পুষ্পিতা তাবাসসুম

  ২১ জুন, ২০২২

‘জননী সাহসিকা’

কবি বেগম সুফিয়া কামাল

‘আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা/তোমরা এ যুগে সেই বয়সেই লেখাপড়া কর মেলা।/আমরা যখন আকাশের তলে ওড়ায়েছি শুধু ঘুড়ি/তোমরা এখন কলের জাহাজ চালাও গগন জুড়ি।’

পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে বিবর্তন হয়ে আসছে। বিবর্তনের ধারায় যেমন প্রকৃতি রয়েছে তেমনি আছে আমাদের সমাজ। যদিও আমাদের সমাজ বিবর্তনের ধারার মতো পরিবর্তন হয়নি, হয়েছে প্রজন্ম ধরে। এক প্রজন্ম যে সময়ে রূপকথার গল্প শুনতে পছন্দ করে তেমনি অন্য প্রজন্ম সে সময়ে কী করে আকাশে ওড়া যায়। সে কথা চিন্তা করে। এক প্রজন্ম যে সময়ে ডাংগুলি অথবা চড়ুইভাতি করার জন্য ব্যস্ত। অন্য প্রজন্ম সেই সময়ে ভিডিও গেমস নিয়ে ব্যস্ত। প্রজন্মের মধ্যে সময়ের ও চিন্তা-চেতনার যে ব্যবধান তা কবি সুফিয়া কামাল ‘আজিকার শিশু’ কবিতায় বলেছেন অনেক আগেই। অথচ তিনি যখন জন্মগ্রহণ করেছেন তখন সম্ভ্রান্ত মুসলিম নারী শিক্ষা ছিল একটি অপরাধের শামিল। সে সময়ে নারী শিক্ষার প্রচলনই ছিল না।

সুফিয়া কামাল শুধু একবার বায়না ধরে পায়জামা আচকান টুপি পড়ে ছেলের সাজে স্কুলে গিয়েছিলেন। বাস্তবে স্কুলে যাওয়া আর কোনোদিন সম্ভব হয়নি। কিন্তু বাড়িতে অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে স্কুল-স্কুল খেলা খেলতেন। এই খেলায় তিনি ইংরেজিতেই কৃতিত্বের পরিচয় দিতেন বেশি। এই কারণেই ‘সন্দেশ’ পত্রিকার গ্রাহক হওয়ার অপূর্ব সুযোগ লাভ করেছিলেন। সে কালের রক্ষণশীল সমাজের কোনো মেয়ের নামে পত্রিকা এসেছে, এটাও অপরাধ মনে করা হতো। এই সময় জুবিলী স্কুলের প-িত প্যারীলাল বাবু (স্থানীয় পোস্ট অফিসে পোস্টমাস্টারের দায়িত্বে ছিলেন) নবাব বাড়ির মেয়ের কাছে ডাকযোগে আসা ‘সন্দেশ’ পত্রিকা সংগোপনে রেখে, পরে সুফিয়া খাতুনের হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতেন। এ সময় সুফিয়ার বড় ভাই সৈয়দ আবদুল ওয়ালী বরিশালে বেল ইসলামিয়া হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করতেন। বাংলার প্রতি আগ্রহের কথা শুনে, ওই হোস্টেলের প-িত বাদশা মিয়া শিশু সুফিয়ার জন্য বাংলা বইও সংগ্রহ করে দিতেন। মাত্র সাত বছর বয়সে কলকাতায় বেগম রোকেয়ার সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। কিন্তু পরিবারের রক্ষণশীলতার কারণেই বেগম রোকেয়ার স্থাপিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলে ভর্তি হতে পারেননি।

তবে সুফিয়া কামালের পরিবার যখন বরিশালে থাকত তখন বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত গীতিকবি কামিনী রায় একবার বরিশালে যান। সে সময় তিনি সুফিয়ার কবিতা লেখার কথা জানতে পারেন এবং তিনি নিজে তাদের বাড়িতে গিয়ে তার লেখা কবিতা দেখে তাকে কবিতা লিখতে উৎসাহিত করেন। সুফিয়া কামালের প্রথম প্রকাশিত লেখা ছিল একটি গল্প। ‘সৈনিক বধূ’ যা বরিশালের তরুণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯২৩ সালে। ১৯২৬ সালে সওগাত পত্রিকায় তার প্রথম কবিতা বাসন্তী প্রকাশিত হয়। তিনি ছিলেন বেগম পত্রিকার প্রথম সম্পাদক। ১৯৪৭ সালে তিনি সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন এবং ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সরাসরি যোগ দেন। তিনি শুধু ভাষা আন্দোলনে যোগ দেননি, দিয়েছেন ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংগ্রামসহ শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও। এ জন্য তিনি ‘জননী সাহসিকা’ উপাধিতে অভিষিক্ত হন। তিনি প্রথম যে কি না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহিলা হোস্টেলকে রোকেয়া হল নামকরণের প্রস্তাবক ছিলেন।

সুফিয়া কামাল জীবদ্দশায় অসংখ্য কবিতা, গল্প, ভ্রমণকাহিনি এবং স্মৃতি কথা লিখেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে- সাঁঝের মায়া, মায়া কাজল, মন ও জীবন, শান্তি ও প্রার্থনা, উদাত্ত পৃথিবী, দিওয়ান এবং মোর জাদুদের সমাধি পরে। সোভিয়েত দিনগুলি তার ভ্রমণ কাহিনি এবং একাত্তরের ডায়েরি অন্যতম স্মৃতি কথা।

নারী জাগরণের এই লেখিকা সাহিত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেন ৫০টিরও বেশি পুরস্কার। এর মধ্যে বাংলা একাডেমি, একুশে পদক, বেগম রোকেয়া পদক, জাতীয় কবিতা পুরস্কার, স্বাধীনতা দিবস পদক উল্লেখযোগ্য।

মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালির সমস্ত প্রগতিশীল আন্দোলনে ভূমিকা পালনকারী মহীয়সী এই নারী ১৯১১ সালের ২০ জুন বিকাল ৩টায় বরিশালের শায়েস্তাবাদ রাহাত মঞ্জিলে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন সৈয়দ আবদুল বারী এবং মা সৈয়দা সাবেরা খাতুন। কবির শৈশব কেটেছিল নানা বাড়িতে। সুফিয়া কামাল ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ২৮ নভেম্বর ইচ্ছানুযায়ী তাকে আজিমপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close