মাহমুদুল হক রিয়াদ
খামারের মালিক কলেজছাত্রী দিলরুবা
দিনের শুরুতে তার নিত্যকর্ম পোলট্রি খামার পরিষ্কার করা। হাঁস-মুরগিকে খাবার ও পানি দেওয়া। অসুস্থ মুরগির পরিচর্যা করা। কখনো হাঁসদের নিয়ে জলাশয়ে যাওয়া। তারপর সময় হলে বই-খাতা নিয়ে কলেজে যাওয়া। কলেজ থেকে ফিরে আবার সেই খামারের দেখাশোনা। রাতে বই নিয়ে পড়তে বসা। এমনই এক রুটিনে বাঁধা কলেজছাত্রী দিলরুবার জীবন। মোবাইলে ইউটিউব দেখে দেখে দিলরুবা গড়ে তুলেছেন হাঁস ও মুরগির খামার। সদা হাস্যোজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত। কর্মের প্রতি যার অগাধ ভালোবাসা। তেমনই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের প্রতিচ্ছবি দ্বাদশ শ্রেণিপড়ুয়া কলেজছাত্রী দিলরুবা।
দিলরুবার বাড়ি কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার সিদলা ইউনিয়নের রামেশ্বরপুর গ্রামে। বাবা হেলাল উদ্দিন পেশায় একজন কৃষক। গৃহিণী মা ও দুই বোন এক ভাইকে নিয়ে দিলরুবাদের সংসার। নিজের কাঁধে মাটি তুলে টিনশেড ঘরে মাটি ভরাট করেন। নির্মাণ ও মুরগির সেট তৈরিসহ যাবতীয় কাজে মিস্ত্রিদের সহযোগিতা করেছেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে তিল তিল করে করে গড়ে তুলেছেন হাঁস ও মুরগির খামার।
২০২১ সালের শুরুর দিকে এক হাজার ব্রয়লার মুরগি নিয়ে খামারের যাত্রা শুরু করেন দিলরুবা। এরই পাশাপাশি দুইশো হাঁস পালন শুরু করেন। খামারে হাঁস-মুরগির দেখাশোনা, খাওয়ানো, ওষুধপত্র সবই নিজ হাতে করেন। আবার লেখাপড়ায়ও পিছিয়ে নেই দিলরুবা। ২০২০ সালে হোসেনপুর উপজেলার মেছেড়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে মানবিক বিভাগে জিপিএ ৩.১৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এখন হোসেনপুর সরকারি মডেল পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। এ বছর উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষা দেবেন তিনি। তাই পড়ার চাপ বেশি। তবু থেমে নেই তার পথচলা।
দিলরুবা বলেন, প্রথমে এক দিন বয়সি পোলট্রি মুরগির বাচ্চা ২৫-৩০ টাকায় কিনে শেডে তুলি। পোলট্রিতে ৪৫ গ্রামের এক দিন বয়সি একটি বাচ্চাকে প্রতিদিন ১৫ গ্রাম খাবার খাওয়াতে হয়। তিন থেকে পাঁচ ও বিশ থেকে বাইশ দিনের বাচ্চাকে রানীক্ষেত ও ব্রংকাইটিস এবং সাত থেকে দশ ও চৌদ্দ থেকে সতেরো দিনের ভেতরের গাম্বুরু ভ্যাকসিন দিতে হয়। এই কাজগুলো আমি নিজেই করি। মুরগিকে বিক্রির উপযোগী করতে প্রতিদিন খাবারের পরিমাণ বাড়াতে হয়। ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ দিন মুরগির ১৮০ গ্রাম খাবারের প্রয়োজন হয় এবং ওজন হয় ২ কেজির মতো। তখন মুরগিগুলোকে ওজন করে ডিলারের কাছে পাইকারি বিক্রি করে দিই।
দিলরুবা বলেন, এক হাজার মুরগিকে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করতে খাবার, ওষুধ, তুষ, বিদ্যুৎ বিলসহ বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী খরচ হয় ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। আর ১ হাজার মুরগির বর্তমান বাজারদরে বিক্রি করতে পারলে আমার ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা লাভ হবে বলে আশা করছি। এখন প্রতি মাসের আনুষঙ্গিক ব্যয় মিটিয়েও বাড়তি উপার্জন হচ্ছে। এ দিয়ে সংসার খরচ, আমার ও ভাইবোনদের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যাচ্ছি।
দিলরুবা বলেন, মহামারি করোনায় কলেজ বন্ধ থাকা অবস্থায় ইউটিউব দেখে মুরগির খামার গড়ে তোলার ইচ্ছা পোষণ করি। কৃষিকাজ ও হাঁস-মুরগি পালন করা আমার ভালো লাগে। এত কাজের চাপেও আমার লেখাপড়ার কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। আমার আর্থিক অবস্থা এবং পোলট্রি খামার দেখে এলাকার অনেক বেকার ছেলে পোলট্রি ও গবাদি পশুর খামার করছেন। তিনি বলেন, সহজ শর্তে কোনো ব্যাংক-বীমা কিংবা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ঋণ দিলে ভবিষ্যতে একটি বড় মাপের গবাদি পশুর খামার স্থাপন এবং মুরগির খামারটি আরো বেশি প্রসারিত করার ইচ্ছে আছে। একই সঙ্গে এলাকার বেকার ছেলেদের আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করারও ইচ্ছে রয়েছে। চাকরি নামের সোনার হরিণের পেছনে না ঘুরে একটু বুদ্ধি খাটালে স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব। এতে বেকারত্ব ঘুচবে এবং আর্থিকভাবে লাভবানও হওয়া যায়।
দিলরুবা একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে এলাকায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি নিজেকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে তিনি যে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন তার জন্য এলাকায় তার সুনাম ও সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে।
লেখক : সাবেক শিশু সাংবাদিক, হ্যালোডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
"