reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ১০ মে, ২০২২

মনের চোখে ছবি আঁকেন খাদিজা

‘ছয়তলার ছাদ থেকে যেদিন পড়ে গেলাম। সেদিনই আসলে আমার মৃত্যু হয়েছে। স্বামীর সাহস, সঙ্গে মা, বাবা ও প্রিয় মানুষরা পাশে এসে দাঁড়ান। এসবই আমার বেঁচে থাকার প্রেরণা।’ শারীরিক অক্ষমতাকে জয় করা এই নারীর নাম খাদিজাতুল কুবরা ফ্যান্সি। দুর্ঘটনায় শারীরিক সক্ষমতা হারান। একা চলাফেরা করতে পারেন না। তবু তিনি আজ একজন সফল চিত্রশিল্পী। সাতটি মাধ্যমে ছবি আঁকেন। একাধিক ছবির প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। পুরস্কারও জুটেছে অসংখ্য। লড়াকু খাদিজার জীবন জয়ের গল্প জানাচ্ছেন মুহাম্মদ শফিকুর রহমান

তখন মাত্র ১৩ বছর বয়স। অসতর্কতাবশত ছয়তলার ছাদ থেকে পড়ে যান। তার পরও প্রাণে বেঁচে যান। তবে একা একা চলার সক্ষমতা হারান। কারো না কারো সাহায্য নিয়ে তাকে চলতে হয়। খাদিজার বাড়ি বগুড়ায়। বাবা সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। পড়াশোনা করার খুব ইচ্ছে ছিল তার। ক্লাস টেনে উঠেছিলেন। কিন্তু ফাইনাল পরীক্ষার আগে অপারেশন হয়। মাথায় আর বেশি চাপ নেওয়া যাবে না। ডাক্তারের এমন কথায় খাদিজার মন ভাঙে। ছেড়ে দিতে হয় পড়াশোনার স্বপ্ন। জীবনে প্রথম ছবি আঁকেন মা-বাবার হাত ধরে। স্কুলজীবনে আর্ট কম্পিটিশনে খাদিজা পুরস্কার পেয়েছেন।

মনের চোখে ছবি আঁকেন : একা চলাফেরা করতে পারেন না। প্রকৃতিতে ছুটে বেড়ানোর সুযোগ তার নেই। তবু তিনি প্রকৃতির ছবি নিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলেন। খাদিজা বলেন, এমনও হয়েছে। অনেকে ধরতেই পারেন না। হাতে আঁকা নাকি ফটোগ্রাফি। প্রকৃতিকে অনুভব করে ক্যানভাসে তা তুলে ধরেন। মাত্র বছর তিনেক পুরোদমে খাদিজা ছবি আঁকেন। তিন থেকে বিশ হাজার টাকা নেন ছবির মূল্য হিসেবে। নিজের আঁকা ছবি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করি কোয়ালিটি মেইন্টেইন করার।’

সুপার হিরো : মোহাম্মদ আবদুল মোত্তালিব (নয়ন)। খাদিজার স্বামী পেশায় আইনজীবী। খাদিজার শারীরিক অক্ষমতা রয়েছে। এটা জেনেও তিনি বিয়ে করেন, বলছিলেন খাদিজা। স্ত্রীকে উৎসাহ দেন ছবি আঁকার জন্য। খাদিজা বলেন, ‘আমার জীবনে সুপার হিরো আমার স্বামী। তিনি সব ধরনের সহযোগিতা করেন।’

