reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ১৯ এপ্রিল, ২০২২

নারী উদ্যোক্তাদের অগ্রযাত্রা

শুধু ঘর-সংসার নয়। সুযোগ পেলে এর বাইরেও নারীরা নিজের পরিচিতি তৈরি করতে পারেন। ঘরে বসেই করতে পারেন আয়। যা সংসারে সচ্ছলতা যেমন আনছেন, তেমনি টুকটাক প্রয়োজনে অন্যের কাছে হাত পাততে হচ্ছে না। উদ্যোক্তা হিসেবে নারীদের সফলতা দিন দিন বাড়ছে। সফল চার নারী উদ্যোক্তার কথা লিখেছেন মুহাম্মদ শফিকুর রহমান

শাহিনুর আক্তার স্বপ্না, সবুজের সন্ধানে

ছোটবেলা থেকেই তার গাছের প্রতি আগ্রহ। টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে গাছ কিনতেন। গাছ কিনে শুধু শুধু টাকা নষ্ট। এমন কথাও শুনেছেন। এখন তিনি কেবল শৌখিন বাগানি নন, গাছ বিক্রি করে তার মাসিক আয় ১০ হাজার টাকার মতো। সফল এই বাগানপ্রেমীর নাম শাহিনুর আক্তার স্বপ্না। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএসএস মাস্টার্স। ১৯৯৮ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে বাগান করছেন। পাঁচটি বারান্দায় তার বাগান। থাকেন ঢাকার মাতুয়াইলে। এক ছেলে এক মেয়ে তার। সাকুলেন্ট, ক্যাকটাস, অর্কিড, অ্যাডেনিয়ামসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাঁচ শতাধিক গাছ আছে। অধিকাংশ গাছই বিদেশ থেকে আনা। আনুমানিক তার বাগানের মূল্য এখন সাত লাখ টাকা। অনলাইনে তার সবুজের সন্ধানে নামে পেইজ আছে। সেখানে গাছের অর্ডার দেওয়া যায়। ইনডোর প্লান্টের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। নারীরা ঘরে বসেই উপার্জন করতে পারেন। স্বপ্না বলেন, একজন নারী উদ্যোক্তা সহযোগিতা পেলে ঘরে বসেই অর্থ উপার্জন করতে পারেন। বাসার সামান্য বারান্দায় প্রকৃতির বন্ধু গাছ লাগিয়েও শৌখিনতার পাশাপাশি আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেন।

বিলকিস আরা মুক্তা, ফুডস ইন ডোর

শখের বশে নানা রকম রান্না করতেন। বাচ্চাদের খাওয়াতেন। স্বাস্থ্যকর খাবার। ছেলে এক দিন খাবারের ছবি ফেসবুকে পোস্ট দেয়। ওমনি মানুষ জানতে চায়, খাবার বিক্রি হবে কি না? কৌতূহলের বশেই না করতে পারেননি। অর্ডার আসতে থাকে। তিনিও বিক্রি করতে থাকেন। শখ থেকেই এভাবেই তার শুরু। এখন তিনি লাখোপতি। সফল এই নারী উদ্যোক্তা বিলকিস আরা মুক্তা। ছেলেমেয়েরা ঘরে তৈরি খাবার খাবে। মুক্তা সব সময় সেটাই চান। নানা রকম খাবার তৈরি করেন। সময়টা ১৯ আগস্ট ২০১৯। ছেলে এক দিন খাবারের ছবি ফেসবুকে পোস্ট দেয়। মানুষ ভাবল, খাবার বুঝি বিক্রি হবে। মুক্তা বলেন, এই ছবি দেখে অর্ডার আসতেই থাকে। আমি ও ডেলিভারি দেই। না করতে পারিনি। অনেক কাস্টমার তৈরি হলো। হলো রিপিট কাস্টমারও। আনন্দ পেতাম। তাই প্রথম দিকে খাবার ডেলিভারি দিতাম। মানুষ উৎসাহ দিত। ভালোই লাগত। লাভ-লোকসান তখন বুঝতাম না। বললেন মুক্তা। চাহিদা প্রচুর। মুক্তা ভাবলেন, ব্যবসা হিসেবেই নেবেন হোম মেইড খাবার তৈরি। তার প্রথম অর্ডারের খাবার ছিল চাইনিজ আইটেম। এরপর বিরিয়ানি। মুক্তা তৈরি করেন খিচুড়ি, বিরিয়ানি, পোলাও, পরাটা। শতাধিক আইটেম। তবে তার হাতে তৈরি মুগপাকন পিঠা বেশ জনপ্রিয়। এ ছাড়া তিনি নকশিপিঠা, ডিমের পিঠা, গোলাপ পিঠা, ডিম সুন্দরী, ফুলঝুরি, ভাপা পিঠা, ম্যারা পিঠা ইত্যাদি বিক্রি করেন। মুক্তা জানান, বাংলাদেশের প্রায় ৪০ জেলায় তার ড্রাইফুডস কুরিয়ারের মাধ্যমে গেছে। শীতকালে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার পিঠার অর্ডার থাকে। গত সপ্তাহে তিনি একবারে ৩৫০ জনের খাবার অর্ডার সফলভাবে ডেলিভারি করেন।

