শাহানারা স্বপ্না
গুলবদন বেগম
উপমহাদেশের প্রথম নারী ইতিহাসবিদ
রাজকীয় বালাখানার এক খাস কামরায় লাল মখমলের ওপর সোনালি জরির কারুকাজ করা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে মোগল রাজকন্যা গুলবদন। পুরো ঘরজুড়ে পারস্যের জৌলুশী কাজের কোমল গালিচা বিছানো। এক কোণে নকশাদার সোনালি ধাতুর পাত্রে ইয়েমেনি আগরবাতি জ্বলছে। স্বর্গীয় সৌরভ আর চন্দন কাঠের সুগন্ধভরা ভারী বাতাস মৌচাকের মতো কক্ষময় প্রসাদের অলিন্দে পল্লবিত। অপূর্ব কারুকার্য খচিত দেয়ালে শোভা পাচ্ছে পূর্বপুরুষ তৈমুরের অলংকৃত ছবি। পাশেই তার স্মারক, ঝকঝকে স্বর্ণপি-ে খোদাই করা ক্রদ্ধ বাঘ- যেন এখুনি গর্জে উঠে লাফিয়ে পড়বে!
গল্প বলার প্রস্তুতি হিসেবে গুলবদন স্বর্ণনির্মিত পানদান থেকে সুরভিত পান তুলে মুখে পুরলেন। সামনে চাঁদির রেকাবিতে ফলমূল সাজানো। তার চারদিক ঘিরে বসেছে ভাইপো-ভাইজি ও ভাতৃবধূরা। উৎসুক মুখে অত্যন্ত তাজিমের সঙ্গে তাকিয়ে। গুলবদনের অপরূপ মুখচ্ছবি থেকে অপূর্ব একটা দ্যুতি বিচ্ছুরিত হয়ে অপেক্ষমাণ মুখগুলোর ওপর স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিল। তাদের নিস্তব্ধ মনোযোগ গুলবদনের দৃঢ় মনোভাবকে আরো শানিত করে। একটু বিরতি নিয়ে রাজপরিবারের নারী কথকের ভূমিকা নিয়ে বলতে থাকেন-
‘আমাদের মহান পূর্বপুরুষরা যেমন ছিলেন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, তেমনি পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল। প্রতিটি সদস্যের প্রতি মায়ামমতা কর্তব্য পরায়ণতা ছিল অপরিসীম। তারা ছিলেন দুঃসাহসী যোদ্ধা, সুশাসক, কবি ও শিল্পী, কালজয়ী স্থাপত্য নির্মাণকারী এবং পৃথিবীর বুকে অসংখ্য রাজ্য জয়কারী। কীভাবে সংকল্পে অটল থেকে নিজ লক্ষ্যে দুর্বার হতে হয়, পরাজয়ে হতাশ না হয়ে পেছনে না তাকিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হয়, জীবনের প্রতি মুহূর্তে কঠিন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয়, তারা তা শিখিয়েছেন। আমরা বহন করছি মহান যোদ্ধা তৈমুর আর বিজেতা চেঙ্গিস খাঁর রক্ত!’
গুলবদনের ভ্রুভঙ্গি, স্বরক্ষেপণ, উদ্দীপ্ত কণ্ঠ আর উচ্চকিত গল্প বলার কৌশলে ধমনী টগবগ করে ওঠে ঐতিহাসিক যোদ্ধাদের উত্তরসূরি শ্রোতাদের। হার না মানা বীরোচিত শিক্ষার মূল অংকুরিত হয় তাদের মনে এবং অনুকরণীয় আদর্শ সৃষ্টি হয় তাদের সামনে। তিনি তাদের দিগি¦জয়ী মহান পূর্বপুরুষদের গল্প, পিতা সম্রাট বাবরের যুদ্ধজয়, বিরাট সৈন্যসহ অভিযান, যুদ্ধের ময়দান থেকে ক্লান্ত সৈনিকের ফিরে আসার গল্প, বিজয়ের পর আনন্দ উৎসব ইত্যাদির চিত্রকথা একের পর এক তুলে ধরেন নতুন প্রজন্মের সামনে। এর মাধ্যমে ছোটরা যেমন শিক্ষা ও আনন্দ পেত, তেমনি দুর্যোগের সময় দূর হতো ভয়ভীতি। গৌরবময় ঐতিহ্যের ধারা প্রবাহিত হয় বংশানুক্রমে। অনন্য সাধারণ স্মৃতিশক্তি গুলবদনের। একবার যা দেখেছেন কখনো তা ভোলেন না। যেকোনো ঘটনার সরস ও জীবন্ত পরিবেশনে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তাই, মোগল পরিবারের শিশুদের গল্পচ্ছলে শিক্ষার সোপান তৈরির ভার কাঁধে পড়েছিল।
