প্রণব মজুমদার

  ১১ এপ্রিল, ২০২৩

অর্থনীতিতে নারী উদ্যোক্তাদের অবদান

গাইবান্ধার ‘ফুলছড়ি উপজেলার কাতলামারি গ্রামের মেয়ে রেজবীন বেগম। উত্তাল যমুনার ভাঙাগড়া দেখে কেটেছে তার ছোটবেলা। প্রকৃতিই তাকে শিখিয়েছে মনোবলে দৃঢ়চেতা হতে। তার ফল তিনি হাতেনাতে পেয়েছেন উদ্যোক্তা জীবনে প্রথম দিককার সমস্যাসংকুল দিনগুলোয়। উচ্চশিক্ষা শেষে সাভারে বেপজা পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন।

দুবছর পর যোগ দেন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। উদ্যোক্তা হওয়ার গল্পের শুরু লেদার টেকনোলজিস্ট স্বামী হাফিজুর রহমানের কাজের সূত্রে। স্বামীর চাকরির সুবাদে চামড়া খাতের বিভিন্ন কারখানা ঘুরে দেখতেন তিনি। তখনই তার ভাবনা আসে চামড়াজাত পণ্য নিয়ে নিজে কিছু করার। সেই বাসনা থেকে নেমে পড়েন কাজে। এত দিনের পরিশ্রমের সরকারি স্বীকৃতিও পেয়েছেন সম্প্রতি। রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এসএমই ফাউন্ডেশন আয়োজিত জাতীয় এসএমই মেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে বর্ষসেরা মাইক্রো উদ্যোক্তা-২০২০ পুরস্কার গ্রহণ করেন রেজবীন।

তিনি আজ সফল উদ্যোক্তা। রেজবীন বলেন, ‘শিক্ষকতায় থাকলে সমাজের একটি অংশের কাজ করতে পারব। ব্যবসায় এলে আত্মকর্মসংস্থানের পাশাপাশি আরো অনেকের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব। পাশাপাশি আয়ও বাড়বে নিজের- এমন ভাবনা থেকে স্বামীর উৎসাহে চাকরি ছেড়ে উদ্যোগে নেমে পড়েন। বেশিদিন আগের কথা নয়, ২০১২ সালে পিপলস নাইফ ইঞ্জিনিয়ারিং নামে চামড়া খাতের ব্যবহৃত ডাইসের (কাটিং নাইফ) কারখানা গড়ে তোলেন।

‘নাইফ’ ব্যবহার করে চামড়াজাত বিভিন্ন পণ্য তৈরি করা হয়। এতেই অবশ্য থেমে থাকেননি তিনি। এক্সেসরিজের বদলে জুতা তৈরিতেও আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

২০১৪ সালে একজন কর্মী ও একজন সহযোগী নিয়ে জুতা তৈরির কাজে হাত দেন রেজবীন। আশুলিয়ায় ৫০০ বর্গফুটের একটি ঘর ভাড়া নিয়ে পিপলস ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদার গুডস নামের কারখানা গড়ে তোলেন। শুরুতে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য ৭০ টাকা দামের নন-লেদারের লেডিস স্যান্ডেল তৈরি করেন। প্রথমে কারখানার সামনে টেবিলে সাজিয়েই বিক্রি করতেন। অল্প সময়ের মধ্যে পরিচিতি বাড়ে তার তৈরি জুতার। স্থানীয় হকার থেকে শুরু করে দোকানিরা পাইকারি অর্ডার দিতে শুরু করেন। এ অনুপ্রেরণা থেকে তিনি জুতা, ব্যাগ, বেল্টসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি করতে শুরু করেন। বৈচিত্র্যও আনেন পণ্যে।

নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পর বাটাকে পণ্য সরবরাহের পর থেকে মোড় ঘুরে যায় তার ব্যবসার। এরপর এপেক্সসহ বিভিন্ন কোম্পানি ও মার্কেটের দোকানগুলোয় জুতাসহ চামড়াজাত পণ্য সরবরাহ করেন। এখন ৩৫ কর্মীসহ কারখানা চালাচ্ছেন। বার্ষিক টার্নওভার ছাড়িয়েছে ৭৫ লাখ টাকা। অতি সম্প্রতি গাইবান্ধায় এসএমই মেলায় তার উৎপাদিত পণ্য বিক্রিতে বেশ সাড়া মেলে। বড় পরিসরে কারখানা করার কথা ভাবতে থাকেন অনেক দিন থেকেই।

গাইবান্ধা বিসিক শিল্পনগরী থেকে পেয়েছেন একখণ্ড জমি। যদিও অর্থের বিনিময়েই তিনি তাদের পিপলস ফুটওয়্যারের জন্য সেটি পেয়েছেন, জানালেন তিনি।

দোহার উপজেলার নারিশা এলাকার আরিফা আক্তার রানু। শখের বশে শিখেছিলেন হাতের সাহায্যে বুননের কাজ। পরে শখের কাজই আরিফাকে এনে দিয়েছে সাফল্য। দক্ষ হাতে বানানো পাট ও পুঁতির জিনিসপত্র বাজারজাত করে অল্পদিনেই সাফল্য পেয়েছেন। তার এ সুখবর ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে শ্রেষ্ঠ জয়িতা ঘোষণা করা হয়েছে তাকে।

