চিররঞ্জন সরকার

  ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২

সাফ ফুটবলে ‘নারী বিপ্লব’

সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে নতুন ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশ। নেপালকে ৩-১ গোলে ধসিয়ে দিয়ে সাফ নারী ফুটবলে চ্যাম্পিয়নের মুকুট পরেছে। এই শিরোপা জয়ে দেশবাসী স্বভাবতই আনন্দিত ও উল্লসিত

বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে সম্মানিত করার এই নেপথ্য নায়িকারা অন্ধকার থেকে উঠে এসেছে আলোর মঞ্চে। তারা এসেছে দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রাম থেকে। এই কিশোরীদের কারো কারো বাবা কৃষক, ছোট ব্যবসায়ী বা সামান্য মাইনের চাকুরে। তৃণমূলের অভাবী পরিবারের কিশোরীরাও যে সুযোগ পেলে জাতীয় মর্যাদা বয়ে আনতে পারে, সেটা দেখিয়ে দিয়েছে এই ফুটবলাররা।

বস্তুত গোটা টুর্নামেন্টেই বাংলাদেশের নারীরা দাপটের সঙ্গে খেলেছেন। তারা শুধু শিরোপাই জেতেননি, টুর্নামেন্টে তারা ছিলেন অপরাজিতও। এ কৃতিত্বের জন্য তাদের প্রতি রইল প্রাণঢালা অভিনন্দন। অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন দলটির কোচ, কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানাই অভিনন্দন। দেশবাসীর প্রত্যাশা, এই নারীদের হাত ধরেই এক দিন দেশে ফুটবল ফিরে পাবে হারানো গৌরব।

কয়েক বছর ধরে আমাদের আনন্দের উৎসটা মূলত ক্রিকেট ঘিরেই হয়েছে। বামপন্থি দলগুলোর মতো আমাদের ফুটবলও সাফল্যহীন। বিশ্বদরবারে আমাদের ফুটবল মান এখনো হতাশাজনক। এই হতাশার মধ্যে দেশের মেয়েরা গৌরবময় সাফল্য বয়ে এনছে। দেশবাসীকে আনন্দ ও গৌরব করার মুহূর্ত উপহার দিয়েছে। বিশেষত এবারের নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে দেশবাসীকে একের পর এক আনন্দঘন মুহূর্ত উপহার দিয়েছে আমাদের মেয়েরা। একের পর এক বিজয় তাও আবার বিশাল ব্যবধানের তা সত্যি আমাদের গর্বিত করেছে। বাংলাদেশের রুপনা চাকমা, আঁখি খাতুন, মাসুরা পারভীন, শিউলি আজিম, শামসুন্নাহার, মনিকা চাকমা, মারিয়া মান্দা, সানজিদা আক্তার, কৃষ্ণা রানী সরকার, সাবিনা খাতুন, সিরাত জাহানরা অসাধারণ ফুটবল নৈপুণ্যে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে।

নিঃসন্দেহে এই মেয়েরাই আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের শ্রেষ্ঠ সাফল্যের দূত। ভবিষ্যতে আমাদের ফুটবলকে এগিয়ে নেওয়ার কারিগর। অর্থনৈতিকভাবে সংকটগ্রস্ত সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে অধঃপতিত এই দেশে মেয়েরাই বাংলাদেশের স্বপ্ন হয়ে মাঠে নেমেছে। দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে অন্য দেশের মেয়েদের সঙ্গে লড়াই করেছে। জয় ছিনিয়ে এনেছে। আমাদের মেয়েরা প্রমাণ করেছে অন্য দেশের মেয়েদের থেকে আমাদের দেশ পিছিয়ে নেই। শক্তি তো মাঠেই প্রমাণ হয়েছে। সেই শক্তি পরীক্ষায় আমাদের মেয়েরা বিজয়ী। সেই সঙ্গে বিজয়ী হয়েছে দেশ, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি।

আজ আমরা নারী ফুটবলারদের সাফল্যকে আমরা উদযাপন করছি। আমরা কি জানি তাদের এগিয়ে আসার গল্প? কতটা পারিবারিক-সামাজিক বাধা অতিক্রম করে তারা আমাদের জাতীয় জীবনে এমন সাফল্যের উপলক্ষ এনে দিয়েছে? কত ত্যাগ, কত অবহেলা, কত কটাক্ষ তাদের শুনতে হয়েছে?

সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংসকারের কারণে আমাদের দেশের ক্রীড়াঙ্গন থেকে মেয়েরা প্রায় নির্বাসিত। এটাকে বলা যায় ‘সুপরিকল্পিত কুসংস্কার’, ক্ষমতা ধরে রাখার একচ্ছত্র অবলম্বন। এমন ভাবনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের নারী ক্রীড়া। এ দেশের মেয়েদের খেলার মধ্যে সবচেয়ে করুণ অবস্থা ফুটবলের। স্বাভাবিক। যে দেশে মেয়েদের পর্দা আর রান্নাঘরের মধ্যে আটকে রাখার চেষ্টা করা হয় সেখানে মেয়েদের ফুটবল নিতান্তই ‘অলীক’। প্রগতিশীল সামাজিকতার আড়ালে আটপৌরে সংস্কৃতি চিরকালীন বৈষম্যের প্রতীক; সেখানে নারীদের খেলায় অংশগ্রহণ মানেই সামাজিক অবরোধ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পার করলেও আমাদের দেশের মানুষের মানসিকতা এখনো মেয়েদের খেলাধুলাকে তেমনভাবে সমর্থন করে না। মেয়েদের ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট এমনকি ভারোত্তোলনও সামাজিক সমর্থন পায় না। সেখানে নারী ফুটবলারদের অত্যন্ত কৃতিত্ব দেখিয়ে সাফ পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা নিঃসন্দেহে গৌরবময় ও তাৎপর্যপূর্ণ। নিষ্ঠুর সামাজিক প্রতিবেশ থেকে উঠে এসে মেয়েরা যখন বিশাল অতিক্রমণের ইতিহাস তৈরি করেন তখন তারা হয়ে ওঠেন নারীত্বের আলাদা অভিজ্ঞান। ফুটবলে বাংলাদেশে নারীদের উত্থানও তেমনই এক অবিস্মরণীয় আখ্যান।

বাংলাদেশে নারী ফুটবল এখনো অস্পৃশ্য। অথচ নারী ফুটবলের সাফল্য আমাদের দেশে গর্ব করার মতো। নারীর ক্ষমতায়নের স্বার্থেও নারী ফুটবলকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া দরকার। এ জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ফুটবলকে মেয়েদের জন্য পক্ষপাতমুক্ত হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এ সাফল্য ধরে রাখতে হলে উন্নত প্রশিক্ষণ ও পরিচর্যার মাধ্যমে মেয়ে ফুটবলারদের মানোন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। সারা দেশে তৃণমূল পর্যায় থেকে কিশোর-কিশোরীদের বাছাই করে নিয়মিত ফুটবলের প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার। ক্রিকেটে এ ধরনের উদ্যোগের সুফল পাচ্ছি আমরা। ফুটবলের ক্ষেত্রেও একই পদক্ষেপ নেওয়া হলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ খেলায় আমাদের ব্যর্থতা ঘুচবে অবশ্যই। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয় খেলা ফুটবলকে অবহেলা করার সুযোগ নেই।

আশা করি, কর্তাব্যক্তিরা এবার আরেকটু উদার ও মনোযোগী হবেন নারী ফুটবলের ব্যাপারে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যার পাশাপাশি পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা পেলে এভাবেই এগিয়ে যাবে আমাদের নারীরা। এগিয়ে যাবে লাল সবুজের আমাদের প্রিয় সুন্দর দেশটিও।

পরিশেষে আবারও স্যালুট জানাই বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলকে! তারা অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। এখন তারাই হোক বাংলাদেশের সফল নারীর সেরা বিজ্ঞাপন!

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close