শুরু যেভাবে : ছোটবেলা থেকেই তার আঁকাআঁকির প্রতি ঝোঁক। বড় বোন কামরুজ্জামান সোমা। তিনি ছবি আঁকতেন। বোনের ছবি তাকে আঁকাআঁকিতে উৎসাহিত করে। মুক্তিরা পাঁচ বোন, এক ভাই। বাবা কোবান হোসেন। অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্তকর্তা। মা গৃহিণী। বাসা ঢাকার উত্তরায়। ছবি আঁকা ভালো না! ছবি আঁকার কী আছে? লাভ কী? সময় নষ্ট করে ছবি না এঁকে পড়াশোনা করা ভালো। ছবি এঁকে এ দেশে পেট চালানো সম্ভব না- এমন ধরনের কথা অনেকের কাছে শুনেছেন। তবে এসব একদম পাত্তা দেননি। রক্ষণশীল পরিবার। ঢাকঢোল পিটিয়ে ছবি আঁকা নিয়ে কিছু করা একটু কঠিনই ছিল। তবে সে পথটা কিছুটা হলেও সহজ করে দেন মুক্তির মা। তিনিই মেয়েকে সাহস দেন। সহযোগিতা করেন এক্সিবিশনে অংশ নেওয়াসহ নানা কাজে।

বহুমুখী কাজ তার : মুক্তি ক্যানভাসে কাজ করেন অ্যাক্রেলিক পেইন্ট দিয়ে। ২০১৭ সাল থেকে পুরোদমে কাজ করছেন। প্রথমে তিনি পোস্টার কালার দিয়ে ছবি আঁকতেন। ছবি আঁকা বিষয়ে তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। অনবরত অনুশীলন, ইউটিউব ভিডিও দেখে শিখেছেন। তার ফেসবুক পেইজের নাম Artholic Shukty| https://www.facebook.com/ArtholicShukty/

শুধু ছবি আঁকা নয়। তিনি মাটির টবের ওপর ক্লেও, রেজিনের কাজ করেছেন। মাটি প্রসেস করে টেরাকোটার কাজ হয়। তিনি টেরাকোটার পাশাপাশি মাটি দিয়ে কালার প্যালেট করেছেন। সিমেন্ট দিয়ে, প্লাস্টার ওফ প্যারিস দিয়ে পেস্ট বানিয়ে টেক্সচার আর্ট করেন কয়েক বছর ধরেই। এটা উঁচু করে করা এক ধরনের আর্ট। যা সামনে থেকে দেখলে আরো জীবন্ত মনে হয়। দেয়াল পেইন্টিংয়েও তার জুড়ি নেই। তিনি কাগজে Poster Color এবং Gouache Painting করতে পারেন। ফ্রেমসহ পেইন্টিং বিক্রি করেন তিনি। তার বড় সাইজের পেইন্টিং ২৪-৩৬ ইঞ্চি হয়।

নিজেই নিজের শিক্ষক : কেউ তাকে শেখাননি। কোনো কোর্সও করেননি তিনি। যখন যা করেছেন সব নিজ চেষ্টায়। নিজে কারো কাছে শিখতে পারেননি। একটু বুদ্ধি, পরামর্শও দেননি কেউ। ঠেকে ঠেকে শিখেছেন। সে কারণে যখন নিজে কাজে দক্ষতা অর্জন করেছেন। তখন তিনি ভাবলেন, নতুনদের জন্য কিছু করবেন। তার মতো অসহায় অবস্থায় যেন কেউ না পড়ে। তিনি বলেন, ‘আমি নিজে কখনো কারো কাছে ছবি আঁকা শিখিনি। আমি অনুভব করতে পারি যে, সীমাবদ্ধতায় থেকে ভালো লাগার কাজগুলো শিখতে চাওয়া কতটা কঠিন। যখন আপনি কাউকে চিনেন না। কারো সমর্থন পান না। তখন একটা আশার আলো আমাদের অনেক দূর এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। আমি সেই আশার আলো হতে চাই।’ মুক্তির ইউটিউব চ্যানেলের নাম আমার Artholic Shukty (Channel Link: https://youtube.com/ArtholicShukt) সেখানে তার কাছে প্রায় উনিশ হাজার মানুষ ছবি আঁকা শিখছেন। জানা যায়, আর্ট-সংক্রান্ত বাংলা ভাষায় এত আলোচনা, রিভিউ, টিউটোরিয়াল অন্য কোনো চ্যানেলে তেমন একটা নেই। ২০২০ সালের আগস্ট মাসে চ্যানেলটি খুলেন তিনি। এরই মধ্যে ৩৭টি ভিডিও আপলোড করেছেন। গড়ে তার ভিডিও-এর ভিউ সংখ্যা ১৬ হাজার। কীভাবে অ্যাক্রেলিক পেইন্টিং শুরু করবেন। এই শিরোনামের ভিডিওটি প্রায় এক লাখ চার হাজার মানুষ দেখেছে। মুক্তি অত্যন্ত যত্ন নিয়ে ইউটিউবে শেখান। তার মতে, যেসব মানুষ ছবি আঁকা নিয়ে বাংলায় ধারণা পেতে চায়, তাদের জন্য আমার ইউটিউব চ্যানেলটি একটি দারুণ সুযোগ বলে আমি মনে করি। এ পর্যন্ত তিনি ৩০০টিরও বেশি ছবি এঁকেছেন বলে জানান। কুরিয়ারে ডেলিভারি করেছেন একশরও বেশি ছবি। নিজের ছবি সম্পর্কে মুক্তি বলেন, ‘আমার মনে হয় প্রতিটি পেইন্টিং আমার নিজের একটা অংশ। আমি প্রতিটি পেইন্টিং করি আমার মনকে তৃপ্তি দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে। নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে আঁকি আমার প্রতিটি পেইন্টিং।

