কাজ করছে। পরিচিতি, খ্যাতি কম যাদের। তাদের খুঁজে বের করে পাশে থাকছে কমই। তৃষার কাছেই জানা গেল, অনেক ফাউন্ডেশন করপোরেট সাপোর্ট পাওয়ার মতো কাজ করছে। কিন্তু তাদের পাশে যেভাবে থাকার কথা, ঠিক সেভাবে নেই করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো।
জুটেছে স্বীকৃতিও
তারুণ্যের আলোকচ্ছটায় উজ্জ্বল তৃষার ওয়ার্কস ফর হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন। সংগঠনটির সদস্যরা মানবকল্যাণে কাজ করেন। পুরস্কার পাওয়া তাদের উদ্দেশ্য নয়। ওয়ার্কস ফর হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন Best Youth Award 2016, Zoom Bangladesh Award 2017, জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড ২০১৭ পেয়েছে। কাজের জন্য তাহমিনা তৃষা পেয়েছেন ক্যানসার রোগী স্বজনসমাজ কর্তৃক সম্মাননা পদক ২০১৭।
মানুষ মানুষের জন্য
ভালো কাজ শুধু টাকাপয়সা দিয়েই নয়। বিভিন্নভাবে করা যায়। তৃষা বলেন, ওয়ার্কস ফর হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন যখন পুরোনো সামগ্রী (জামা, জুতা ও ব্যাগ) বিতরণ করে। দরিদ্র মানুষগুলোই আমাদের মাথার ওপর ছাতা ধরেন। বন্যায় যখন চরাঞ্চলে ত্রাণ দিতে যাই। হাঁটুজলে নিমজ্জিত ঘর। সেখানে আমাদের বসার জায়গা করে দেন। গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক যার সাংসারিক খরচ জোগাতেই কষ্ট হয়। তিনি ছাত্রদের থেকে কলম সংগ্রহ করেন। সেগুলো আমাদের কাছে কুরিয়ার করে পাঠান দরিদ্র্র শিক্ষার্থীদের জন্য। টাকা বা সময় দেওয়ার সামর্থ্য তার ছিল না। এমন এক স্টুডেন্ট সাইকেলে করে বই পৌঁছে দিতেন পাঠকের বাসায়। সমালোচনা নয়। তৃষার মতে, মানুষের জন্য কতটুকু করা সম্ভব। সেটাই ভাবা উচিত সবার আগে।
অল্পদিনে অনেক কাজ
ওয়ার্কস ফর হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের খুব বেশি দিন আগে প্রতিষ্ঠা হয়নি। অল্প কদিনেই সংগঠনটি নজর কেড়েছে। কাজের পরিধি বাড়িয়েছে অনেক। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সচেতনতা, মানসিক বিকাশ, দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূরীকরণ নিয়ে কাজ করছে। আলাদা করে অনেকগুলো প্রজেক্ট। ২৫০০ বইসংবলিত বইবাড়ি লাইব্রেরি। যার শাখা রয়েছে প্রত্যন্ত অঞ্চলসমূহের স্কুলগুলোয়। ওয়ার্কস ফর হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের ‘পড়বে ওরা, গড়বে দেশ’ প্রকল্প। যার আওতায় এখন পর্যন্ত ৪০ হাজারের বেশি খাতা ও কলম দেওয়া হয়েছে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের। বাল্যবিবাহ, মাদকের কুফল, রক্তদানের উপকারিতা, পরিবেশদূষণ, বিভিন্ন রোগ নিয়ে সচেতনতা তৈরিতে সেমিনার ও ক্যাম্পেইন করা হয়েছে। তৃষা জানান, ঢাকার কাছে একটি গ্রাম আছে যেখানে প্রত্যেকটি মেয়ের বিয়ে হয় মাত্র ১২-১৩ বছর বয়সে। সেখানে তিন দিন নানা রকম কর্মসূচির মাধ্যমে ওয়ার্কস ফর হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের টিম তাদের বাল্যবিয়ের কুফল নিয়ে বোঝায়। যার ফলে এখন আর ওই গ্রামে কারো ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয় না।
বিভিন্ন রোগীদের চিকিৎসা সহায়তা, দেখাশোনা, রোগ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বিভিন্ন জায়গায় হেলথ ক্যাম্প, বিনা মূল্যে ওষুধ বিতরণ ইত্যাদি কাজ হয় স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনে।