জান্নাতুল ফেরদৌস জিনিয়া, জিনিয়াস আর্ট

ছোটবেলা থেকে আঁকাআঁকির প্রতি তার ঝোঁক। মায়ের কাছে শিখতেন ছবি আঁকা। এসএসসি পাস হলো। তারপর ভাবলেন কিছু একটা করি। কিছু বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করা যাক। ভাবনা থেকে রংতুলি হাতে নেওয়া। ছবি আঁকায় মন দেওয়া। ওদিকে পড়াশোনাও চলছে ভালোভাবে। এখন তার মাসিক আয় ভালোই। এই সফলতার গল্প জান্নাতুল ফেরদৌস জিনিয়ার। পড়াশোনা করছেন গভ. ইনস্টিটিউট অব হেলথ অ্যান্ড টেকনোলজির ল্যাব মেডিসিন অনুষদে। পাশপাশি তিনি স্কেচ, পেইন্টিং, ক্যালিগ্রাফি করেন। পোর্ট্রেট স্কেচ, আরবি ও বাংলা ক্যালিগ্রাফি, দেয়াল চিত্র, বিভিন্ন পেইন্টিং ইত্যাদিতে তার বেশ সুনাম এখন। আঁকাআঁকির মাধ্যম তার জলরং, অ্যাক্রেলিক, চারকোল ইত্যাদি। অনলাইনে কাজের অর্ডার নেন। নিজে ডেলিভারি করেন, ঢাকার মধ্যে হলে। দূরে হলে মাধ্যম কুরিয়ার সার্ভিস। ফেসবুকে তার পেইজ নাম Jenia's Art। প্রায় আট হাজার মানুষ যুক্ত আছে এখানে। নিজের প্রচেষ্টা ও অনুশীলনের মাধ্যমে আঁকাআঁকি দক্ষতা আর্জন করেছেন। এরই মধ্যে তিনি আনিরগন পেইন্টিং সেগমেন্টসেকেন্ড ক্রিয়েটিভ ফেস্ট বাই গ্যালাক্সি অব ক্রিয়েটিভিটি, আভা সাংস্কৃতিক অ্যাকাডেমি আয়োজিত চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, ফাস্ট মেগা ন্যাশনাল ফেস্ট বাই রয়্যাল কোড়িডোর প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছেন। নিজের ছবি সম্পর্কে জিনিয়া বলেন, হাতে আঁকা ছবি মনের ভাব প্রকাশের অনেক বড় মাধ্যম। মানুষ একসময় ছবি এঁকে মনের কথা প্রকাশ করত। এটি অনেক আবেগের একটি বিষয়। ছবির মধ্যেই ধারণ করা যায়, অনেক স্মৃতি, সংস্কৃতি, বিভিন্ন অনুভূতি পাশাপাশি এটি মানুষের রুচিশীল মনোভাবেরও প্রতিচ্ছবি। মাসে তার আয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। তবে কোনো কোনো মাসে এর থেকে কমণ্ডবেশি হয় বলে জানান।