দূর থেকে সফলতার গল্প শোনা : Robi 10 mininute school আয়োজিত কন্টেস্টে বিজয়ী হয়েছেন খাদিজা। বাংলাদেশে জনপ্রিয় আর্ট গ্রুপ ‘Obscure artist’-এর অ্যাডমিনের দায়িত্বে আছেন তিন বছর। এই গ্রুপের সদস্য সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার। অংশগ্রহণ করেছেন Alluring Art Exhibition 27-30 ডিসেম্বর ২০১৯ (শিল্পকলা একাডেমি), Obscure Artist Exhibition 27-29 নভেম্বর ২০১৯, Magical brush exhibition -এ। এ ছাড়া তিনি অনলাইনে অনেকগুলো ইন্টারন্যাশনাল এক্সিবিশনে অংশগ্রহণ করেছেন। Alluring Art Exhibition ২৭-৩০ ডিসেম্বর ২০১৯ (শিল্পকলা একাডেমি) খাদিজার দুটো ছবি বিক্রি হয়। নিজের ছবির প্রদর্শনী হলেও সেখানে খাদিজার উপস্থিতি থাকে না। দূর থেকে তাকে সফলতার গল্প শুনতে হয়। খাদিজা বলেন, ‘দুঃখজনক হলো অসুস্থতার জন্য আমি এক্সিবিশনে যেতে পারি না। লং জার্নি করা কষ্টসাধ্য। আমি চেয়ারে বসেই পেইন্টিং করি। দূরে কোথাও গেলে হুইলচেয়ার নেই। আর সব সময় ক্রাচেই ভর করে হাঁটতে হয়। দুঃখজনক স্মৃতি হলো, এত কষ্ট করে ছবিগুলো আঁকি। কিন্তু নিজের চোখে দেখতে পারি না। এক্সিবিশনের দেয়ালগুলোতে আমার ছবি কেমন দেখাচ্ছে। আমার ছবিগুলো দেখে দর্শকের কেমন এক্সপ্রেশন হয়, নিজের চোখে দেখতে পেলে আরো ভালো লাগত।’

অন্যের অনুপ্রেরণা : যে মানুষ দূরে কোথাও যেতে পারে না। অন্যের সাহায্য লাগে। সেই মানুষই আজ অসংখ্য আর্টিস্টদের অনুপ্রেরণা। পথপ্রদর্শকও বলা যায়। খাদিজার কাছে জানা গেল, শারমিন আলম নামের একজনকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন তিনি। শারমিনের পরিবার ছবি আঁকা পছন্দ করত না। খাদিজা শারমিনের পরিবারকে বোঝাতে সক্ষম হন। ছবি আঁকা খারাপ কিছু নয়। এখন শারমিন শুধু ভালো ছবিই আঁকে না। তার আঁকা ছবি বিক্রিও হয় প্রচুর। তানভির জয়, সুরভী, ইকবাল, সাজেদা হোসেন, রেখা, মাসুকা নওরিন হিরাসহ অনেকের অনুপ্রেরণা খাদিজা।

সহানুভূতি নয় ভালোবাসা চাই : আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ। মাঝেমধ্যে শারীরিক অক্ষমতা বাধা হয়ে দাঁড়াতে চায়। কিন্তু আমার ইচ্ছাশক্তির কাছে সেটা হার মেনে যায়। শারীরিকভাবে ডিসেবল মানুষ সহানুভূতি নয়, আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতোই ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য। আমি এটাই মনে করি। সহানুভূতি শব্দটা আমি মানতে নারাজ। আমার অ্যাক্সিডেন্টের পর যখন আবার ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে ভর্তি হতে গিয়েছিলাম। তারা আমাকে ভর্তি নেয়নি। সেদিন আমার হৃদয়টা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল। আর সেদিনই সংকল্প করেছিলাম। এক দিন এই বগুড়া তথা দেশের গর্ব হয়ে দেখিয়ে দেব অসুস্থতা কোনো দুর্বলত নয়, বরং শক্তি। বলছিলেন খাদিজাতুল কুবরা ফ্যান্সি।

স্বপ্ন : খাদিজা স্বপ্ন দেখেন একটি আর্টি স্কুল প্রতিষ্ঠার। পাশাপাশি শিল্পীদের মেধার মূল্যায়ন, পারিশ্রমিক ও উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হবে। যাতে দেশে বসেই শিল্পীরা উৎসাহ নিয়ে শিল্পকর্ম করতে পারেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close