দুই নারী উদ্যোক্তার সফলতার সাতকাহন
ঘর-সংসার সামলে আজকাল নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই সফলতা দেখাচ্ছেন। উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলছেন। এমনকি ৯টা-৫টা অফিসের ধার ধারছেন না। স্বাধীন ব্যবসায় একদিকে তারা যেমন অর্থনীতিক স্বনির্ভরতা খোঁছে পাচ্ছেন। অন্যদিকে সৃষ্টি হচ্ছে কর্মসংস্থানের। আয় করায় পরিবারে তাদের অবস্থান পোক্ত হচ্ছে। অনেক সফল নারী উদ্যোক্তার মধ্যে দুজন হলেন সুমাইয়া খান দৃষ্টি, শারমিন আফরোজ। তাদের সফলতার গল্প জানাচ্ছেন মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
শারমিন আফরোজ
মাস্টার্স পরীক্ষার ঠিক মাস দু-এক আগের ঘটনা। তিনি কন্সিভ করেন। সেবার আর তার পরীক্ষাই দেওয়া হলো না। দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিয়ে পাস করেন। তখন ঘরে ছোট শিশুসন্তান। তিনি ভাবলেন, এমন কিছু করবেন। যাতে মেয়েকে দেখাশোনাও হবে। আবার ঘরে বসে কিছু আয় হবে। নিজ বুদ্ধিতে শুরু করলেন কাপড়ের ব্যবসা। এরপর আর তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এতক্ষণ যার গল্প বলা হলো সেই মানুষটির নাম শারমিন আফরোজ।
রাজশাহী কলেজ থেকে অনার্স-মাস্টার্স করেছেন। স্বামী আর আট বছরের শিশুসন্তানকে নিয়ে তার পরিবার। স্বামীর কর্মসূত্রে এখন নারায়ণগঞ্জে থাকেন। নারী হবে উদ্যোক্তা, তাও আবার কাপড়ের ব্যবসা। কেমন যেন কিছু মানুষ মানতেই পারছিল না। কাপড় বিক্রি করে খায়। কাপড় বিক্রি করে কী হবে। এমন নানা কথা শুনেছেন তিনি। কিন্তু এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিয়েছেন। কথাগুলো ধরে বসলে তো আমি এগিয়ে যেতে পারতাম না। আর কিছু মানুষ এমন বলেই থাকে। এসব পাত্তা দিতে নেই, বলেন শারমিন। অবশ্য পাত্তা যে তিনি দেন না। সেটা তার কাজেই বোঝা যায়। তিনি ২০২১ সালে ১৯ আগস্ট রাজকন্যা বিডি পেজ খোলেন। দুবছরে পেজটির লাইক, ফলোয়ার প্রায় ১১,০০০। আর তার মাসিক আয় এখন গড়ে প্রায় ২০,০০০। বিক্রি মাসে গড়ে ৫০,০০০ থেকে ৬০,০০০। এও বা কম কীসে! ঘর-সংসার, সন্তান সামলিয়ে এমনইবা কজন পারে। নিজের এতটুকু অর্জনে সন্তুষ্ট শারমিন। তবে বহুদূর যেতে চান তিনি।
অনলাইনে শারমিন তার ডিজাইন করা ব্লক শাড়ি, থ্রি-পিস, ডিজাইনার কুর্তি, ব্লাউজ পিস, কাপল সেট, কম্বো সেট ইত্যাদি বিক্রি করেন। নিজে নিজে চর্চা করে তিনি ডিজাইনের কাজ শিখেছেন। তিনি বলেন, আমি ছোটবেলা থেকেই ড্রেস ডিজাইন করতে পারতাম। যখন কলেজে পড়তাম তখন খুব অল্প টাকার গজ কাপড় দিয়ে ড্রেস ডিজাইন করেছি। সবাই তার খুব প্রশংসা করত। ভাবত কোনো নামকরা দোকান থেকে কিনেছি। শারমিনের কাছে ৫০০ থেকে ৩৫০০ টাকা দামের পণ্য রয়েছে।