সম্রাট বাবর হিন্দুস্থান জয়ের দুই বছর আগে ১৫২৩ সালে শাহজাদী গুলবদন বেগমের জন্ম হয় কাবুলে। কাবুল ছিল বাবরের শাসিত এলাকা এবং পিতৃভূমি। এছাড়া বাদাখশান, কন্দুজ, সোয়াত, বাজুসহ আরো কয়েকটি এলাকা তার অধিকারে ছিল। পিতা আদর করে তার নাম রাখেন গুলবদন, অর্থাৎ ফুলের তো অবয়ব- লাবণ্য যার গোলাপের মতো, গোলাপ রাজকুমারী। গুলবদন ছিলেন বাবার স্নেহধন্য প্রিয় কন্যা। পিতার দিক থেকে তুর্কি তৈমুর লঙ আর মায়ের দিক থেকে চাঘতাই মোঙ্গল, ইতিহাসে আলোড়ন সৃষ্টিকারী মধ্য এশিয়ার এ দুই জাতির দুই সম্ভ্রান্ত পরিবারের আভিজাত্যের মেলবন্ধন ঘটেছিল ইতিহাসের বিস্ময় গুলবদনের চেহারা ও প্রকৃতিতে। তার মায়ের নাম দিলদার বেগম।
বাবরের পুত্র হুমায়ুনের জন্মের পরে আরো ক’টি সন্তান মারা গেলে স্ত্রী মাহম বেগম শোকে অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েন। শোকাতুর মা সপত্নী দিলদার বেগমের কাছ থেকে চেয়ে গুলবদনকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন এবং নিজের সন্তানের মতোই আদর যত্নে লালন পালন করেন। তিনি গুলবদনের ছোট ভাই হিন্দালকেও বড় করেছিলেন। হুমায়ুন সৎভাই হলেও অত্যন্ত আদর-সম্মান করতেন। গুলবদনও সারা জীবন সহৃদয়তার সঙ্গে হুমায়ুনের সুখণ্ডদুঃখের সঙ্গী হয়েছেন। এ থেকেই মোগল পরিবারের অন্দর মহলের সৌহার্দ্যপূর্ণ পারিবারিক চিত্র পাওয়া যায়।
কাবুলের সংগ্রামী মোঙ্গল শাসক জহির উদ্দিন মুহম্মদ বাবর ১৫২৬ সালে ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করে ভারতে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে খানুয়ায় রানাসঙ্গকে পরাজিত করে সাম্রাজ্যের ভিত্তি মজবুত করেন। এরপর ১৫২৮ সালে বাবর তার পরিবার পরিজনকে হিন্দুস্থানে নিয়ে আসেন। এ সময় গুলবদন বেগম ছিলেন ছয় বছরের। মাহম বেগমের সঙ্গে তিনি পিতার বিজিত নতুন দেশ ভারতে আসেন।
এর দু’বছর পর পনের শ তিরিশ সালে বাবর মৃত্যুবরণ করেন এবং বড় ভাই হুমায়ুন সিংহাসনে বসেন। মাত্র আট বছর বয়সেই পিতাকে হারান গুলবদন। বড় ভাই হুমায়ুন নিখুঁতভাবে পিতার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি গুলবদনের শিক্ষার জন্য পারস্যের ইরান থেকে শিক্ষিকা নিয়ে আসেন। হেরেমে শিক্ষিকাদের পদবি ছিল ‘আতুন’। গুলবদন পড়াশোনায় ছিলেন খুবই আগ্রহী ও মনোযোগী। অধ্যবসায়ের সঙ্গে তিনি জ্ঞানচর্চা করতে থাকেন।
গুলবদনের চেয়ে প্রায় চৌদ্দ বছরের বড়ভাই বাদশাহ হুমায়ুনও ছিলেন অত্যন্ত বিদ্বান আর বইপড়ুয়া। দিনের পর দিন তার কেটে যেত বইয়ে মুখ ডুবিয়ে। বাদশাহ হুমায়ুনসহ তাদের প্রত্যেক ভাইয়ের নিজেদের রাজ্যে ছিল সযত্নে গড়ে তোলা আলাদা লাইব্রেরি। পিতা বাবরের মতোই পরবর্তী প্রতিটি মোগল রাজপুরুষরা ছিলেন জ্ঞানচর্চায় অগ্রগামী এবং পৃষ্ঠপোষক।
