নাজমুল হক তপন
বিদেশ থেকে প্রথম পদকজয়ী সুলতানা কামাল
বঙ্গবন্ধু : খুকু, তুই বাঙালির মান রাখতে পারবি তো?
সুলতানা আহমেদ খুকী : পারব।
১৯৭৩ সালে অল ইন্ডিয়া রুরাল গেমসে (নিখিল ভারত গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা) অংশ নেওয়ার দিনকয়েক আগে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করা দলটি গিয়েছিল ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে। ওই দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন সুলতানা আহমেদ খুকী। ওই সময় দেশের মান রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন পরিবারের সদস্যদের কাছে খুকী আর বঙ্গবন্ধুর আদরের খুকু।
ওই আসরে লংজাম্পে রৌপ্যপদক জেতেন সুলতানা। এটাই ছিল বিদেশের মাটিতে স্বাধীন দেশের হয়ে বাংলাদেশের কোনো অ্যাথলিটের প্রথম পদক জয়ের গল্প, কীর্তি। ওই একই আসরে বাংলাদেশের হয়ে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে ব্রোঞ্জপদক পেয়েছিলেন শামীম আরা টলি। প্রথম বিদেশ সফরে এ পদকপ্রাপ্তিতে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সুলতানাকে বলেছিলেন, ‘পদক তো জিতেছিস। এখন বল কী চাস?’ খুকীর ঝটপট উত্তর ছিল, ‘মেয়েদের জন্য ক্রীড়া কমপ্লেক্স চাই।’
বিদেশ থেকে প্রথম পদক জেতাই নয়, দেশের অনেক প্রথমের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে সুলতানার নামটি। ১৯৬৬ সালে জাতীয় অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপে লংজাম্পে রেকর্ড করে জেতেন স্বর্ণপদক। ১৪ বছরের খুকী তখন স্কুলপড়ুয়া।
১৯৬৮ সালে পাকিস্তান অলিম্পিক গেমসে লংজাম্পে নতুন রেকর্ড গড়ে স্বর্ণপদক পান। ১৯৭০ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত জাতীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় হার্ডলসে নিজের রেকর্ড ভেঙে জেতেন স্বর্ণপদক। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩, ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ টানা তিন বছর অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতা। খুকী প্রতিবারই অংশ নেন; ফেরেন যথারীতি সোনা জয়ের হাসি নিয়ে।
১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম প্রতিযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে ১০০ মিটার হার্ডলস, লংজাম্প ও হাই-জাম্প- তিন বিভাগেই সেরা খুকী; ১০০ মিটার স্প্রিন্টে দ্বিতীয়; ওই বছরই অর্জন করেন জাতীয় ক্রীড়া লেখক সমিতির (বিএসপিএ) বর্ষসেরা অ্যাথলিট হওয়ার গৌরব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম নারী ‘ব্লু’ও তিনি। ১৯৭৪-এ স্বর্ণপদক জেতেন লং জাম্পে। ১৯৭৫ সালে ১০০ মিটার হার্ডলসে ১৭ দশমিক ৫ সেকেন্ড সময় নিয়ে তিনি নতুন রেকর্ড গড়ে প্রথম হন। একই আসরে সেরা হন লংজাম্পেও।
সুলতানা আহমেদ থেকে সুলতানা কামাল হয়ে ওঠাটাও কম ঘটনাবহুল নয়! দুই পরিবারের মধ্যে আত্মীয়তার ‘ম্যাচ মেকার’ মূলত বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা।
দুই পরিবারের ঘনিষ্ঠতা দীর্ঘদিনের। খুকীর বাবা দবিরউদ্দীন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিফ ইঞ্জিনিয়ার। পরিবার নিয়ে থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বকশীবাজারের কোয়ার্টারে। এ বাসায় হাসিনা ও রেহানা এই দুই সহোদরার যাতায়াত ছিল নিয়মিত। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ তনয় শেখ কামালের সঙ্গে ছিল খুকীর তিন নম্বর ভাই বাবুলের (ফারুক মোহাম্মদ ইকবাল) বন্ধুত্বের সম্পর্ক।
