শেলী সেনগুপ্তা

  ০৪ এপ্রিল, ২০২৩

আলোকিত নারী কাদম্বিনী গাঙ্গুলী

ব্রিটিশ ভারতের প্রথম দুজন নারী স্নাতকের একজন ছিলেন কাদম্বিনী। শুধু তা-ই নয়, ইউরোপীয় চিকিৎসাশাস্ত্রে শিক্ষিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নারী চিকিৎসকও ছিলেন তিনি

ঊনবিংশ শতাব্দীতে যখন চার দেয়ালের বাইরে বের হওয়া নারীদের জন্য ছিল দুঃসাধ্য, তখনই চলমান প্রথা ভেঙে কাদম্বিনী গাঙ্গুলী হয়ে ওঠেন বাংলার প্রথম নারী চিকিৎসক। সাফল্যের পথটা মসৃণ ছিল না তার, ছিল কণ্টকশোভিত। তৎকালীন সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দীর্ঘপথ একাই হেঁটেছেন এবং প্রমাণ করে গেছেন রাস্তায় হাঁটার চেয়ে অন্যদের জন্য রাস্তা প্রস্তুত করা কষ্টকর।

কাদম্বিনী গাঙ্গুলী ১৮ জুলাই ১৮৬১ সালে বিহারের ভাগলপুরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম ব্রজকিশোর বসু। বাবাই ছিলেন তার প্রথম পথপ্রদর্শক। ভাগলপুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক ব্রজকিশোর বসুর মূল বাড়ি ছিল বরিশালের চাঁদসীতে। তিনি নারী অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ভাগলপুর মহিলা সমিতি স্থাপিত হয়।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ১৮৬১ সাল নানাভাবে বিশেষায়িত। এ বছরই জন্মগ্রহণ করেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, ডাক্তার নীলরতন সরকার। এ বছরই প্রকাশিত হয় মাইকেল মধুসূদন দত্তের অমর সৃষ্টি মেঘনাদ কাব্য। এ বছরই জন্মগ্রহণ করেন বাংলার প্রথম গ্র্যাজুয়েট ও চিকিৎসক কাদম্বিনী বসু গাঙ্গুলী।

বাবার ইচ্ছা এবং প্রচেষ্টাকে সঙ্গে নিয়ে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়, এ ধারাবাহিকতায় তিনি গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি অর্জন করেন। গ্র্যাজুয়েশনের পর সবাই ভেবেছিলেন, এবার বুঝি কাদম্বিনী বসু এমএ ক্লাসে ভর্তি হয়ে তাক লাগিয়ে দেবেন। কিন্তু হলো তার বিপরীত। সবাইকে অবাক করে নিজের শিক্ষক দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় ডাক্তারি পড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। সেকালের পরিপ্রেক্ষিতে নারীদের ডাক্তারি পড়া কার্যত অসম্ভব ছিল। কিন্তু উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে স্ত্রী শিক্ষাব্রতী, অবলাবান্ধব পত্রিকার সম্পাদক দ্বারকানাথ এবং কাদম্বিনীর অক্লান্ত প্রয়াসে নারীদের জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানে পড়াশোনা করার দ্বার খুলে যায়।

এজন্য তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে কঠিন থেকে কঠিনতর পথ। তবে বলা হয়ে থাকে, লক্ষ্য যদি হয় সঠিক তাহলে পথচলা হয় সুদৃঢ় পদক্ষেপে। কাদম্বিনী গাঙ্গুলী তার গন্তব্য অভিমুখে হেঁটে গেছেন সব বাধা অগ্রাহ্য করে। এ পথে তার সঙ্গে ছিলেন তার শিক্ষক, বিখ্যাত সমাজসংস্কারক ও মানবদরদী সাংবাদিক দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী, যিনি পরে তার স্বামী হয়েছিলেন।

চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ার অনুমতি পাওয়ার পরও বিরোধীবাদীরা ঘোষণা দেন, অবিবাহিত নারী চিকিৎসাশাস্ত্রে পাঠ নিতে পারবেন না।

কিন্তু ইচ্ছা যেখানে দুর্বার, সেখানে যেকোনো বাধাই তুচ্ছ। মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য তিনি তার শিক্ষক দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীকে বিয়ে করেন। তখন কাদম্বিনীর বয়স ছিল একুশ এবং দ্বারকানাথ উনচল্লিশ বছর বয়সের বিপত্নীক।

