মৃণাল সরকার মিলু

  ১৭ জানুয়ারি, ২০২৩

আমাদের শিক্ষক অঞ্জলী রানী

শি-তে শিষ্ঠাচার, ক্ষ-তে ক্ষমাশীল, ক-তে কর্তব্য পরায়ণ আর এই তিনটি গুণের সমন্বয়ে হন একজন আদর্শ শিক্ষক। প্রতিটি মানুষের শিক্ষা জীবনে অনেক শিক্ষকের সান্নিধ্যে আসতে হয়। তাদের মধ্যে কিছু শিক্ষক থাকেন যাদের প্রতি সারা জীবন ছাত্রের শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে। আর ছাত্র যত বয়সি হোক ওইসব শিক্ষকের সালাম, কদমবুসি করতে কুণ্ঠাবোধ করেন না।

মূলত একাল আর সেকালের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের মধ্যে সময়ের পরিক্রমায় পার্থক্য এসেছে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সংকল্প কবিতার দুটি চরণ না বলেই নয়, তাহলো- ‘বিশ্ব জগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।’ বর্তমান কালের শিক্ষকরা নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণসহ তথ্যপ্রযুক্তিতে অধিকতর পারদর্শী। তাদের শেখার ও জানার পরিধিটা এখন অনেক সহজতর ও সহজলভ্য বর্তমান প্রযুক্তির যুগে। আর আগের দিনের শিক্ষকরা রাত জেগে কাজের ফাঁকে বই পড়ে ও বিভিন্ন জ্ঞানী-গুণীদের সান্নিধ্যে গিয়ে নিজেরাও জ্ঞানে-গুণে সমৃদ্ধ হয়েছেন। যা সে সময়ে শ্রেণিতে পাঠদানকালে শিক্ষার্থীদের অকাতরে আত্মস্থ করাতেন। এতে প্রাইভেট পড়ানো, কোচিং করানো এসব বিষয় ছিল গৌণ। কিন্তু বর্তমানে এসব বিষয় মুখ্য হয়ে উঠেছে। আর পড়ালেখার পার্থক্যটাও অনুমান করা যায়। তবে এ কথা ঠিক সেকালে পড়ালেখা অনেকটাই শিক্ষক নির্ভর ছিল। তাই শিক্ষকদের সান্নিধ্যে এসে শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতেন। তাই শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রদের শ্রদ্ধাবোধটাও গভীর হয়। জীবনভর ছাত্ররা কৃতজ্ঞচিত্তে সেইসব শিক্ষককে স্মরণ করেন। তাদেরই একজন আমার ও আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অঞ্জলী রানী ঘোষ।

আমি যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ি তখন তৃতীয় শ্রেণির পাঠকক্ষে প্রথম পরিচয় হয় মাতৃতুল্য ওই শিক্ষকের সঙ্গে। বাংলা ক্লাসে আটপৌড়ে শাড়ি পড়া কপালে সিঁদুর লাগানো হালকাণ্ডপাতলা গড়নের আমার প্রিয় শিক্ষকের প্রথম ডাক ছিল ‘মানি- (মানিক) দুষ্টুমি করোনা’। আস্তে আস্তে তার পড়ানোর ধরন, পড়া বুঝানোর কৌশল ও কথাবার্তার শালীনতা, শব্দচয়ন আমাকে বিমোহিত করে। তিনি যেভাবে পাঠদানকালে সহজ উপায়ে পড়ার বিষয় বস্তুগুলো উপস্থাপন করতেন তাতে একটা শিল্প ছিল। তখন আমার মনে হতো আমার শিক্ষক সব জানে। অবশ্য তখনো জানতাম না তিনি কত দূর লেখাপড়া করেছেন। পরে অবশ্য জানতে পারি তিনি ষাটের দশকে যখন নারীদের পড়ালেখা করাটা ছিল ভীষণ দুরূহ। তখন তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত একজন মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন।

কিন্তু সে সময় আমার শিশুবেলার সরলতায় বুঝতে পারতাম আমার শিক্ষক অঞ্জলী রানী ঘোষ বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক সবই জানেন। শুধু জানেনই না অনেক বেশি জানেন। এই ধারণা আমার মনের ভেতরে গেঁথে যায় এবং একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে তাকে নিয়ে আমার অনেক গর্ববোধ কাজ করে। যা এখনো আমাদের হৃদয়ে ক্রীয়াশীল। একপর্যায়ে ওই স্যারের স্যান্নিধ্যে এসে আমার দুষ্টুমির মাত্রা কমে যায়। আর যাই হোক আমার ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা একেবারেই কমে আসে। শিক্ষক অঞ্জলী রানী ঘোষ এখন প্রায় ৭০ বছরের বৃদ্ধা। চোখে ভারী চশমা, পরনের শাড়িতে বোঝা যায় অনেক আগেই নানি-দাদি হয়েছেন। তবে আমার সৌভাগ্য কখনো কখনো তাকে আমি দেখতে পাই। পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে গেলে তার পা পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই পরম মমতায় সন্তানের মতো এখনো আগের মতোই বুকে টেনে নেন। মাথায় হাত বুলিয়ে রাজ্যের সব ভালো ভালো দোয়া করতে থাকেন। আর তার কাছে শেখা শিক্ষদের প্রতি সম্মান বোধটা এ মধ্য বয়সেও আমাকে আবেগে আপ্লুত করে। আমাকে ভাবিয়ে তোলে আমার ১৭ বছরের শিক্ষকতা জীবনে স্যার অঞ্জলী রানী ঘোষের মতো তেমন কিছু কি অর্জন করতে পেরেছি?