১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর দুপুর ১২টা বা সাড়ে ১২টার দিকে বাবুলকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তান হানাদার বাহিনী। দেশ স্বাধীন হলো, কিন্তু ফিরে আসেননি বাবুল। এর দুদিন পর শেখ কামাল আসেন খুকীদের বাসায়। মা জেবুন্নেচ্ছাকে বলেন, ‘আমি বাবুলের শূন্যতা পূরণ করব।’
দুই পরিবারের ঘনিষ্ঠতা অনুধাবনের জন্য খুব বেশিদূর যাওয়ার দরকার নেই। শেখ জামাল লন্ডন থাকাকালে, খুকীর জন্য ট্র্যাক সু পাঠিয়েছিলেন। তবে খুকীকে ভ্রাতৃবধূ করার ক্ষেত্রে প্রথম উদ্যোগী হন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। আত্মজাদের চাওয়াকে শিরোধার্য মেনে নিয়ে, মাতুয়াইলের এক স্থানীয় রাজনীতিবিদকে দিয়ে বড় ছেলের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। আনুষ্ঠানকিভাবে বিয়ে হয় ১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই।
কিন্তু কেন বিয়ের দিন ১৪ জুলাই? এ নিয়ে খুকীর মেজো ভাই জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ জসিমের ভাষ্য, ‘ফরাসি বিপ্লবের (১৭৮৯) সময় বাস্তিল দুর্গের পতন হয়েছিল ১৪ জুলাই। দিনটি ঠিক করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমার মনে হয়েছে, বড় ছেলের বিয়ের দিন হিসেবে বঙ্গবন্ধু এই বিশেষ দিনটিকেই বেছে নিয়েছিলেন। যদিও বিষয়টা নিশ্চিত কি না আমি জানি না। তবে আমার বিশ্বাস এমনি এমনি ১৪ জুলাই তারিখটি বেছে নেননি রাজনীতির প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন জাহাঙ্গীর। খেলাধুলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ঢাবির আন্তহল প্রতিযোগিতায় জিতেছেন অনেক পুরস্কার। খুকী ৯ ভাই-বোনের মধ্যে অষ্টম। আর বোনদের মধ্যে সবার ছোট। পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যই পাড়ি জমিয়েছেন অনন্তলোকের পথে। পরিবারের জীবিতদের কাছে খুকী এখনো জীবন্ত, সব সময়ের চ্যাম্পিয়ন। একান্নবর্তী এই পরিবারটির সঙ্গে ঘণ্টা দু-একের কিছু বেশি সময় কাটানোর অভিজ্ঞতা চেষ্টা করলেও হয়তো ভুলতে পারব না।
প্রথমে কথা বলছিলাম পরিবারের ছোট ছেলে গেলাম আহমেদ টিটোর সঙ্গে। ৩০-৩৫ মিনিট পর এলেন মেজো ভাই জাহাঙ্গীর। ড্রইংরুমে সোফায় বসার আগেই সত্তোর্ধ্ব এই ভদ্রলোক বললেন, ‘জার্নালিস্ট সাহেব পি বি শেলির Our sweetest songs are those that tell of saddest thought’ এমন একটা কবিতার লাইন আছে না? কবিতার এ ভাষা আমাদের কাছে Our sweetest songs are those when we used to see sultana’s cheerful face winning gold medal’
এরপর নিজেই বাংলা করে বললেন, ‘পদক জয়ের পর খুকীর আনন্দময় মুখটিই আমাদের মধুরতম সংগীত।’
খুকীর সঙ্গে ছোট ভাই টিটোর স্মৃতি এখনো টাটকা। দুজনের বয়সের পার্থক্য ১০ বছরের। তার পরও দুষ্টুমি, খুনসুটি কম হতো না দুজনের মধ্যে। খুকী কখনো ২০০ মিটারে অংশ নিতেন না। এদিকে মাঝেমধ্যেই পা ম্যাসাজ করে দেওয়ার জন্য ছোট ভাইকে এটা-ওটার লোভ দেখিয়ে ডাকতেন। টিটোর কথায়, ‘প্রথম দিকে বলতাম, চ্যাম্পিযন হতে পারলে পা ম্যাসাজ করে দেব। কিন্তু আপু তো চ্যম্পিয়ন সব সময়ই হয়। তাই বুদ্ধি করে বললাম, ২০০ মিটারে অংশ নিলে ম্যাসাজ করে দেব। আপু বলত, ঠিক আছে ম্যাসাজ করো। ২০০ মিটারে অংশ নেব। কিন্তু কখনোই খুকী আপু ২০০ মিটারে অংশ নেয়নি।’
