বেনজীর আহমেদ সিদ্দিকী

  ২৪ মে, ২০২২

রাবেয়া খালার ভাতের দোকানে...

কুয়াশামাখা ভোরে নির্জন পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে রংপুরের পৌরসভা বাজারে গিয়ে দেখা মিলল জীবন ও জীবিকার নানাবিধ ব্যস্ততার। কেউ ট্রাক বা ভ্যান থেকে পণ্য নামাচ্ছেন, কেউ সেগুলো মাথায় তুলে নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় দিয়ে আসছেন, কেউ সেগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে রাখছেন, কেউ বিক্রির জন্য হাঁকডাক শুরু করেছেন, ক্রেতারাও ততক্ষণে বিক্রেতাদের সঙ্গে দরদামে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বেশ ভোর থেকেই বাজারের প্রতিটি কোণ যেন জীবনের কোলাহলে মুখরিত হয়ে উঠেছে। ওদিকে বাজারের পাশের ছোট ছোট টং দোকানে পরিবেশিত হচ্ছে গরমা গরম ধোঁয়া ওঠা খাবার। এমনই এক ছোট্ট খাবারের দোকানে দেখা মিলল পঞ্চাশোর্ধ বৃদ্ধা রাবেয়ার। দোকানে খেতে আসা সবাই তাকে খালা বলেই সম্বোধন করছে।

দোকানে আয়েশ করে বসে কেউ ভাত, ডাল, আলু, মাছ, শাক ভর্তা, আবার কেউ সঙ্গে মাছ-মাংসও খাচ্ছে। সবার মুখ থেকে তৃপ্তির ঝলক যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে। এমনই এক আয়েশি পরিবেশে রাবেয়া খালার ব্যস্ততার মাঝেই গল্প জমে উঠল। জানা গেল, প্রতিদিন রাতে বাজার থেকে চাল, ডাল, শাক-সবজি, মাছ, মাংস ও ডিম কিনে আনেন তিনি। ভোর সাড়ে ৫টা থেকে রান্নাবান্না শুরু করেন। কেজি দশেক চালের ভাত, তিন-চার কেজি সবজি (বেগুন, আলু, পটল, কাঁকরোল, টমেটো, ফুলকপি, গাজর ইত্যাদি) ও মাছের (বিশেষ করে রুই, পাঙাস, কৈ, তেলাপিয়া, টাকি, শোল, শিং মাছ) তরকারি, দুই কেজি গরু ও মুরগির মাংস, বিভিন্ন ভর্তা এবং কয়েক ডজন ডিমের ভুনা তরকারি রান্না করেন। রান্না শেষ হতেই ক্রেতা আসার আগেভাগে দোকানের সামনে রাখা বড় প্লেটে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখেন তিনি।

রাবেয়া খালার ভাতের দোকানে ৬০ থেকে ৭০ টাকার মধ্যে পেট পুরে খাওয়ার ‘প্যাকেজ’ রয়েছে। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০-৬০ জন ক্রেতা খাবার খেতে ভিড় জমান রাবেয়া খালার ভাতের দোকানে। এই দোকান ভাত-তরকারি রাখার জন্য ৯টি পাতিল, কড়াই ও টিনের বড় প্লেট, ২৫টি থালা, দুটি পানির কলস, ১২টি গ্লাসসহ আরো কয়েকটি আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো। রাবেয়া খালা জানান, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাজারে কাজ করা শ্রমিক থেকে শুরু করে নিরাপত্তারক্ষী, হকার, ছিন্নমূল মানুষ, নিম্নআয়ের লোকজন এখানে খাওয়া-দাওয়া করেন। অল্প টাকায় তারা এখানে পেট পুরে মজা করে খান। দেখা গেল দোকানে বসে পাঙাস মাছের ঝোল দিয়ে আনন্দ নিয়ে ভাত খাচ্ছেন রহিম মিয়া। পেশায় তিনি একজন শাক-সবজির ফেরিওয়ালা। সাইকেলে করে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে শাক-সবজি ফেরি করে বিক্রি করেন। তিনি এখানে প্রায়ই খেতে আসেন। কথায় কথায় জানালেন রাবেয়া খালার হাতের রান্না খুবই চমৎকার। তিনি বলেন, আমাদের মতো গরিব মানুষের জন্য এসব খাবারের দোকান বড় ভরসার জায়গা এবং খাবারের দামও কম। হাসতে হাসতে তিনি সাথে যোগ করলেন, ‘ভালো হোডেলে খাওনের স্বাদ তো জাগেই, কিন্তু সেই সামর্থ্য নেই। তাই কইতে পারেন এইডাই আমগো কাছে ফাইভ স্টার হোডেল।’

এখানে পাওয়া যায় মাছ-ভাত ৫০-৬০ টাকা, ডিমণ্ডভাত ৩০ টাকা, ভর্তা-সবজি-ভাত ৩০-৪০ টাকা, মুরগি-ভাত ৫০ টাকা এবং গরু দিয়ে ভাত ৯০-১০০ টাকা, সঙ্গে পাতলা ডাল ফ্রি। অতিরিক্ত ভাতের ক্ষেত্রে হাফ ৫ টাকা, ফুল ১০ টাকা। প্রতিদিন তিনি ১০ কেজি চালের ভাত বিক্রি করেন। বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে ক্রেতাদের খাবার সরবরাহ করতে ব্যস্ত রাবেয়া খালা কাজের ফাঁকে ফাঁকে বলে চলেছেন, প্রায় ২৭ বছর ধরে তিনি এই ভাতের দোকান চালান। এই বয়সে একা মানুষ হয়েও বাজার করে ভোরে ওঠে রান্না সেরে সারা দিন ক্রেতাদের খাইয়ে দোকানের সব ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতে ভালোবাসেন তিনি। রাবেয়া খালা জানালেন, যেদিন ভালো যায় সেদিন তিন-চার হাজার টাকাও বিক্রি হয়। কিন্তু যেদিন কোনো কারণে রান্না করা খাবার বিক্রি করতে পারেন না সেদিন খাবার থেকে যায়। ফলে লোকসান গুনতে হয়। তিনি বলেন, অনেক সময় ভারী বাজার টেনে আনা খুব কষ্ট হয়ে যায়। তা ছাড়া রোদ, বৃষ্টি, ঝড় এখন আর বয়সের ভারে সেভাবে সইতে পারেন না। তবুও জীবন সংগ্রামের এই যুদ্ধে বেঁচে আছি এটা বলতে পারি! কথা শেষে চোখের কোণের ছলছল করা পানি মুছে আবারও কাস্টমারের থালায় ভাত তুলতে গেলেন রাবেয়া খালা। খাবার দিয়ে এসে ফের গল্পের ঝাপি খুলে বলেন, অনেক আগেই স্বামীহারা হয়েছেন। নিজে অনেক কষ্ট করে ছেলেমেয়েকে সাধ্যমতো লেখাপড়া করিয়ে খানিকটা স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করেছেন। ছেলেমেয়েদের কাছে কখনোই পুরোপুরি নির্ভরশীল হতে চান না, তাই এই বয়সেও রাবেয়া খালা প্রতিদিন ক্রেতাদের মুখে তৃপ্তির হাসির দেখার আশায় ও নিজের জীবিকা নিজেই নির্বাহের জম্য চোয়াল শক্ত করে পরিশ্রম করে যান।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close