সেই পঞ্চম শ্রেণির কথা। প্রাথমিক স্তরে আমার হাতের লেখা খুবই খারাপ ছিল। যা নিয়ে ওই সময় সহপাঠীরা আমাকে ক্ষেপিয়ে তুলত। কিন্তু পরবর্তী সময় আমার প্রিয় শিক্ষিকা অঞ্জলী রানী হাতের লেখা নিয়ে আমার মনোকষ্টের বিষয়টি জানতে পেরে তিনি অমাকে সুন্দর হাতের লেখার শেখানোর জন্য কোন কোন বাংলা অক্ষর কতটুকু ছোট-বড় করে লিখতে হবে, কেমন করে হাতের লেখা সুন্দর করতে হয় তার কলাকৌশল তিনি ধৈর্য সহকারে আমার হাত ধরে খাতার পাতায় লেখাতেন। যাই হোক পরবর্তী সময়ে আমার হাতের লেখা ভালো হতে থাকে। যা ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত অক্ষুণ্ন ছিল। তবে অঞ্জলী রানীর হাতের লেখার তুলনায় আমার হাতের লেখা কিছুই না। মনে পড়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে শুধু অঞ্জলী রানী ঘোষই নয় শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মরহুম কাজেম উদ্দিন, আলতাব হোসেন, হাফিজুর রহমান (অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ) স্যারেরা শ্রেণিকক্ষ ও শ্রেণিকক্ষের বাইরেও আমাদের পাঠদান করাতেন কিন্তু পয়সা নিতেন না। অথচ সেই আশির দশকে একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক কত টাকাই বেতন পেতেন। সামন্য বেতনে পরিবার-পরিজন নিয়ে টানাটানিতেই মাস পার করেছেন। কিন্তু শিক্ষকতার আদর্শ থেকে সামান্য বিচ্যুত হননি। সে কথা এখন ভাবতে গেলে আগের দিনের ওই শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধে এখনো মাথা নুয়ে আসে।

আমি আশির দশকে প্রত্যন্ত চলনবিলের কুন্দইল বঙ্গবন্ধু বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম। সে সময় আমার প্রধান শিক্ষক ছিলেন আবদুর রশীদ সরকার স্যার। মূলত আমার পরবর্তী শিক্ষায় পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে তার সান্নিধ্য আমাকে সামনের পথে এগিয়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত করে দেন। যেমনটি প্রাথমিক স্তরে করে ছিলেন আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অঞ্জলী রানী ঘোষ। যাই হোক কৃজ্ঞতাবশত আমাকে বলতেই হয় আমার শিক্ষা অর্জনের জন্য সে সময় শিক্ষকদের অবদান বেশি। অথচ আমরা যারা চাকরিজীবী আছি তাদের ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা করাতে যে খরচ হয় তা একজন ছোটখাটো চাকরিজীবীর জন্য বোঝার ওপর শাকের আটি। বর্তমান সময়ে এ অবস্থা শুধু আমার না অনেকেরই। পড়ালেখার অসম্ভব প্রতিযোগিতায় কোমলমতি শিক্ষার্থীরা এক ধরনের নাজেহাল অবস্থায় আছে। এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় শিক্ষার্থীকে না ছাড়ে বাবা-মা, না ছাড়ে প্রাইভেট টিউটর। তাই আমার শিক্ষক অঞ্জলী রানী ঘোষের মতো মহৎ প্রাণ শিক্ষক বড় বেশি প্রয়োজন এ সময়ে। যারা দায়িত্ব বোধ থেকে শ্রেণিকক্ষেই শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগ পাঠ চুকিয়ে দিতেন। কেননা সেকালে বাবা-মাদের শিক্ষার দৌড় ছিল কম। ছিল না প্রাইভেট পড়ানোর মতো আর্থিক সংগতি। তাই তাদের ওপর নির্ভর না করেই শ্রেণিকক্ষে নিজের জ্ঞান উজাড় করে পড়ালেখা শেখাতেন শিক্ষকরা। এতে করে শিক্ষার্থীরা নিজেদের জীবন গঠনে শিক্ষকদের অবদান এখনো কৃতজ্ঞ ভরে স্মরণ করে।

যেমন গত ঈদে স্যার অঞ্জলী রানীর সাবেক শিক্ষার্থী শরীফুল ইসলাম পল্টু একটি প্রাইভেট কার কেনেন। কারটি কিনে তিনি অস্বস্তিতে পড়েন। কারণ তিনি অফিস থেকে ছুটি পাচ্ছিলেন না। অথচ তার ইচ্ছা নতুন গাড়িতে প্রথমেই উঠাবেন তার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অঞ্জলী রানীকে। তারপর ঈদের ছুটিতে এসে সোজা প্রিয় শিক্ষককে নতুন গাড়িতে তুলে অনেক জায়গায় ঘুরে ফিরে তবে স্বস্তি পেয়েছিলেন। যা ছিল একজন আদর্শ শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের কৃজ্ঞতা। যা বর্তমান সময়ে বিরল। যাই হোক শত সহস্র স্মৃতিতে অমার শিক্ষক অঞ্জলী রানী অমলিন। তার আদর্শ শত সহস্র শিক্ষার্থীকে অনুপ্রাণিত করে। যা দেখা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়। হাজারোও শিক্ষার্থীর প্রিয় শিক্ষক শ্রদ্ধেয় অঞ্জলী রানী ঘোষ। যার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও তার সুস্থ দীর্ঘায়ু জীবন প্রত্যাশা দিনমান থাকবে একজন দুষ্টু ছাত্র হিসেবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close