শিল্পেও সফল নারী শিক্ষার্থীরা
তারা পড়াশোনা করেন। কেউ কলেজ, কেউবা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবসর সময়ে তারা ছবি আঁকেন, গহনা বানায় ফেব্রিকে পেইন্টিং করেন, ক্যালিগ্রাফি করে, পোষা পাখি পালন করেন। আরো কত কী। এসব কাজে তাদের ভালোই আয় হয়। নিজের টুকটাক শখ পূরণ ও অন্য কোনো প্রয়োজনে এখন আর তাদের কারো কাছে হাত পাততে হয় না। শিক্ষার্থী হয়েও নানা ধরনের কাজে সফলতা পেয়েছেন এমন কয়েকজকে নিয়ে লিখেছেন মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
নাহিমা জাবীন প্লাবন
ছবি আঁকা, ক্যালিগ্রাফি তিনি শখ হিসেবেই নিয়েছিলেন। কিন্তু তার কাজগুলো মানুষ এত বেশি পছন্দ করেছে যে, এখন পেশা হিসেবেই তা নেওয়ার কথা ভাবছেন। ছোটবেলা থেকেই তার আঁকাআঁকির প্রতি আগ্রহ। আর তার এই আগ্রহে মা, বাবার সায় পেয়েছেন। সফল এই শিল্পীর নাম নাহিমা জাবীন প্লাবন। পড়াশোনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। উজ্জ্বল মাধ্যমের রং তাকে বেশি আকর্ষিত করে। তিনি বলেন, আমি উজ্জ্বল ও দীপ্তিমান পেইন্টিং বেশি করে থাকি। এ পর্যন্ত আমি ৪০টির বেশি ছবি এঁকেছি। এমনও ছবি আছে যেগুলো আমি পুনরায় এঁকেছি। মাসে গড়ে তার কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় হয় ছবি ও ক্যালিগ্রাফি বিক্রি করে। তিনি প্রথম আয়ের টাকা দিয়ে মাকে বোরখা কিনে দেন। তার ছবির সাইজ সর্বনিম্ন ১২/১২ ইঞ্চি। কবে কোনো ছবি ২৪/২৪ ইঞ্চির বেশিও হয়ে থাকে। তার শিল্পকর্মের সর্বনিম্ন দাম ৪,০০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৬,০০০ টাকা। ফেসবুকে তার পেজের নাম “Zabin's Art Galler”। Heaven In Kalema Taieba, Remembering the most merciful তার সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটি কাজ। তিনি জানান, এই কাজ দুটি তাকে কয়েকবার করতে হয়েছে। ক্রেতাদের চাহিদা থাকায়। সম্প্রতি তার তৈরি ক্যালিগ্রাফি চিত্রশিল্প (Remembering the most merciful /শক্তিমানের স্মরণে) : বাংলাদেশ জাতীয় শিল্পকলা একাডেমিতে একটি আর্ট এক্সিবিশনে প্রদর্শিত হয়। ভবিষ্যতে তিনি ক্যালিগ্রাফি নিয়ে আরো বড় মাপের কাজ করা ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
সালমা আক্তার আলিশা
চট্টগ্রাম কলেজে মনোবিজ্ঞান বিভাগে চতুর্থ বর্ষে পড়াশোনা করেন। ২০২০ সালে তার ছবি আঁকা শুরু। তিনি মূলত প্রকৃতির ছবি আঁকতে পছন্দ করেন। প্রথম দিকে নানা কথা শুনছেন। ছবি এঁকে কী হবে। এসব করে অর্থ আয় করা যায় নাকি। আরো কত কী। মানুষের কটু কথাকে তিনি পাত্তা দেননি একদম, বরং চেষ্টা আর পরিশ্রম করেছেন। আঁকাআঁকিতে লেগে থেকেছেন। তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা আমার পরিবার থেকে পেয়েছি। তারা সব সময় আমার ছবির প্রশংসা করেছে। মূল্যবান মতামত প্রদান করেছে। ফলে ভুল হলে সেটা শুধরে নিতে পেরেছি। সত্যি বলতে তাদের অনুপ্রেরণা না পেলে হয়তো এগিয়ে যাওয়া কষ্টকর হতো। ফেসবুকে তার পেজের নাম Alisha's Art Gallery। ছবি আঁকার পাশাপাশি তিনি হ্যান্ড পেইন্টের কাজও করেন। একটি ইউটিউব চ্যানেল খোলার ইচ্ছা আছে তার। তিনি অনেকগুলো অনলাইনভিত্তিক চিত্রাংকন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন। তিনটি এক্সিবিশনে তার ছবি প্রদর্শিত হয়েছে। 