এভাবেই দুর্গম পথের প্রথম মশালবাহিকা হলেন কাদম্বিনী বসু। এরপর ১৮৮৪ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজের প্রথম ছাত্রী হিসেবে ভর্তি হন। মেডিকেল কলেজের নিয়ম ছিল, বিএ পাস করলেই বিনা খরচে মেডিসিন পড়ার সুযোগ পাওয়া যাবে, কাদম্বিনী গাঙ্গুলী এ সুযোগ নিয়ে দেশের অন্যতম প্রধান চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হলেন প্রথম ছাত্রী হিসেবে, যুগান্তের এক রুদ্ধদ্বার খুলে দিলেন নারীদের জন্য। সে সময় তাকে মাসিক কুড়ি টাকা জলপানিও দেওয়া হয়।

কিন্তু শেষ পরীক্ষার সময় কলেজের অধ্যাপক ডাক্তার রাজেন্দ্র চন্দ্র প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষায় এক নম্বর কম দিয়ে কাদম্বিনী গাঙ্গুলীকে ফেল করিয়ে দেন। বিষয়টি ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

অবশেষে প্রিন্সিপাল সাহেবের সার্টিফিকেট পেয়ে কাদম্বিনী অ্যালোপ্যাথি ডাক্তার হয়েছিলেন। ১৮৯০ সালে লেডি ডাফরিন হাসপাতালে চিকিৎসক রূপে তিনি নিযুক্ত হয়েছিলেন। তার মাসিক বেতন নির্ধারিত হলো ৩০০ টাকা।

লেডি ডাফরিন হাসপাতালে চিকিৎসক থাকার সময় তিনি বিলিতি ডিগ্রির কদর উপলব্ধি করেন এবং স্বামী দ্বারকানাথের অতুলনীয় উৎসাহ, প্রেরণা ও সহায়তায় এক বছরের ছেলেসহ পাঁচটি ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে স্বামী এবং সৎ মেয়ে বিধুমুখীর তত্ত্বাবধানে রেখে কাদম্বিনী গাঙ্গুলী জাহাজে বিলেত যাত্রা করেন। সময়টি ছিল ১৮৯২ সাল। লন্ডন পৌঁছানোর বিশ দিনের মধ্যে তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আবেদনপত্র জমা দেন এবং খুব সহজেই ভর্তির সুযোগ পান।

বিলেতে থাকার সময়ও তিনি পরিধান করতেন শাড়ি, ফুলহাতা ব্লাউজ। সেই সময় বিলেতের বুকে বিলিতি পোশাককে অগ্রাহ্য করে ভারতীয় পোশাকে ক্লাস করাটা কত কঠিন ছিল, সেটা আজ হয়তো বোঝা সম্ভব নয়।

কাদম্বিনী গাঙ্গুলী এডিনবরা, গ্লাসগো ও ডাবলিন উপাধি নিয়ে স্বদেশে ফিরলেন। এবার তিনি হলেন একমাত্র ভারতীয় ডাক্তার, যিনি বিলিতি ডিগ্রিধারী। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

ডাফরিন হাসপাতালে এবার তিনি সিনিয়র ডাক্তারের পদ পেলেন, এক বছরের মধ্যে পান ইডেন ফিমেল হাসপাতালে ডক্টর ইনচার্জের পদ। কর্তৃপক্ষ আর তাকে অগ্রাহ্য করতে পারল না। তিনি হলেন চিকিৎসাবিদ্যায় প্রথম ভারতীয় নারী অধ্যাপক।

তিনি ১৮৮৯ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রকাশ্য অধিবেশনে যোগ দেন। ১৮৯০ সালে কলকাতা অধিবেশনে বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন। কলকাতা অধিবেশনে তিনি ছিলেন প্রথম নারী বক্তা।

১৯০৬ সালে কলকাতায় নারীদের কনফারেন্সের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। তখনকার দক্ষিণ আফ্রিকার ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী ছিল প্রবল জাতিবিদ্বেষী। সেখানকার ট্রান্সভালের কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদ জানাতে কলকাতায় সভার আয়োজনের প্রধান হোতা ছিলেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলি। শুধু তাই নয়, গান্ধীজির সহকর্মী হেনরি পোলক প্রতিষ্ঠিত ট্রান্সভাল ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সাহায্যের জন্য কলকাতায় যে সভার আয়োজন করা হয়, সেই সভার সংগঠক ও প্রথম সভাপতিও ছিলেন তিনি। ১৯১৪ সালে গান্ধীজির কলকাতায় আসা উপলক্ষে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের যে সভা হয়, সেই সভায় সভা পরিচালনা করেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলীই।

