জীবন যারা করল জয়
অদম্য ইচ্ছাই একজন মানুষকে লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। যদি নিষ্ঠা ও সততা থাকে তাহলে কোনো বাধাই তার গতিরোধ করতে পারে না। বিচ্যুত করতে পারে না লক্ষ্য থেকে। এটাই সৃষ্টির ধর্ম। মনে রাখতে হবে, সৃষ্টিশীল একজন মানুষ শুধু যে নিজেকেই এগিয়ে নেন তা নয়, তার সৃষ্টির মিছিলে থাকে হাজারো মানুষ। যারা কোনো না কোনোভাবে হন সেই অফুরান সৃষ্টির গর্বিত অংশীদার। এমন সৃষ্টিশীল কয়েকজন মানুষকে নিয়ে এবারের জয়িতার আয়োজন। আজ থাকছে ১ম পর্ব। তাদের নিয়ে লিখেছেন সিনিয়র সাংবাদিক গাজী শাহনেওয়াজ
ডা. তারজিয়া আসমা জাফরুল্লাহ
পেশায় ফেরার অনিশ্চয়তা থেকে প্রতিষ্ঠিত চক্ষু চিকিৎসক
চিকিৎসক হওয়াটা তার জীবনের একটা লম্বা কাহিনি। জহিরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন তিনি। পরে চক্ষু বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রির অংশ হিসেবে ডিপ্লোমা ইন অর্থানোজি ডিগ্রি অর্জন করেন; সেটা ২০০৮ সালে।
এরপর একটা লম্বা গ্যাপে তাকে চলে যেতে হয়। কারণ সন্তান, সংসার ও চাকরি সব মিলিয়ে পেশাটাকে নিয়মিত ধরে রাখতে পারেননি। একপর্যায়ে তার মনে হয়েছিল হয় তো সংসার, স্বামী ও সন্তান এবং পড়ালেখা সব সামলিয়ে আবার তিনি চিকিৎসা পেশায় ফিরতে পারবেন। তবে অদম্য চেষ্টা ও অধ্যবসায় তাকে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছে। বর্তমানে ডা. তারজিয়া আসমা জাফরুল্লাহ লায়ন্স চক্ষু হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। সেখানে তিনি পোস্টগ্র্যাজুয়েড শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। বিকেলে রাজধানীর গ্রিনলাইফ হাসপাতালে চেম্বার করে রাতেই বাসায় ফেরেন।
তিনি বলেন, শিশুসন্তানকে লালন-পালন করা এবং স্কুলে নিয়ে যাওয়া ও নিয়ে আসা সব কিছু আমাকেই করতে হয়েছে। দীর্ঘ বিরতির পর আমার নিজের মধ্যে একটা বোধদয় হলো, আমি এমবিবিএস পাস করেছি, পোস্টগ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন করেছি, এভাবে সম্ভাবনাময় কেরিয়ারটা নষ্ট হতে দেওয়া যায় না।
চিকিৎসা মহান পেশা, অথচ আমি মানুষকে কোনো সেবা দিতে পারছি না। আমার যে ডিগনিটি ছিল সেটাও কাজে লাগাতে পারছি না। পরে আমি নতুন উদ্যমে আবার কাজে ফেরার চেষ্টা করলাম। মনে মনে সংকল্প করলাম, আমাকে এভাবে থেমে গেলে চলবে না। আমাকে আরো কিছু করতে হবে। সেটা নিজের জন্য না, মানুষের জন্য।
কাজে ফেরার দৃঢ়-সংকল্প নিয়ে জব খোঁজার চেষ্টা করি। একপর্যায়ে আনোয়ার খান মডার্ন কলেজ হাসাপাতালে রেজিস্ট্রার হিসেবে যোগ দিই। সেখানেই চিকিৎসা ক্ষেত্রে বড় ও চ্যালেঞ্জিং ডিগ্রি এফসিপিএস অর্জনের পরিকল্পনা গ্রহণ করি। কারণ এই কোর্সটি পাঁচ বছরের এবং উত্তীর্ণ হওয়াটা ছিল বড় চ্যালেঞ্জের। পরিবার ও বিশেষ করে আমার স্বামীর ঐকান্তিক সহযোগিতায় সেখানে সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হই। এজন্য আল্লাহর কাছে হাজারো শুকরিয়া।
মায়ের অনুপ্রেরণায় আজ
প্রতিষ্ঠিত সাফিয়া শিমুল