2nd International online Art exhibition 2020 -এ তার ছবি ছিল। Colour Flwo Art Exhibition 2022 যেটি বাংলাদেশ শিল্পকলায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে তার আঁকা ছবি প্রদর্শিত হয়। পাশাপাশি তিনি Best Artist অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন। Shilpo Bangla Art Exhibition 2022 -এ তার ছবি অনেকেরই নজর কাড়ে। তিনি নিজের কাজগুলো দেশ-বিদেশে সবার কাছে পৌঁছে দিতে চান। এটাই তার ইচ্ছা।
জোহরা ইব্রাহিম ইভা
জোহরা ইব্রাহিম ইভা। নিজেকে চিত্রপ্রেমী বলতে পছন্দ করেন। কদিন আগে তিতুমীর কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন। ২০২০ সালে ১২ জুন অনলাইনে পেজ খুলেন। পেজের নাম শখের বিলাস। ছবি আঁকার পাশাপাশি তিনি হস্তশিল্প নিয়ে কাজ করেন। যেমন হাতে আঁকা, সেলাই, ব্লক, বাটিক ইত্যাদি। তিনি বলেন, শাড়ি, থ্রি-পিস, ওয়ান-পিস, পাটের ব্যাগ, পটারি শিল্প, গ্লাস পেন্টিং, হাতের কাজের গহনা, হ্যান্ড পেন্ট গহনা, হেয়ার ব্যান, তা ছাড়া ক্রাফট আইটেম নিয়ে কাজ করছি। আঁকাআঁকির ক্ষেত্রে সব ধরনের কাজ করেন তিনি। ক্যালিওগ্রাফি, রিকশা পেইন্টিং, মানডালা, হুইপ আর্ট, ক্যানভাস পেইন্টিং, ডুডলিং, ডিজিটাল আর্ট সবকিছুতেই তার দক্ষতা রয়েছে। তবে রিকশা পেইন্টিং ও ডুডলিং তার খুব পছন্দ। তার পণ্যের বিশেষ গুণ হলো- পণ্যগুলো কাস্টমাইজ করা যায়। তিনি খুব যত্ন সহকারে প্রতিটি পণ্য তৈরি করেন। যা আলাদা এবং ইউনিক। গড়ে মাসে তার আয় ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। তিনি জানান, পরিবার তার কাজে সমর্থন জোগায়। তিনি মনে করেন, উদ্যোক্তা জীবনটা অনেক পরিশ্রম এর। তবে লেগে থাকলে সফলতা আসবেই।
সানজিদা ইসলাম মীম
নারায়ণগঞ্জ কলেজ অ্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে বাংলা বিভাগে পড়েন। ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহ তার ছোটবেলা থেকেই। এ পর্যন্ত প্রায় ৩৫০ ছবি এঁকেছেন। একসময় তার স্টাইলাস আর ট্যাব ছিল না। আঙুল দিয়েই ছবিগুলো ফোনে আঁকতেন। হাত আর ঘাড় ব্যথা হতো দীর্ঘক্ষণ কাজ করার জন্য। ছবি এঁকে তিনি খুব শান্তি অনুভব করেন। তার প্রথম আয় ১২০০ টাকা। তিনি বলেন, আমি সাধারণত ল্যান্ডস্কেপ, সিস্কেপ, ফরেস্টস্কেপ টাইপ ছবি আঁকি। তার খুব জনপ্রিয় একটি ছবি A day at coast yard। ফেসবুকে তার পেজের নাম Sanji's Art Archive। তার ছবির সর্বনিম্ন দাম ছিল ২০০ টাকা আর সর্বোচ্চ ৩৫০০ টাকা। তিনি বলেন, আমি স্টুডেন্ট কিন্তু শখের কাজ করতে গিয়ে পড়ালেখার ক্ষতি হয় না। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পড়ার সময় পড়া, আর ফ্রি টাইমে ছবি আঁকি।’ তার ছবি হোসাইন আর্ট গ্যালারির পক্ষ থেকে কালার ফ্লো আর্ট এক্সিবিশন, মাহফুজ ক্যানভাসের পক্ষ থেকে দ্য ম্যাজিক্যাল ব্রাশ-সিজন ২, শিল্প বাংলার পক্ষ থেকে আর্ট এক্সিবিশন ২০২২-এ স্থান পেয়েছে। আনউইন্ড মাইন্ড ২০২২ নামে একটি এক্সিবিশনে তিনি ষষ্ঠ স্থান অর্জন করেন। ছবি আঁকার বাইরে তিনি ছাদ বাগান, পোষা পাখি পালনের সঙ্গে জড়িত।