অনলাইনে তো কাপড় বিক্রেতার অভাব নেই। আপনার থেকে মানুষ পণ্য কিনবে কেন? বিশেষ কিছু আছে কি? এমন প্রশ্নের জবাবে শারমিন বলেন, ধার করা, কপি করে নয়। আমি সম্পূর্ণ নিজের বুদ্ধি দিয়ে ডিজাইনসহ সব কাজ করি। ডিজাইনে নতুনত্ব দেওয়ার চেষ্টা করি। যুগের সঙ্গে যায়, বাঙালি কৃষ্টি-কালচার ও যেন দৃশ্যমান থাকে লক্ষ রাখি। এসব কিছুর কারণে ক্রেতা আমার কাপড় পছন্দ করে। আবার একজন ক্রেতা পছন্দ করলে তিনি আর দশজনকে আমাকে দেখিয়ে দেন। তারা আমার থেকে কাপড় নেন। এভাবে ক্রেতা থেকে ক্রেতা বেড়ে মোটামুটি একটা গ্রুপ তৈরি হয়েছে। ফলে বিক্রির জন্য খুব একটা হাঁসফাঁস করতে হয় না তাকে।
আজকাল তো অনেক নারীই উদ্যোক্তা হতে চান। তাদের জন্য শারমিনের পরামর্শ হলো, যেটা আপনি জানেন। সেটা করবেন। অন্যের দেখাদেখি কিছু না করা উত্তম। নিজের সৃজনশীলতা কাজে লাগাতে হবে। হয়তো আরো কিছুদিন সময় লাগবে। তবু রাজকন্যা বিডি একটা জনপ্রিয় ব্র্যান্ডে পরিণত হবে। একটি শপ করবেন, যেখানে কিছু মানুষ জীবিকার সন্ধান পাবেন। এমনটাই তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা।
সুমাইয়া খান দৃষ্টি
ফুল, লতাপাতা প্রকৃতির নানা জিনিসের ছবি তার ক্যানভাসে ধরা দেয়। ছোট্ট ক্যানভাস হয়ে ওঠে জীবনের এক অনবদ্য গল্প। শিল্পপ্রেমীরা এই গল্প দারুণভাবে উপভোগ করেন। জানান তাদের প্রশংসার কথা। ছবি এঁকে মানুষকে মুগ্ধ করা এই শিল্পীর নাম সুমাইয়া খান দৃষ্টি। দৃষ্টি ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক থেকে ব্যাচেলর ইন আর্কিটেকচার করেছেন। দুই সন্তান, আর স্বামীকে নিয়ে তার পরিবার। ছোটবেলা থেকেই তার ছিল ছবি আঁকার প্রতি প্রবল আগ্রহ।
সংসার, সন্তান লালনপালনেই যখন অনেকে হাঁপিয়ে ওঠেন, তখন নিজের ভালো লাগা কিংবা শখ পূরণ করা হয়ে ওঠে না। ছবির প্রতি ছোটবেলার আগ্রহে তার বড়বেলায় ডালপালা গজিয়েছে। তিনি সব কাজ করার পাশাপাশি ছবি আঁকেন। ছবির মধ্যে সুখ, শান্তি, তৃপ্তি খুঁজে পান। কেন ছবি আঁকেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছবি আঁকতে বসলে নিজের জগতে হারিয়ে যাই। যত চিন্তা, টেনশন থাক। সব থেকে মুক্ত হয়ে একদম ফ্রেশ হয়ে যাই। নিজের যেটা ভালো লাগে সেটাই তিনি রংতুলিতে ফুটিয়ে