reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ১৪ মার্চ, ২০২৩

মুক্তিযুদ্ধের তিন নারী বীরপ্রতীক

মুক্তিযুদ্ধ প্রকৃত অর্থেই ছিল জনযুদ্ধ। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এই যুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন সমানভাবে। নারীরা অত্যাচারিত বা ধর্ষিত হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে, এটা যেমন স্থান পেয়েছে, তেমনি স্থান পেয়েছে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নারীরা লড়াই করেছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন এমন নারী মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি হিসেবে বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছেন তিন নারী। তারা হলেন ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম, তারামন বিবি ও কাঁকন বিবি। আমরা এই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি

সিতারা বেগম

১৯৪৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর কিশোরগঞ্জে জন্ম সিতারা বেগমের। বাবা মোহাম্মদ ইসরাইল এবং মা হাকিমুন নেসা। তবে বৈবাহিক সূত্রে তিনি সিতারা রহমান নামে পরিচিত। স্বাধিকার আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে কুমিল্লা সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন সিতারা। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের ভেতর তিনি ছিলেন তৃতীয়। তার বাবা ইসরাইল মিয়া পেশায় ছিলেন আইনজীবী। সিতারার বড় ভাই এটিএম হায়দারও সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। তার সঙ্গেই কিশোরগঞ্জে শৈশব কাটান সিতারা বেগম। সেখান থেকে মেট্রিক পাস করার পর হলিক্রস কলেজে থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ঢাকা মেডিকেল থেকে পাস করার পর তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেনামেডিকেলে লেফটেন্যান্ট হিসেবে যোগ দেন।

১৯৭০ সালের উত্তাল দিনগুলোতে সিতারা বেগম কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে নিয়োজিত ছিলেন। সে সময় তার বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধা মেজর এটিএম হায়দার পাকিস্তান থেকে কুমিল্লায় বদলি হয়ে আসেন। তিনি কুমিল্লার তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিতারা ও তার ভাই হায়দার ঈদের ছুটি পালন করার জন্য তাদের কিশোরগঞ্জের বাড়িতে যান। কিন্তু সে সময় দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। হায়দার তার বোনকে ক্যান্টনমেন্টে আর ফিরে না যাওয়ার জন্য বলেন। পরে তিনি তার বোন সিতারা, বাবা-মা ও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে ভারতে পাঠান।

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য মেলাঘরে বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল নামে ৪৮০ শয্যার একটি হাসপাতাল ছিল। ঢাকা মেডিকেলের শেষ বর্ষের অনেক ছাত্র সেখানে ছিল। ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা সেক্টর-২-এর অধীনে সেখানের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা ধরে দিনের পর দিন চিকিৎসক হিসেবে এ হাসপাতালে অসাধ্যসাধন করে গেছেন সিতারা। তার রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিপুণ পরিচালনার ফলে বিপুলসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধরত ভারতীয় সেনাকে মৃত্যুর মুখ থেকে সুস্থ করে আনা সম্ভব হয়।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রেডিওতে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সংবাদ শুনে ঢাকা চলে আসেন ড. সিতারা। পরে ১৯৭৫ সালে তার ভাই মেজর হায়দার নিহত হলে ডা. সিতারা ও তার পরিবার বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে থাকা শুরু করেন।