সংগঠনটির মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশ বিভাগের অধীনে রয়েছে জীবন সুন্দর ক্লাব। স্বামী-শাশুড়ি কর্তৃক শারীরিক নির্যাতনের শিকার, মাদকাসক্ত ব্যক্তি, স্বামীর পরকীয়ার কারণে নির্যাতিত স্ত্রী, ক্যানসার রোগী, আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তি, নিকটাত্মীয় দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার ইত্যাদি নানা রকম সমস্যায় জড়িত ব্যক্তিরা মূলত এখানকার সদস্য।
রয়েছে প্রজেক্ট ত্রিবেণী। যাদের মাসিক আয় পাঁচ হাজার টাকার কম। পরিবারে পুরুষ সদস্য নেই। তারা এই প্রজেক্টের আওতায় ব্যবসায়িক উপকরণ পায়। বিভিন্ন জরুরি মুহূর্তে সংঘটনটির সদস্যরা মানবসেবায় নেমে পড়েন। বন্যা, কোথাও আগুন লেগে নিম্ন আয়ের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলো। তখন ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়। করোনার কথাই ধরা যাক। সংঘটনটির পক্ষে সারা দেশে প্রায় ১৪০০ মানুষকে এক মাসের খাবার দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে রক্তদান কর্মসূচি, শীতবস্ত্র বিতরণ, কাউন্সেলিং সেবা এসব তো আছেই।
অর্থায়ন যেভাবে
সংগঠনটি স্বেচ্ছাসেবকদের কাছ থেকে কোনো ধরনের চাঁদা নেয় না। তবে কমিটি মেম্বার যারা তারা মাসিক অনুদান দেন। এ ছাড়া নিয়মিত দাতারা প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ অঙ্ক ডোনেট করেন। সেটা যেকোনো পরিমাণ হতে পারে। যে কেউ যেকোনো সময় যেকোনো পরিমাণ অর্থ অনুদান হিসেবে পাঠাতে পারেন। সংগঠনটির ডেটা ম্যানেজমেন্ট টিম রয়েছে। যারা অনুদান ও খরচের সব হিসাব লিপিবদ্ধ রাখে। কেউ অনুদান পাঠালে তাকে অফিশিয়ালি কনফার্মেশন পাঠানো হয়। স্বচ্ছতার ব্যাপারে সংগঠনটি বিন্দুমাত্র ছাড় দেয় না। বলেন তাহমিনা তৃষা।
ঢাকার বাইরে
তৃষা বলেন, কাজের ক্ষেত্রে ঢাকার চেয়ে বরং অন্যান্য জেলায় কাজ করা অনেক সহজ। সে তুলনায় ঢাকায় কাজ করা বেশ কঠিন। ঢাকায় কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাজ হলে অনুমতি পেতে বেগ পেতে হয়। মফস্বলে বরং সবাই এগিয়ে আসে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সহায়তা করে। ঢাকার বাইরের কাজে খরচ কম। সামাজিক কাজ করার জন্য ঢাকার চেয়ে বরং অন্যান্য জেলাতেই সুযোগ-সুবিধা বেশি। ঢাকার বাইরে সংগঠনটির কাজের সংখ্যা বেশি বলে তৃষা জানান। বইবাড়ি লাইব্রেরি, ত্রাণ সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন এগুলো মূলত গ্রামাঞ্চলে করা হয়। যদিও সংগঠনটি ঢাকা বেইসড। প্রজেক্ট ত্রিবেণী, তাও ঢাকার বাইরে চলছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ওয়ার্কস ফর হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশকে এমন উচ্চতায় পৌঁছানো যাতে বাংলাদেশের পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষেরও মৌলিক চাহিদা নিশ্চিতকরণে কাজ করে যেতে পারে। তাই আমাদের থিমই হচ্ছে ‘spread happiness over the world’. আমরা বিশ্বব্যাপী সামাজিক সমস্যাগুলো সমাধানের মাধ্যমে মানুষের মাঝে সুখ, আনন্দ ও শান্তির বার্তা পৌঁছে দিতে চাই। বলেন তাহমিনা তৃষা।
"