খুকীর ছেলেমানুষী নিয়ে একটা মজার ঘটনা জানালেন টিটো, ‘খোকন (পাঁচ নম্বর ভাই) ভাইয়ের জ্বর হয়েছে। ভাইয়ের জন্য বাসায় আঙুর আনা হয়েছে। খুকী ভাইয়ের কাছে আবদার করে বলল, আমি তোমার আঙুরগুলো খাই। আমার যখন জ্বর হবে, তখন তুমি আমার আঙুরগুলো খেয়ো।’
খুকীর মুখে শুধু বোল ফুটেছে। বড় শব্দগুলো তখনো রপ্ত করতে শেখেনি। বাড়ির বড়দের কোলে চড়েই, ‘বাংলা চাই’, ‘বাংলা চাই’ স্লোগান দেওয়ার চেষ্টা করত খুকী, জানালেন জাহাঙ্গীর সাহেব।
বাংলাদেশ রাজনীতির প্রতিটি বাঁকের সঙ্গেই যে বাসাটির প্রত্যক্ষ যোগ, তার একটা প্রভাব থাকাটাই স্বাভাবিক। এই পরিবারের পাঁচজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের ছাত্র। এদের একজন খুকী। সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্সের ছাত্রী ছিলেন। লিখিত পরীক্ষাও দিয়েছিলেন। কিন্তু ভাইভা আর দেওয়া হয়নি। তার আগেই ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডির শিকার হন। ৩২ নম্বর বাড়িটির ইতিহাসের অংশ হয়ে যান খুকী।
১৫ অগাস্ট ট্র্যাজেডির দুদিন আগে কামালকে নিয়ে বকশীবাজারের বাসায় এসছিলেন খুকী। তবে বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি কামাল। ভার্সিটিতে প্রোগ্রাম আয়োজন উপলক্ষে দ্রুতই চলে যান। আবার বিকেলের দিকে এসে স্ত্রীকে নিয়ে যান। যাওয়ার আগে মা জেবুন্নেচ্ছা বেগমকে খুকী বলে যান, ১৫ আগস্ট আসবেন। ভালো রান্না করে রাখার কথাও বলেন। তার শ্বশুরও (বঙ্গবন্ধু) আসতে পারেন এমনটাও জানিয়ে গিয়েছিলেন।
১৫ অগাস্ট সকাল। খুকীর বড় দুই ভাই ছুটলেন ৩২ নম্বরের দিকে। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। যে বাড়িটির দরজা কখনো বন্ধ হতে পারে, এমনটা স্বপ্নেও কখনো ভাবা সম্ভব ছিল না। দূর থেকে সেই বাড়িটির দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকতে হলো দুই ভাইকে।
১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডির শিকার মারাত্মকভাবে আহতদের কয়েকজনকে আনা হয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজে। বকশীবাজারের বাসা থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ বেশ কাছাকাছি। একটু পরপর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেছেন জেবুন্নেচ্ছা। সেজো ছেলে বাবুলের জন্য দিনের পর দিন টেবিলে খাবার সাজিয়ে রেখেছেন, কিন্তু ছেলে ফেরেনি। অতি আদরের খুকীও কি, ভাবতে পারেন না কিংবা ভাবতে চাননি জেবুন্নেচ্ছা।
কাজলা দিদির মায়ের মতো খুকীর কথায় বুকে পাথর বেঁধে আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে কাটিয়ে গেছেন আড়াই দশক। ভাই-বোনদের কাছে খুকী চিরজীবন্ত। স্বর্ণজয়ী মুখখানাই ভেসে ওঠে সবার চোখে। কাজলা দিদি আর খুকী যেন সমার্থক। কেউ গল্প বলে, স্বপ্ন দেখায় আর কেউ গল্পের বিষয়বস্তু হয়ে স্বপ্ন দেখায়। কোন কাজলা দিদি সত্যি? হারিয়ে যাওয়া, নাকি যুগ যুগ ধরে গল্প বলে যাওযা কাজলা দিদি কিংবা খুকী?
(লেখাটি ২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম প্রকাশিত হয়।)
"