অক্লান্ত প্রচেষ্টায় নিজের একটা পরিচয় তৈরি করতে পেরেছেন সাফিয়া শিমুল। তার এই ভরসা ও আস্থার জায়গাটি হচ্ছে পুষ্পধারা প্রপার্টিজ লিমিটেড। পরিবারের ভাই-বোনদের মধ্যে তিনি মেজো। তার বাবা ছিলেন পেশায় ব্যবসায়ী। ব্যবসাটা ছিল গার্মেন্ট পণ্যের, যেখানে প্রায় বেশির ভাগ টাকা লস খেয়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। যার খেসারত দিতে হয় পুরো পরিবারকে। তার বয়স তখন ১২। এ সময় তার মা খুব কষ্ট করে সংসারের হাল ধরেন।
সাফিয়া শিমুল বলেন, যাই হোক এভাবেই চলতে থাকে আমাদের জীবন-জীবিকা। তারপর যখন আমি ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী, তখন থেকেই আমি টিউশনি করাই। ভাগ্যক্রমে ছাত্রছাত্রী পেয়েও যাই। তবে আমার মা কখনোই চাননি আমি পড়াশোনা ছেড়ে দিই। আমার জীবনের একমাত্র অনুপ্রেরণার উৎস এই মহীয়সী নারী। আমার পড়াশোনা হয়তো থেমেই যেত যদি না আমার মা পাশে থাকতেন। খুব কষ্ট করে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ও এমএ সম্পন্ন করি।
ও হ্যাঁ, আমি এইচএসসিতেই বিয়ে করি, তার মধ্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে আমার চাকরি হয় ঢাকা ব্যাংকে। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস, তখন আমার ছেলে পৃথিবীতে আসে, কিন্তু মা ও ছেলে দুজনেই প্রচণ্ডভাবে অসুস্থ থাকায় আমি আর সেই চাকরিতে জয়েন করতে পারলাম না। সংসার, সন্তান ও ছাত্রছাত্রী পড়ানো এভাবেই দিন যাচ্ছিল আমার। মাঝখানে একটা স্কুলে জয়েন করেছিলাম, কিন্তু বাচ্চারা ছোট বিধায় তাদের দেখাশোনায় যেন কোনো ঘাটতি না হয় তাই স্কুলের চাকরিটাও ছেড়ে দিয়েছিলাম।
আমার মেয়ে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী, তখন সালটা ২০১৪। সে প্রথম থেকেই খুব ভালো রেজাল্ট করে আসছে, সেই থেকে তার পরিচিতি অনেক। সেই সূত্র ধরে একটা পর্যায়ে আমার কাছে অনেক টিউশনি আসতে থাকে। দিন-রাত খাটতে থাকলাম। ৪০ জন বাচ্চাকে আমি পড়াতাম। বাচ্চাদের অভিভাবকরা খুবই খুশি ছিল আমার ওপর। কিন্তু আমি আসলে এতে খুব বেশি আগ্রহ পেতাম না। কারণ আমার ইচ্ছা ছিল যে আমি এমন কিছু করব যেখানে আমার মতো আরো অনেকেই থাকবে, কাজ করার সুযোগ পাবে।
একপর্যায়ে আমি একটা চাকরিতে জয়েন করি। সে ক্ষেত্রে এই সুযোগটা তৈরি করে দিয়েছিলেন পুষ্পধারা প্রপার্টিজ লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মো. আলীনুর ইসলাম। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন, ‘তোমার যেহেতু পড়াশোনা আছে এবং যোগ্যতা আছে আমার এখানেই আপাতত কাজ করতে পারো।’ এর চেয়ে ভালো খবর আর হতে পারে না। সাল ২০১৭, শুরু করলাম পুষ্পধারা প্রপার্টিজ লিমিটেডের সঙ্গে যাত্রা। আর কাজ করতে করতে এই কোম্পানির প্রতি আলাদা একটা ভালো লাগা সৃষ্টি হতে থাকল।
ঢাকা-মাওয়া রোডে আমাদের কোম্পানির দুটো প্রজেক্ট আছে- পদ্মা ভ্যালি ও পদ্মা ইকো সিটি। এর মধ্যে পদ্মা ইকো সিটির কাজ বিদ্যমান ও পদ্মা ভ্যালি হস্তান্তরের জন্য প্রস্তুত। পুরো প্রকল্পটি ৪৫০০ বিঘার একটি ব্যাপক প্রকল্প, যার চারপাশে আমরা কৃত্রিম লেক রেখেছি, কৃত্রিম বনায়নের ব্যবস্থা রেখেছি। নিজস্ব হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, মসজিদের জন্য জায়গা রেখেছি। এ ছাড়া বিনোদনের জন্য খেলাধুলার পার্ক ও সিনেমা হলের জায়গা বিদ্যমান। আমাদের মূল লক্ষ্য নিষ্কণ্টক জমি মানুষের হাতে হস্তান্তর করা। ধনী-গরিব নির্বিশেষে ঝামেলাহীন মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরি করে তাদের আশ্বস্ত করা।