তোলেন। সাদা ক্যানভাস হয়ে ওঠে বর্ণিল। আবার কাস্টমার যেমনটা চান। কখনো কখনো তেমনটাও এঁকে দেন। ধানমন্ডিতে তার বাসা যেন এক ছবির মেলা। নানা ধরনের ছবি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। অসংখ্য ছবি আঁকলেও সব ছবিই তার প্রিয়। এ প্রসঙ্গে বলেন, ভালোবাসা, ভালো লাগার জিনিস মন্দ হয় কী করে। প্রতিটি ছবির প্রতি তার অসম্ভব মায়া জড়িয়ে আছে বলে জানান।
ছবি আঁকা তার পেশা না হলেও আয়ের বেশ ভালোই উৎস হয়ে উঠেছে বলে জানান। দৃষ্টি বলেন, ছবি বিক্রির টাকায় প্রিয় মানুষদের টুকটাক উপহার দিচ্ছি। বর্তমানে কিছু টাকা সঞ্চয় ও করেছি। সংসার সামলে ছবি আঁকার সময় বের করা তার জন্য বেশ বড় চ্যালেঞ্জ। এমনটাই জানান তিনি। কষ্ট হয়। তবু সময় ঠিকই তিনি বের করে নেন। এজন্য পরিবারের লোকজনের প্রতি তার কৃতজ্ঞতা শেষ নেই। স্বামীসহ অন্যরা সব সময় পাশে থাকেন। ছবি আঁকতে উৎসাহ দেন। ভালোমন্দ মতামত জানান। এটা দৃষ্টি তার অন্যতম প্রাপ্তি বলে মনে করেন। তিনি বলেন, কটা পরিবারইবা এ ধরনের সৃজনশীল কাজকে উৎসাহ দেয় আজকাল। সেখানে আমার পরিবার আমাকে শুধু উৎসাহই দেয় না। প্রয়োজনে সহযোগিতাও করে।
ছবি আঁকা তো শিখতে হয়। তিনি অবশ্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোথাও শিখেননি। ইউটিউব, গুগলের সাহায্য নিয়েছেন। বিভিন্ন এক্সিবিশনে গিয়েছেন। নিজে চর্চা করে নানা কৌশল রপ্ত করেছেন। কোথাও আটকে গেলে নিয়েছেন অভিজ্ঞদের পরামর্শ। এভাবেই তিনি ছবি আঁকায় দক্ষ হয়ে উঠেছেন।
ভালো ছবি আঁকলে তার মূল্যায়ন তো হবেই। দৃষ্টির বেলায়ও তাই হয়েছে। তিনি এ পর্যন্ত প্রায় ৫টি এক্সিবিশনে অংশ নিয়েছেন। পুরস্কারও পেয়েছেন নানা প্রতিষ্ঠান থেকে। যারা গৃহিণী। এক সময় শখে ছবি আঁকতেন। তারা চাইলে দৃষ্টির মতো শখটাকে বাঁচিয়ে তুলতে পারেন। অলস সময় না কাটিয়ে ক্যানভাস হয়ে উঠতে পারে আনন্দের উৎস। নিজেকে মেলে ধরার উত্তম মাধ্যম। এমনটাই মনে করেন দৃষ্টি।
নানা রকম জুয়েলারি পরতে দৃষ্টির খুব পছন্দ। সে কারণে নিজে যেমন পরেন। আবার তৈরি করে বিক্রিও করেন। জুয়েলারি বিক্রিতে তার আয় মন্দ নয়। করোনার সময় তিনি নিজে ডিজাইন করে মাস্ক তৈরি করে বিক্রি করেছেন। আবার পটের ব্যাগের ওপর তার আঁকা ছবি প্রচুর মানুষ পছন্দ করেছে বলে তিনি জানান।
ভবিষ্যতে আরো সুন্দর সব ছবি আঁকবেন। পাশাপাশি নতুনদের শেখার জন্য ভিডিও টিউটোরিয়াল তৈরি করবেন। সৃজনশীল মাধ্যমে নিজেকে তুলে ধরবেন- এমনটাই দৃষ্টির ইচ্ছা।
"