গুলবদন ভাইদের অনুকরণে লাইব্রেরিতে বসে বেশিরভাগ সময় বই পড়ায় নিমগ্ন থাকতেন। নিজ মাতৃভাষা তুর্কি, চাগতাই হলেও তিনি ফার্সি ভাষায় পা-িত্য অর্জন করেন। হুমায়ুনের রাজত্বকালে গুলবদন সবসময় তার পাশে পাশেই ছিলেন। বাদশাহ আকবরের সময়ে পরিণত বয়সে নিজ আত্মজীবনী রচনা করেন ফার্সি ভাষায়। তার লেখায় হুমায়ুনের রাজত্বের উত্থানপতন, তার কোমল হৃদয়মন ও মানসের কথা, মোগল হেরেমের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয় স্বচ্ছরূপে উঠে এসেছে। পরবর্তীকালে যা ‘হুমায়ুননামা’ হিসেবে প্রকাশিত হয় এবং ইতিহাসের জগতে সাড়া ফেলে দেয়।
একথা স্বীকৃত সত্য যে, ভারত উপমহাদেশের প্রাচীনকালের লিখিত কোনো ধারাবাহিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। ভারতের ইতিহাস লেখা শুরু হয় মুসলমান আগমনের পর থেকে। মুসলমানরাই প্রথম তাদের রাজ্যপাঠের খবরের বিবরণ তথা এদেশের ইতিহাস লিখতে শুরু করেন। মধ্যযুগের প্রত্যেক মুসলমান শাসক তার সমসাময়িক কালের বিবরণ লিখে রাখতেন। এজন্য রাজদরবারে আলাদাভাবে ইতিহাসবিদদের পৃষ্ঠপোষকতা করা হতো।
মোগল যুগের সূচনাকারী শ্রেষ্ঠ বাদশাহ মহামতি বাবরের অভ্যাস ছিল ‘রোজনামচা’ বা ডায়েরি লেখা। তিনি তারিখ উল্লেখ করে তার প্রতিদিনের ঘটনাবহুল জীবনের কথা, যুদ্ধ, সৈন্য পরিচালনা, জয়-পরাজয়, মানসিক ভাবাবেগ, পুত্র-কন্যাদের জন্ম, আনন্দণ্ডবেদনা, তার জীবনে ঘটে যাওয়া প্রতিটি স্মরণীয় বিষয় লিখে রাখতেন। ফার্সি ও তুর্কি ভাষায় লিখিত রোজনামচাটি পরবর্তীতে ‘বাবরনামা’ হিসাবে প্রকাশ পায় এবং বিশ্ব ইতিহাস ও সাহিত্যভাণ্ডারে অতুলনীয় সৃষ্টির মর্যাদা লাভ করে।
বাদশাহ বাবরের কন্যা, বাদশাহ হুমায়ুনের বোন এবং বাদশাহ আকবরের ফুফু গুলবদন বেগম। শৈশবকাল থেকেই গুলবদন অসাধারণ বুদ্ধিবৃত্তি, প্রখর ব্যক্তিত্ব ও তীক্ষèধী ও অতুলণীয় স্মৃতিসম্পন্ন ছিলেন। অসম্ভব মেধাবী গুলবদন ছিলেন নম্র ও মধুর স্বভাবের। ভাই-বোনদের প্রতি ছিল অগাধ মমতা এবং স্নেহ। হুমায়ুনের স্ত্রী হামিদা বানুর সঙ্গে সখ্য ছিল সারা জীবন ধরে। পারিবারিক স্মরণীয় ঘটনাগুলো তিনি হবহু মনে রাখতে পারতেন। এজন্যই স্মৃতিচারণের মাধ্যমে লিখতে পেরেছিলেন ‘হুমায়ুননামা’র মতো ঐতিহাসিক রচনা। গুলবদন বেশিরভাগ সময় প্রাসাদে নিজ পরিবারের সঙ্গেই থেকেছেন। সতের বছর বয়সে আত্মীয় সম্পর্কের চাগতাই মোগল খিজর খাজা খানের সঙ্গে বিবাহ হয়। তার শেষজীবন কাটে সম্রাট আকবরের কাছে। উপমহাদেশের গুলবদনই প্রথম নারী ইতিহাসবিদ। তার অসামান্য অবদান নিয়ে চর্চা করা সময়ের দাবি। মহাকালের ইতিহাসে তার লেখনী অমরতা পেয়েছে এবং উপমহাদেশের প্রথম নারী ইতিহাসবিদ হিসেবে গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।
"