reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০৩ জানুয়ারি, ২০২৩

সাবিনার ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে যত স্বপ্ন

ড্রয়িংরুমের মাত্র একটি কম্পিউটারে ফিল্যান্সিং শুরু হয় সাবিনা আক্তারের। বর্তমানে দেশের অন্যতম সেরা আইটি ফার্ম বিডিকলিং আইটি লিমিটেডের চেয়ারম্যান তিনি। দুই শতাধিক তরুণ-তরুণী কাজ করছেন তারই হাতে গড়া এই প্রতিষ্ঠানটিতে। মাস শেষে অর্ধকোটি টাকারও বেশি বেতন দিচ্ছেন কর্মীদের। স্বপ্ন দেখছেন আইটি খাতে পাঁচ হাজার তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থানের মাধ্যমে ফিল্যান্সিংকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার। ফিল্যান্সিংয়ে সফল হয়ে শুধু অর্থ উপার্জনেই থেমে থাকেননি সাবিনা আক্তার। নিজ প্রতিষ্ঠানে তরুণ-তরুণীদের জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ফিল্যান্সিং শেখার সুযোগ করে দিয়েছেন তিনি। এমনকি শিগগিরই আলাদা একটি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ফিল্যান্সিং শিক্ষাকে আরো সহজলভ্য করে যুব সমাজকে বেকারত্ব নামক অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে চান তিনি। ফিল্যান্সিংয়ে এগিয়ে যাওয়া, একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে সেটিকে দেশসেরা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়াসহ নানা উত্থান-পতনের কথা বলেছেন প্রতিদিনের সংবাদকে। তার মুখোমুখি হয়েছিলেন শিক্ষার্থী ও ফিচার লেখক তানজিদ শুভ্র

ফ্রিল্যান্সিংয়ে আপনার শুরুর গল্পটা জানতে চাই...

আমাদের ফ্রিল্যান্সিংয়ের যাত্রাটা শুরু হয়েছিল খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে। বলতে গেলে একেবারেই প্রাথমিক অবস্থায় আমরা শুরু করেছিলাম। বাসায় ড্রয়িংরুমের একটি মাত্র কম্পিউটারেই প্রথম কাজ হতো। এরপর ধীরে ধীরে যখন কাজের চাহিদা বাড়তে থাকে, তখন একটি টিমের গঠনের চিন্তা মাথায় আসে। এরপরই একটা আইটি ফার্ম এবং বিস্তর পর্যায়ে ফ্রিল্যান্সিং শুরু। এর আগে আমাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে।

ফ্রিল্যান্সিংকে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে নিয়ে আসার ভাবনাটা যদি বলতেন...

ড্রয়িংরুমের একটি মাত্র কম্পিউটার থেকে বিডিকলিং এখন বিশাল বড় আইটি প্রতিষ্ঠান। শুরুতে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ফ্রিল্যান্সিং শুরু করলেও বর্তমানে দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠানরূপে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা। বিডিকলিং আজকে প্রাতিষ্ঠানিক একটা রূপ পাওয়ার অন্যতম কারণ আমাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আর অক্লান্ত পরিশ্রম। ব্যক্তিগত ফ্রিল্যান্সিং থেকে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে আসার পেছনে ভাবনাটা এসেছিল যখন আমরা ক্লায়েন্টের চাহিদা অনুযায়ী কাজ দিতে পারছিলাম না। কারণ, তখন এত পরিমাণ চাহিদা আমাদের কাছে আসতে শুরু করে যে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে আর পারছিলাম না। তখনই মাথায় আসে, আমরা তো চাইলে কিছু লোক হায়ার (নিয়োগ) করে কাজ করতে পারি। এরপর সে অনুযায়ী টিম সাজাতে শুরু করি। ১০ জন ২০ জন করে আজকে আমাদের বিশাল পরিবার। বর্তমানে আমাদের দুটি অফিসে দুই শতাধিক কর্মী কাজ করছে।

এই পর্যায়ে আসতে সবচেয়ে বেশি কার সহযোগিতা পেয়েছেন?

আমি প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হলেও বিডিকলিং আইটি লিমিটেডের এই অবস্থায় আসার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান আমার স্বামী মোহাম্মদ মনির হোসেনের। তিনিই সব সময় আমাকে আইডিয়া দিয়েছেন, বাস্তবায়নেও সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছেন তিনি। আমি যখন অফিসের কাজে ব্যস্ত থেকেছি, তিনিই ছায়ার মতো আমাকে সময় দিয়েছেন, সন্তানদের দেখেছেন। ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজটি যেহেতু রাতের একটি কাজ, আমার স্বামীর সহযোগিতা ছাড়া এতদূর আসা কখনোই সম্ভব ছিল না। এছাড়াও আমাদের সফলতার পেছনে আরেকটি বড় শক্তি হলো আমাদের কর্মীরা। তারুণ্যনির্ভর একটা ভালো টিম আমরা পেয়েছি, যা আমাদের সফলতার চূড়ায় পৌঁছে দিতে বড় ভূমিকা রেখেছে।

বেকারত্বরোধে ফ্রিল্যান্সিং কতটা ভূমিকা রাখতে পারে?