কাজী মাহফুজা, লিভিং ইন লিভস

ছবি আঁকার বিভিন্ন মাধ্যম হয়। গাছের পাতা তার মধ্যে অন্যতম। ব্যতিক্রমী এই মাধ্যমে ছবি আঁকেন কাজী মাহফুজা। শুকনো এবং কাঁচা। দুই ধরনের পাতায়ই ছবি আঁকা হয়। ছবিগুলো মানুষের নজর কেড়েছে। শিল্পপ্রেমীরা ভিন্নতার স্বাদ পেয়েছেন। অনার্স পড়ুয়া মাহফুজার ভালো আয়ও হচ্ছে। নবীনগরে পরিবার নিয়ে থাকেন। ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকি তার পছন্দ। ছোটবেলায় গ্রামীণ দৃশ্য, ফুল, লতাপাতা, কাটুনও আঁকতেন। ২০১৬ সালের কথা। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর দীর্ঘ ছুটি। সোশ্যাল মিডিয়ায় মাহফুজা তার আঁকা ছবি পোস্ট করেন। অমনি একদল মানুষ হাসাহাসি শুরু করে। তখন তার হাতে ভালো কোনো আর্ট ম্যাটেরিয়ালও ছিল না। মাহফুজা বলেন, প্রথম দিকে অনেকে অনেক কটুকথা বলতেন। আর্ট ছেড়ে দিতে বলতেন। মানুষের ব্যঙ্গাত্মক মনোভাব সাহস জুগিয়েছে। আমি কাজের মাধ্যমে তাদের জবাব দিয়েছি।

আমার ভাবনা ছিল, অন্য আর পাঁচটা মানুষ যা করবে আমি তাদের থেকে আলাদা কিছু করব। সেই ভাবনা থেকেই ১৪ জানুয়ারি ২০১৯ সাল থেকে পাতায় আঁকা শুরু করি। Living In leaves নামে আমার আঁকার পেজ চালু করি, বলেন কাজী মাহফুজা। পাতা ভালোভাবে ধুয়ে প্রস্তুত করে নেওয়া হয়। কাঁচা, শুকনো দুই ধরনের পাতায় ছবি হয়। পোস্টার কালার, অ্যাক্রেলিক কালার দিয়ে আঁকা হয়, যা অনেক দিন ধরে টিকে থাকে। মাহফুজা আরবি ক্যালিগ্রাফিও করেছেন পাতার ওপর। এ ছাড়া ডিমের খোসা, সিগারেটের কভার, ব্যাগ, মোবাইলের ব্যাককভার, কাপড়ে পেন্টিং করেছেন। এই কাজগুলো মানুষ পছন্দ করেছে, জানান তিনি। ছবি আঁকার মিডিয়াম পেনসিল, কালার পেনসিল, ওয়েল পেস্টেল, সফট প্যাস্টেল, জলরং, পোস্টার কালার, অ্যাক্রেলিক কালার। সবগুলোতেই তার দক্ষতা রয়েছে। যখন যেখানে যেটা ভালো হয়। সে মাধ্যমে আঁকেন। প্রথম আয় করেন পাতায় পেন্টিংয়ের মাধ্যমে। তাও ২৫০০ টাকা।

২২ জুলাই ২০২০। মাহফুজা ভাবলেন, সুঁই-সুতা দিয়ে শুকনো পাতায় কাজ করা যায় কি না। প্রায় ৪ ঘণ্টা চেষ্টা করে সফল হলেন। মাহফুজা বলেন, শুকনো পাতায় সুঁই-সুতার এই কাজ সবাই খুব পছন্দ করতে শুরু করে। সুঁই-সুতার কাজ স্প্রে করে ফ্রেমিং করলে অনেক বছর পর্যন্ত ভালো থাকে। একে তো ব্যতিক্রমী মাধ্যম। তার ওপর সুন্দর সব কাজ। মানুষ তো পছন্দ করবেই। মাহফুজার বেলায়ও তাই হয়েছে। তিনি পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার।

২০১৮ সালের ৫ নভেম্বর। কাক কমিউনিকেশন থেকে জেলাভিত্তিক একটা আর্ট প্রতিযোগিতা আয়োজন করে। সেখানে তিনি দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। পোস্টার ডিজাইনে তৃতীয় পুরস্কার পান ২৯ জুলাই ২০১৯। রিসডা বাংলাদেশ এই আয়োজন করে। ১২টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল। ১১ মার্চ ২০১৯। প্রথম আমার আর্ট এক্সিবিশনে অংশগ্রহণ করেন। ডিমের খোসায় আঁকা ছবি নিয়ে। ৩০ জুলাই ২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জয়নুল আবেদীন ২নং গ্যালারি তার দ্বিতীয় প্রদর্শনী হয়। এ ছাড়া শিল্পকলা একাডেমি, ধানমন্ডি গ্যালিরিতেও তার চিত্রকর্মের প্রদর্শনী হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close