তারামন বিবি

স্বাধীনতাযুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে বীরপ্রতীক খেতাব প্রদান করে। তারামন বিবি ১৯৫৭ সালে কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুর উপজেলার শংকর মাধবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আবদুস সোহবান এবং মায়ের নাম কুলসুম বিবি। তারামন বিবি ১১ নম্বর সেক্টরে নিজ গ্রাম কুড়িগ্রামের শংকর মাধবপুরে ছিলেন। তখন ১১ নম্বর সেক্টরের নেতৃত্বে ছিলেন সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের। মুহিব হাবিলদার নামে এক মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন। যিনি তারামনের গ্রামের পাশের একটি ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি তারামনকে ক্যাম্পে রান্নাবান্নার জন্য নিয়ে আসেন। তখন তারামনের বয়স ছিল মাত্র ১৩ কিংবা ১৪ বছর। কিন্তু পরে তারামনের সাহস ও শক্তির পরিচয় পেয়ে মুহিব হাবিলদার তাকে অস্ত্র চালনা শেখান। পরে সহকর্মীদের কাছ থেকে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নিয়ে তাদের সঙ্গে অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার মুক্তিযুদ্ধে তারামন বিবিকে তার সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ‘বীরপ্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৯৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর তৎকালীন সরকার তারামন বিবির হাতে বীরত্বের পুরস্কার হাতে তুলে দেয়।

তারামন বিবির স্বামীর নাম আবদুল মজিদ। এই দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। তিনি কুড়িগ্রামের রাজিবপুরে স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন। তারামন বিবি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর তিনি নিজ বাড়িতে মারা যান। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে রাজিবপুর উপজেলার কাছারিপাড়া তালতলা কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়।

কাঁকন বিবি

কাঁকন বিবি ১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের এক বীরযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর বিপক্ষে মুক্তিবাহিনীর হয়ে গুপ্তচরের কাজ করেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য তাকে বীর প্রতীক খেতাব দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। তার বাড়ি সুনামগঞ্জের দোয়ারা বাজার উপজেলার লীপুর ইউনিয়নের ঝিরাগাঁও গ্রামে।

কাঁকন বিবির আসল নাম কাঁকাত হেনিনচিতা। আদিবাসী সম্প্রদায় খাসিয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এই বীর নারী। তার মূল বাড়ি ছিল ভারতের খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে। ১৯৭০ সালে দিরাই উপজেলার শহীদ আলী নামের একজনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর তার নতুন নাম হয় নুরজাহান বেগম। ১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ তিনি এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ায় তার স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্য হয় এবং একপর্যায়ে তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়। পরে এপ্রিল মাসে কাঁকনের সঙ্গে ইপিআর সৈনিক মজিদ খানের বিয়ে হয়। মজিদ তখন কর্মসূত্রে সিলেট ইপিআর ক্যাম্পে থাকতেন। বিয়ের দুই মাস পর আগের স্বামীর ঘর থেকে সখিনাকে আনতে যান। মেয়েকে নিয়ে আসার পর তিনি আর স্বামী মজিদকে পান না। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন মজিদ বদলি হয়ে দোয়ারাবাজার সীমান্ত এলাকার কোনো এক ক্যাম্পে আছেন।

১৯৭১ সালের জুন মাস। ঠিক করেন দোয়ারাবাজার যাবেন স্বামীকে খুঁজতে। শহীদ আলী নামের একজনের কাছে শিশুকন্যা সখিনাকে রেখে দোয়ারাবাজারের টেংরাটিলা ক্যাম্পে যান। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনীরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। দিনের পর দিন অমানসিক নির্যাতন করে তাকে ছেড়ে দেয় তারা। রাগে-ক্ষোভে-দুঃখে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মীর শওকতের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেন। তার ওপর দায়িত্ব পড়ে গুপ্তচর হিসেবে তথ্য জোগাড়ের। তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানিদের কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেন। তার সংগৃহীত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে মুক্তিযোদ্ধারা অনেক সফল আক্রমণ চালান।

তারপর কাঁকন বিবি অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নেন মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলীর কাছে। প্রায় ২০টি যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন তিনি। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে টেংরাটিলায় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিলে গুলিবিদ্ধ হন। মুক্তিবেটি নামে পরিচিত কাঁকন বিবি দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর আড়ালে ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় ২৫ বছর পর বীর মুক্তিযোদ্ধা কাঁকন বিবিকে ১৯৯৬ সালে ‘বীরপ্রতীক’ উপাধি দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের ২১ মার্চ ১০৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close