সন্তানকে বাবার অনুপস্থিতি বুঝতে দিইনি
শাহানাজ জাহান শিউলী
শিউলী ফুলের মতোই তার জীবন। মাত্র তিন বছর বয়সে মা হারা একজন সংগ্রামী মেয়ে। একে তো মা মরা মেয়ে, তারপর তার আব্বু ছিলেন প্রবাসী। মূলত দাদির কাছে মফস্বলে বেড়ে ওঠা। পারিবারিক বংশ মর্যাদা, মেধাবী ছাত্রী ও ক্রীড়া আর সাংস্কৃতিক অঙ্গনে মোটামুটি সুপরিচিত মুখ, সহপাঠীদের কাছে স্বভাবে চঞ্চল আর চলাফেরায় ছিলেন সবার চেয়ে আলাদা। সেই প্রাইমারি স্কুলে পড়া থেকেই নানা প্রতিকূলতার মধ্যেই বেড়ে ওঠা। এসএসসির গণ্ডি পার হতে না হতেই দাদি আব্বুকে তলব করলেন দ্রুত দেশে এসে মেয়ের বিয়ে দিতে।
যেই কথা সেই কাজ। তিনি বলেন, আব্বু আমার কারণেই দ্রুত দেশে ফিরে এলেন। এসএসসি পরীক্ষার পর ঢাকায় নিয়ে এসে ১৯৯৬ সালের আগস্টে আমাকে বিয়ে দিয়ে দিলেন। মুখ ফুটে কিছু বলার সাহসও হলো না। কে কেমন কী কোনো কিছু জানার সুযোগও হলো না।
বিয়ে হলো। তাদের বিশাল সংসার। ব্যাপক আত্মীয়স্বজনের আনাগোনা, মোটকথা সনাতনী যৌথ পরিবার। মুখ বুঝে কৃত্রিম হাসি মুখে রেখে পরিবারের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অদম্য গতিতে আমি পড়াশোনা চালাতে লাগলাম। এইচএসসি যখন দেব তখন আমি আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। বাসা মিরপুর, কলেজ মালিবাগ। একাই পরীক্ষা দিতে যেতাম, পরীক্ষা শেষে এসে সংসারের কাজ করতাম। সেদিনগুলোর কথা লিখে ভাষায় ব্যাখ্যা করা মুশকিল। যাই হোক, পরীক্ষা শেষ হওয়ার এক মাস পর আমি মা হলাম। এরপর আব্বুও আমাকে একা করে পরপারে চলে গেলেন। মাথার ওপরের ছাদটাও চলে গেল। আমি হাল ছাড়িনি, সংসার আর পড়াশোনা একসঙ্গে চালিয়ে যেতে লাগলাম। সফলতার সঙ্গে এমবিএ শেষ করি, কর্মজীবনে প্রবেশ করি।
২০১৬ সালে রোড এক্সিডেন্টসহ বিভিন্ন কারণে ফ্র্যাস্টেটেড হয়ে পড়ি, অবসরকে কাজে লাগাতে এক বন্ধুর অনুরোধে ‘লিখব যা বলতে চাই’ নামে গ্রুপে জয়েন করি এবং বিভিন্ন ক্যাটাগরির প্রতিযোগিতায় পুরস্কৃত হই। সেখান থেকেই আরেক অনলাইন বন্ধুর মারফত অ্যাড হই এই ব্যাচভিত্তিক সোশ্যাল মিডিয়ার কমিউনিটিতে। খুব অল্প সময়ে আমার একাগ্রতা, দায়িত্বশীলতা এবং মননশীলতার কারণে বন্ধুদের আস্থাভাজনে পরিণত হই এবং এসএসসি ব্যাচণ্ড১৯৯৬-এর অ্যাডমিনের প্রস্তাব পাই। তখন থেকে নিজ চেষ্টায় দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি এবং প্রতিনিয়ত গ্রুপকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টায় আছি, নিবেদিত হয়ে কাজ করে যাচ্ছি আমার সামর্থ্যরে মধ্যে।
এত কিছুর পরও না বললেই না, আমার ছেলে বর্তমানে চিটাগাং ইউনিভার্সিটিতে ইকোনমিকসে অনার্স পড়ছে আর মেয়ে এইচএসসি পরীক্ষার্থী এবং কয়েকবার জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন কণ্ঠশিল্পী আর আমার কর্মক্ষেত্রেও আমি স্বমহিমায় উজ্জ্বল একজন কর্মজীবী নারী। আলহামদুলিল্লাহ।
"