সাবেরা আফরোজ তুরিন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গভর্নমেন্ট কলেজ অব অ্যাপ্লাইড হিউম্যান সায়েন্সে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করেন। পাশাপাশি বিভিন্ন মাধ্যমে ছবি আঁকেন। ক্যালিগ্রাফিতে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন তিনি। পেন্সিল, খোদাইকর্ম, স্কেচও করেন। পেইন্টিংয়ের বেলায় বেছে নেন মূলত অ্যাক্রেলিক। উড পেইন্টিং, স্কেচিং, পেন্সিল কার্ভিং করেন। তিনি দুই ধরনের ক্যালিগ্রাফি করে থাকেন। গথিক ক্যালিগ্রাফি এবং আরবি ক্যালিগ্রাফি। অন্যদিকে পেন্সিল কার্ভিংগুলো তার কাস্টমাইজড হয়ে থাকে। বিশেষ করে কারো নাম পেন্সিলে খোদাইকরন। এছাড়া গিটারের পেন্সিল কার্ভিংও পছন্দ তার। তার ফেসবুক পেজের নাম তুরুর তুলি। তিনি বাচ্চাদের ড্রইং শেখান। তুরিন বলেন, শেখাতে আমার খুবই ভালো লাগে। আর মাস শেষে যেই টাকা ইনকাম হয় সেগুলোর কিছু অংশ দিয়ে পেইন্টিং ব্রাশ, ক্যানভাস, কালারস আর পেন্সিল ক্রয় করি। বাকিটা দিয়ে নিজের জন্য অন্য কোনো শখের জিনিস কিনে থাকি। বই পড়তে তিনি খুব পছন্দ করেন। নতুনদের জন্য তার পরামর্শ শেখার কোনো শেষ নেই, বয়স নেই। যত বেশি প্র্যাকটিস করা হবে, স্কিল তত বাড়বে। কনফিডেন্স বেড়ে যাবে অনেক।
সিরাজুম মুনিরা
শুরুতে পরিবার সাপোর্ট দেয়নি। পরে যখন তার কাজগুলো দেখল। তখন তারা সব রকমের সমর্থন দেন। ছবি বিক্রি করে মাসে তার আয় প্রায় ছয় হাজার টাকা। ছবি আঁকা, ক্যালিগ্রাফি দুটোই করছেন সমানভাবে। তাও পড়াশোনার কোনো ক্ষতি না করেই। সফল এই চিত্রশিল্পীর নাম সিরাজুম মুনিরা। পড়াশোনা করছেন লালমাটিয়া সরকারি মহিলা কলেজে গণিত বিভাগে অনার্স চতুর্থ বর্ষে। ২০২১ সালে তার ক্যানভাসে আঁকার শুরু। তিনি সুপারি পাতার প্লেট, ঘরের তালা, ম্যাচ বক্স, ইয়ারফোনের কভারে ছবি এঁকে সুনাম কুড়িয়েছেন। এ পর্যন্ত ২০০টির বেশি ছবি এঁকেছেন। মালয়েশিয়া, জার্মানিসহ আরো কয়েকটি দেশে কিছু ক্রেতা সুপারি পাতার প্লেট নিয়েছেন বলে তিনি জানান। তিনি ক্যালিগ্রাফিও করেন। আয়াতুল কুরসি ক্যালিগ্রাফি তার খুব জনপ্রিয় ক্যালিগ্রাফি। যেটা এখন পর্যন্ত ছয়বার করেছেন। ফেসবুকে তার পেজের নাম Canvas By Munira। তার শিল্পকর্মের দাম ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত। আঁকাআঁকির কারণে মন ভালো হয়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অনেক সময় মন খারাপ থাকলে রং তুলি নিয়ে বসে পড়ি। এটাই আমার মন ভালো করার থেরাপি। তিনি বিডি ক্লিন নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে দুই বছর কাজ করেছেন।’
"