reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ১১ অক্টোবর, ২০২২

প্রথিতযশা তিন নারী চিত্রশিল্পী

আপন আলোয় রাঙানো ক্যানভাস

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের চিত্রকলা জগতে নারী শিল্পীদেরও রয়েছে বিশিষ্ট অবস্থান। তাদের কাজ সমহিমা ও স্বতন্ত্র সৃজন বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। প্রথিতযশা তিন নারী চিত্রশিল্পী নাজলী লায়লা মনসুর, ফরিদা জামান ও রোকেয়া সুলতানা। তাদের শিল্প ও জীবনবোধসহ নানা প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন চিত্রশিল্পী ও কবি শিশির মল্লিক

শিল্পী নাজলী লায়লা মনসুর

শিল্পী নাজলী লায়লা মনসুরের জন্ম ১৯৫১ সালে রাজশাহী শহরে। ইডেন কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেন। বরেণ্য শিল্পী ও সংগঠক রশিদ চৌধুরী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য বিভাগ চালু করলে সেখান থেকে ১৯৭৬ সালে মাস্টার্স করেন। পরে তিনি চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজ ও চট্টগ্রাম চারুকলা অনুষদে দীর্ঘকাল শিক্ষকতা করেছেন।

‘একটা বোধ আমার ভেতর খুব গভীরভাবে কাজ করে। সেটা হলো সবার মধ্যে থেকেও আমরা প্রত্যেকেই খুব একা। আমার ছবিতে দেখবেন, অনেক মানুষের প্রতিকৃতি আছে। কিন্তু ওই অনেক মানুষের ভেতরেও আমি চেয়েছি, প্রত্যেকটা মানুষের একাকিত্ব ও স্বাতন্ত্র ফুটিয়ে তুলতে। পরিবারে, পেশায়, সাংসারিক জীবনে আমাদের সব ধরনের যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতার পরও, সব হাসি-আনন্দের ভেতরেও কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম বিষাদ ও নিঃসঙ্গতা লুকিয়ে থাকে। সেই বিচ্ছিন্নতা ও বিষাদই আমার ছবির কেন্দ্রীয় বোধ।’ বলছিলেন শিল্পী নাজলী লায়লা মনসুর। নিজের চিত্রকর্ম সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, ‘আমি সব সময়ই চেয়েছি আমার ছবি যেন সবার বোধগম্য হয়, সমাজের সব শ্রেণির মানুষই যেন এতে কিছু না কিছু অর্থ খুঁজে পায়।’

ছবির বিষয়বস্তুতে নারীবাদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি নিজে কখনো সচেতনভাবে নারীবাদের চর্চা করিনি। নারীবাদী অনুষঙ্গ আমার ছবিতে এসে থাকলে সেটা আমার সার্বিক সমাজ-পর্যবেক্ষণের অংশ হিসেবেই এসেছে। আমি আগেই বলেছি, আমি সমাজের অসংগতি ও বৈষম্যকে ছবিতে তুলে আনতে চাই। নারীর প্রতি বৈষম্যও এর একটা উদাহরণ। তবে আমি মনে করি, এভাবে নারী-পুরুষ আলাদা করে না ভেবে মানুষের মানবিক উৎকর্ষের মানদণ্ডেই সবকিছু বিচার করা দরকার।

শিল্পী ড. ফরিদা জামান

শিল্পী ড. ফরিদা জামান ১৯৫৩ সালে চাঁদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। চারুকলায় স্নাতক হন ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন ১৯৭৮ সালে বরোদাতে অবস্থিত মহারাজা সাজিরাও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৯৫ সালে। অধ্যাপনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগে। তিনি ২০২০ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন।

খুব সহজ ও সাবলীল তার চিত্রভাষা। দেখা জগৎ তার চিত্রভাষায় পেয়েছে নান্দনিক বৈশিষ্ট্য। রং ও আঙিকে মুগ্ধতা সৃষ্টি করে, দৃষ্টিকে দেয় প্রশান্তি। ছবির মতো তার বৈশিষ্ট্যও শান্ত ও সাধারণ। বাংলাদেশের বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী মামা হাশেম খানের মাধ্যমে তিনি রংতুলির প্রতি আকৃষ্ট হন। তার রেখা বলিষ্ঠ, সাবলীল এবং ছন্দময়। আমাদের প্রতিদিনকার চেনাজানা পরিবেশ তার চিত্রে জায়গা নিয়েছে। যার মাধ্যমে দেশকে, দেশের মানুষ ও প্রাণ-প্রকৃতিকে অনুভব করা যায় খুব সহজেই। তার কাজে যত্নশীলতা ও পরিপাট্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