এ ছাড়া আরো অনেক সামাজিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। সে সময় আসামের চা-বাগানগুলোতে শ্রমিকদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাতেন ইংরেজ বাগান-মালিকরা। দ্বারকানাথ আসামের চা বাগানের শ্রমিকদের কাজে লাগানোর পদ্ধতির তীব্র নিন্দা করেন। স্বামীর সঙ্গে কাদম্বিনী গাঙ্গুলীও প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠেন।

ভারতের বিভিন্ন খনিতে কর্মরত নারীদের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যহানির ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে এ বিষয়ে কার্যকর পদ্ধতি গ্রহণ করার জন্য পরামর্শ দেন দ্বারকানাথ-কাদম্বিনী দম্পতি। ইউরোপীয় মালিকদের অত্যাচারের খবর দ্বারকানাথের প্রতিষ্ঠিত এবং সম্পাদিত সাপ্তাহিক পত্রিকা সঞ্জীবনীতে প্রকাশিত হয় এবং এর ফলে গণসচেতনতার মাধ্যমে এক আন্দোলন শুরু হয়েছিল।

১৯২২ সালে সরকার বিহার ও ওড়িশার খনির নারীশ্রমিকদের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য যে কমিটি করা হয়, তারই একজন সদস্য হিসেবে কাদম্বিনী গাঙ্গুলী বিহার ও ওড়িশা যান।

তার সময়ে দাঁড়িয়ে কাদম্বিনী বুঝেছিলেন, কর্মরতা মায়েদের সমস্যা, তাই তিনি কলকাতা করপোরেশনে আবেদন করেছিলেন শিশুদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার খোলার জন্য, যা আজ পৃথিবীর প্রতিটি দেশে সানন্দে সমাদৃত।

তিনি ১৮৯০ সালে রাজমাতার চিকিৎসার জন্য নেপালে যান। সেখানে এ মহৎপ্রাণ মানবীর হাত ধরে আধুনিক চিকিৎসার সূত্রপাত ঘটে। ইতিহাসের পাতায় কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

বলা যায়, ব্রিটিশ ভারতের প্রথম দুজন নারী স্নাতকের একজন ছিলেন কাদম্বিনী। শুধু তা-ই নয়, ইউরোপীয় চিকিৎসাশাস্ত্রে শিক্ষিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নারী চিকিৎসকও ছিলেন তিনি। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে পাশ্চাত্য চিকিৎসায় ডিগ্রি অর্জন করে হয়ে ওঠেন ভারতের প্রথম দিককার একমাত্র নারী চিকিৎসক।

এজন্য তাকে কাদম্বিনী গাঙ্গুলীকে সইতে হয়েছে শত অবহেলা। তবে তিনি নেতিবাচক ধারণা ভেঙে তার দিকে আঙুল তোলা মানুষগুলোর মন জয় করেছেন বারবার।

হীরকখণ্ডের মতো ছিল কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর বহুমুখী ব্যক্তিত্ব। প্রতিভা, অপরিসীম সাহস ও আত্মশক্তির বলে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একজন অত্যন্ত সফল নারী চিকিৎসকরূপে, অসংখ্য প্রতিবন্ধকতাকে নির্ভয়ে জয় করে রেখেছিলেন অতুলনীয় কীর্তির স্বাক্ষর।

তার হাত ধরেই আজকের চিকিৎসাসেবা প্রদানের সুযোগ পেয়েছেন নারীরা। নিজেকে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত করে সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখেছেন নারীরা। প্রমাণ করতে শিখেছেন পুরুষের চাইতে নারী কোনো অংশেই কম নয়। বরং নারী-পুরুষের সমান চেষ্টাই সমাজ ও দেশকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।

কাদম্বিনী গাঙ্গুলী তার সময়ের থেকে তো বটেই, সম্ভবত বর্তমান শতাব্দীর থেকেও এগিয়ে থাকা একজন আশ্চর্য মানুষ, চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিশাল ক্ষেত্রে যিনি নিজের আসনটি অর্জন করে নিয়েছিলেন মেধা, আত্মবিশ্বাস ও অপরাজেয় মনোভাবের শক্তিতে। এই অমরপ্রাণ ৩ অক্টোবর ১৯২৩ দেহান্তরে চলে যান।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close