এমন অসংখ্য জয়িতা এখন দেশের অর্থনীতির ভিতকে শক্তিশালী করে তুলছেন। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন ক্ষুদ্র ও মাঝারি নারী শিল্পোদ্যোক্তার সংখ্যা প্রায় ২৪ লাখ। অবশ্য অধিকাংশ উদ্যোক্তাকেই প্রতিষ্ঠা পেতে হচ্ছে নানা বাধা অতিক্রম করে, পথের কাঁটা সরিয়ে।

আসলে মাঠপর্যায়ের কর্মী বাহিনীর সততার ওপর সাফল্য নির্ভর করে। যারা এ খাতে নিজে মাঠে অবস্থান করেন এবং সঠিক পর্যবেক্ষণ করেন তাদের সাফল্য সুনিশ্চিত। শুধু রেজবীন বা আরিফা নন, তাদের মতো অনেক নারী এখন ক্ষুদ্র ব্যবসায় সাফল্য লাভ করছেন। আজ তারা সফল উদ্যোক্তা। দেশের বিনিয়োগ বিকাশে সফল নারীদের অবদান দিন দিন বাড়ছে।

আমাদের দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকে নারী কর্মীর অবদান পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি। একই সঙ্গে ক্ষুদ্রঋণের মতো দেশের অর্থনীতির প্রধান খাত আবর্তিত হচ্ছে প্রান্তিক নারীদের কেন্দ্র করে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়েও বাড়ছে নারীদের অবদান।

ব্যাংক, বিমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সমবায় সমিতির মতো সরাসরি আর্থিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমে নারীদের অংশগ্রহণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। নারী উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের মধ্যে নারীর সংখ্যা হিসেবে ৫৪টি স্বল্প আয়ের দেশের মধ্যে ৬ নম্বরে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। ‘মাস্টারকার্ড ইনডেক্স অব উইমেন এন্টারপ্রেনিউরস’ (এমআইডব্লিউই) জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।

জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে উদ্যোক্তার ৩১ দশমিক ৬ শতাংশই নারী। প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেই কাজ করে এ দেশের নারীরা নিজেদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলছেন। জরিপের ফলাফলে উল্লেখ করা হয়েছে, উগান্ডায় নারী উদ্যোক্তা ৩৪ দশমিক ৮ শতাংশ, বাংলাদেশে ৩১ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ভিয়েতনামে ৩১ দশমিক ৪ শতাংশ। স্বল্প আয়ের অর্থনীতির দেশগুলোয় নারীরা ব্যবসার সুযোগ পেয়ে নয়, মূলত প্রয়োজনের তাগিদেই উদ্যোক্তা হন। তাই ব্যবসার যেকোনো ধরনের সুযোগ পেলেই এসব নারী সেটি কাজে লাগান। বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৭ হাজার ৪৯০ জন নারী উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে।

আর মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের আওতায় নারী উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রয়াস কর্মসূচির আওতায় পরিচালিত হচ্ছে ‘জয়িতা’ বিপণন কেন্দ্র। তৃণমূলপর্যায়ে ১৬ হাজারের বেশি নিবন্ধিত স্বেচ্ছাসেবী মহিলা সমিতিও আছে। এ সমিতির সদস্যদের মধ্যে আছেন অসংখ্য নারী উদ্যোক্তা।

সম্প্রতি প্রকাশিত ‘বাংলাদেশে নারী এসএমই উদ্যোক্তাদের বাজার সম্ভাবনা ও অর্থায়ন বৃদ্ধি’ শীর্ষক সমীক্ষায় বলা হয়েছে : ‘ক্ষুদ্র ও মাঝারি নারী শিল্পোদ্যোক্তাদের বার্ষিক ঋণ চাহিদার ৬০ শতাংশই পূরণ করতে পারছে না ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।’

নারী উদ্যোক্তাদের ব্যাংকঋণ পাওয়া সহজ করতে জামানত ছাড়াই ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। প্রতি বছরই ক্ষুদ্র ও মাঝারিশিল্পে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে গ্রামপর্যায়ে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেড়েছে। গ্রামের নারীদের এ ক্ষেত্রে আগ্রহী করার জন্য সরকারি ব্যাংকগুলো প্রতি বছরই সচেতনতামূলক বিভিন্ন প্রচারাভিযানের ব্যবস্থা করে থাকে। তা ছাড়া পুনঃঅর্থায়ন তহবিলে রয়েছে ৫১ শতাংশ।

নারীরা ঋণ নিয়ে বাঁশ ও মাটির তৈরি তৈজসপত্র, ব্লক-বুটিকের কাজ ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের অর্থ লগ্নি করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৮ সালে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ৬৮ লাখ ৭ হাজার ৫২২টি এসএমই উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে ১৫৯৫ দশমিক ১০ বিলিয়ন টাকা, যা স্বনির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ১৬১০ দশমিক ৩২ বিলিয়ন টাকার ৯৯ দশমিক ১ শতাংশ। আর এ ঋণের অধিকাংশই হচ্ছেন নারী উদ্যোক্তারা। নারীদের সহজ শর্তে চার থেকে পাঁচ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া হলে তারা সফলভাবে বিনিয়োগে আসতে পারেন। কিন্তু ব্যাংকঋণ পেতে নারীদের নানা হয়রানির শিকার হতে হয়।

জাতীয় শিল্পনীতি ২০১৬-এ অবশ্য বলা হয়েছে : এসএমই খাতে ঋণের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তার মধ্যে বিতরণ করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও নির্দেশনা রয়েছে : পুনঃঅর্থায়ন ঋণের কমপক্ষে ১০ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের দিতে হবে। তবে এ নির্দেশনা মানছে না অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close