শিল্পী ফরিদা জামান বলেন, ‘আমি খুব সাধারণ জীবনযাপনে বিশ্বাসী। এটাই আমার দর্শন। ছোটবেলা থেকেই শখ ছিল শিল্পী হওয়ার। তাই গাছপালা, ফুল-পাখি টানত ভীষণ। কল্পনার বাস্তব আবার বাস্তবের কল্পনা মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। ইচ্ছা জাগত, ভালোবাসার সেই অনুভব প্রকাশের। সেখান থেকেই ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহ।’

শিল্পী রোকেয়া সুলতানা

চিত্রশিল্পী রোকেয়া সুলতানার জন্ম চট্টগ্রামে ১৯৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে। স্নাতক হন ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৮৩ সালে। তিনি ঢাকা চারুকলা ইনস্টিটিউটে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ১৯৮৭ সালে। দীর্ঘ সময় ধরে ছাপচিত্র বিভাগে অধ্যাপনা করছেন। ১৯৯৯ সালে মর্যাদাপূর্ণ এশিয়ান বিয়েনাল পুরস্কারে ভূষিত হন।

চিত্রশিল্পী রোকেয়া সুলতানা, সৃজনে যিনি নন্দিত এবং প্রশংসিত। বাংলাদেশের শিল্পচর্চায় তার উজ্জ্বল উপস্থিতি। নারী শিল্পী ও পুরুষ শিল্পী এই বিভেদরেখা তিনি সমর্থন করেন না। তিনি বলেন, ‘শিল্পীসত্তার নারী-পুরুষ বিভেদ আমি বিশ্বাস করি না। শিল্পী শিল্পীই। যারা নারী নিয়ে কাজ করেন, হয়তো সেই বিষয় দ্বারা তারা ইনফ্লুয়েন্সড! এটা হতেই পারে। এ বিষয়ভিত্তিকতার জন্য শিল্পীসত্তার বিভেদীকরণটা আমি ঠিক মনে করি না; বরং এটা সম্পৃক্তকরণই স্বাভাবিক বলে মনে করি।’

তিনি আরো বলেন, নারী খুব পাওয়ারফুল সত্তা। আমাকে নারীর পজিটিভ পাওয়ার প্রতিনিয়ত মুগ্ধ করে। নারী-পুরুষের বিভাজনের বিতর্ক নয়, মানুষ হিসেবে সবার সম্মান ও অধিকারের সমতার প্ন্যাটফরমটা খুব জরুরি, যা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই ভারসাম্যের বিষয়, জীবনের এক অন্যতম নন্দিত দর্শন।’

তার কাজের বিষয়, রং, রূপ ও কৌশল সম্পর্কে বলেন, ‘ছবি আঁকাটা আমার কাছে ফ্লোইং রিভারের মতো, যেখানে গতি ও সময়ের ধারা আছে এবং অবশ্যই প্রতিদিনের ডায়েরির মতো। প্রতিদিনের ডায়েরির কথকতা আমার ক্যানভাসে সঞ্চারিত হয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে মনের অন্তর্যাত্রার প্রভাব এতে পড়বেই। তবে আমি অনেক ভাবি। ভেবেই কাজগুলো করি। একজন শিল্পীর জীবনযাত্রা, চেতনা, দর্শন, বোধের রিফ্লেকশন তার কাজে পড়ে। টেকনিক বা কৌশল জানার একটি পর্যায় আছে। কিন্তু উত্তরণের উৎসে দর্শন ও সেরিব্রাল গুরুত্বপূর্ণ। রং আমাকে খুব প্রভাবিত করে। আমি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রঙের প্রতি অনুরক্ত হয়েছি, সেটাও ওই মনের প্রভাব। তাই শিল্প বিষয়টা কেবল দর্শনধারী নয়, এর ভেতর আছে অন্তর্নিহিত সমুদ্রের অতলতা, গভীর মগ্নতাতেই তা অনুধাবন সম্ভব।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close