দেশে কর্মক্ষম মানুষের তুলনায় সরকারি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশে কর্মক্ষম ২৬ লাখ ৩০ হাজার মানুষ বেকার। অন্য এক জরিপে বলা হয়েছে, দেশের প্রায় ৬৬ লাখ মানুষকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। কর্মক্ষম প্রতিটি মানুষ দেশের জন্য মূল্যবান মানবসম্পদ। এ বিশাল মানবসম্পদকে যদি আমরা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারি, তারাই হয়তো দেশের অর্থনীতিতে বড় একটি ভূমিকা রাখবে। আমি মনে করি, দেশের বেকারত্ব রোধে ফ্রিল্যান্সিং একটি বড় উপকরণ হতে পারে। তবে, এক্ষেত্রে এই বেকার যুবসমাজকে যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। আমরা আমাদের অবস্থান থেকে এমন একটি প্রশিক্ষিত যুবসমাজ গড়তে চেষ্টা করছি, কিন্তু এই কাজ আমাদের একার পক্ষে করা খুবই কঠিন। সরকার যদি আমাদের প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দেয়, অবশ্যই আমরা ভালো কিছু করতে পারব।

ফ্রিল্যান্সিংয়ে মার্কেটে বাংলাদেশকে কোন অবস্থায় দেখতে চান। এক্ষেত্রে সম্ভাবনা কেমন?

বর্তমান যে জাতি প্রযুক্তির দিক দিয়ে যত বেশি দক্ষ, সে জাতি তত বেশি উন্নতি করছে। তাই আমাদের দেশের বিশাল বেকার জনগোষ্ঠীকে কম্পিউটারে দক্ষতা বৃদ্ধি করে কাজে লাগানো যেতে পারে। বর্তমানে অনন্য দেশের মতো বাংলাদেশও ফ্রিল্যান্সিংয়ের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন অনেকেই ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে আয় করছে। নতুন করে তরুণ সমাজের মধ্যেও বেশ আগ্রহবোধ কাজ করছে। তবে আগ্রহ এবং কাজ করার ক্ষেত্রে আমরা দেখি যে তারা নানা বিষয়ে সমস্যার সম্মুখীন হয়। অনেক ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কিছু অভাববোধও আমরা দেখে থাকি। প্রথমত হলো, আন্তর্জাতিক মার্কেটে কাজ করতে হলে যেই স্কিলের (দক্ষতা) চাহিদা রয়েছে, আমাদের দেশের ছেলেদের মধ্যে ওই লেভেলের দক্ষতা অর্জন করাটা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয়ত হলো, আন্তর্জাতিক মার্কেট থেকে যেকোনো কাজ পেতে বা সম্পন্ন করে ডেলিভারি দিতে যোগাযোগের মাধ্যম হলো ইংরেজি। কিন্তু এই ইংরেজিতেই আমাদের দেশের মানুষের দুর্বলতা আছে। আরেকটি সমস্যা হলো, আমাদের মধ্যে প্রফেশনালিজমে বেশ দুর্বলতা আছে। বিভিন্ন মার্কেটপ্লেসে যখন আমরা প্রোফাইলগুলো দেখি, আমরাই তেমন একটা সন্তুষ্ট হতে পারি না। এই বিষয়গুলো যদি আমরা সমাধান করতে পারি, তাহলে কিন্তু আমাদের তরুণদের জন্য ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটে বেশ সম্ভাবনা রয়েছে।

একজন নারী হিসেবে নারীদের জন্য আপনার প্রতিষ্ঠানে কী ধরনের ব্যবস্থা রেখেছেন?

আমি নারী উন্নয়নে বিশ্বাসী। নারী ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই নারীদের আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে হবে। এক্ষেত্রে ফ্রিল্যান্সিংটা নারীদের জন্য বিশাল সুযোগ। এক্ষেত্রে আমাদের প্রতিষ্ঠানে নারীদের জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা আমরা রাখার চেষ্টা করেছি। আমাদের এখানে নারীদের চাকরিতে আমরা ৩০ শতাংশ কোটা রেখে থাকি। এছাড়াও তাদের জন্য অফিসে আলাদা খাবারের জায়গা, নামাজের জায়গাসহ আলাদা একটি কমনরুম রয়েছে। চাকরির ক্ষেত্রে যেমন নারীরা এখানে আলাদা ফ্যাসিলিটি পায়, আমাদের ইন্টার্নশিপেও তাদের আমরা বিশেষ সুযোগ দিয়ে থাকি। সর্বোপরি আমরা চাই নারীরা এগিয়ে যাক। দেশ ও জাতির জন্য ভূমিকা রাখুক।

আইটি খাতে নারীদের সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?

সব পেশাতেই এখন নারীদের জন্য সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই সময়ে এসে ‘পুরুষ উত্তম, নারী অধম’ এমন ধারণা নেই বললেই চলে। এখন অনেক স্বামীই তার স্ত্রীকে বাইরে কাজ করার জন্য উৎসাহ প্রদান করছেন। কিন্তু যারা বাইরে গিয়ে কাজ করতে অনিচ্ছুক তাদের জন্যে ফ্রিল্যান্সিং হতে পারে উপার্জনের হাতিয়ার। এর ফলে স্বামীর পাশাপাশি পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা আনতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারেন নারীরা।

বিডিকলিংকে কতদূর নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন?

এর আগেই যেমনটি বলেছি, আমরা দেশে আইটি খাতে পাঁচ হাজার তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থান করতে চাই। বর্তমানে রাজধানীর বনশ্রীতে আমাদের দুটি অফিস, আমরা শিগগিরই ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় আরো কয়েকটি অফিস শুরু করতে যাচ্ছি। একপর্যায়ে আমাদের পরিকল্পনা সারা দেশেই আমরা বিডিকলিংকে ছড়িয়ে দিতে চাই। একসময় বিভাগীয়-জেলা পর্যায়ে আমাদের অফিস থাকবে। সারা দেশেই আমাদের কর্মীরা কাজ করবে। এতে করে আমরাও দেশের ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরে শক্ত একটা অবস্থান গড়তে পারব, সেইসঙ্গে বড় একটা সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান গড়ে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারব।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close