ছবির গল্প : It Ends With Us - মুক্তির আলোচিত একটি ছবি। ছবিটিতে নারীর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। এই চোখের ভেতরে লুকানো হাজারও শব্দ। এই চোখে আছে স্বপ্ন। আছে বাঁচার আশা। শত কষ্টেও সে আলো খুঁজতে থাকে একটা নতুন পৃথিবী গড়ার জন্য। তিনি এই পেইন্টিংয়ের নাম দিয়েছেন- It Ends With Us তার প্রিয় একটা বইয়ের নামে দেওয়া পেইন্টিংটির নাম।

ছবি আঁকায় মনে শান্তি : ছবি আঁকার মধ্যে তিনি মনে শান্তি পান। সে কারণে অন্য কিছু তাকে টানেনি। মুক্তি বলেন, ‘আমাদের এমন একটা কাজকে আপন করে নেওয়া উচিত; যেটা আমাদের মনকে শান্তি দিতে সাহায্য করবে। মনকে ভালো ও সুস্থ রাখাটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ মুক্তির ছবির দাম ৬০০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। আগামী মে মাসে শিল্পকলা একাডেমিতে প্রদর্শনী হবে। সেখানে তার একটি পেইন্টিং থাকবে। যার দাম ২৫ হাজার টাকা বলে জানান। তাড়াহুড়ো করা মুক্তির পছন্দ নয়। তিনি সময় নিয়ে ছবি আঁকেন। তিনি বলেন, ‘এমনও হয় যে, একটানা এক-দুই মাস সময় নিয়েও আমি একটা পেইন্টিং করেছি।’ 10 Minute School -এর আয়মান সাদিক তার পেইন্টিংয়ে মুগ্ধ। আয়মান লিখেছেন- That’s so amazing. Absolutely loved it, Shukty। মুক্তির ডাকনাম হলো শুক্তি।

এক্সিবিশন এবং পুরস্কার : অনেকগুলো এক্সিবিশনে অংশ নিয়েছেন মুক্তি। পেয়েছেন পুরস্কারও। মুখোশের আড়ালে ২০১৯ এক্সিবিশন হয় Drik Gallery তে। সেখানে তিনি অংশ নেন। International Winter Art Festival 2019, যার আয়োজক ছিল। Alluring Artwork. এখানে তার দুটো ছবি প্রদর্শিত হয়। It Ends With Us ছবিটি Best Award on Mixed Media Artwork পুরস্কার পেয়েছে। অঙ্কুর ২০১৯ এক্সিবিশনে অংশ নিয়েছেন। যেটি Military Institute of Science and Technology বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। আয়োজক ছিলেন MIST Literature & Cultural Club. পেনসিল সপ্তাহ ২০১৯ এক্সিবিশনে হয়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে। সেখানেও তার ছবি প্রশংসিত হয়।

২০২০ সালে Youth Collaboration Club -এর প্রযোজনায় একটি অনলাইন আর্ট কম্পিটিশনে অংশ নিয়ে তিনি চ্যাম্পিয়ন হন। চ্যাম্পিয়ান হয়েছেন Paint Off 2020-Tournament of Arts অনলাইন আর্ট কম্পিটিশনেও। যার আয়োজক ছিল Allstar. এই কম্পিটিশনে ১২৮ জনের মধ্যে তিনি প্রথম হন। সাতটি রাউন্ড তাকে পার হতে হয়। তাও মাত্র এক ঘণ্টা সময়ে লাইভে ছবি এঁকে।

বাংলা ভাষায় আর্ট শিখানো : ছবি আঁকা নিয়ে সিংহভাগ ইউটিউব চ্যানেল ইংরেজিতে। সেখানে মুক্তির চ্যালেন বাংলায়। তিনি বলেন, ‘শুধু নিজের জন্য নয় সবার জন্য। এমন একটা প্ল্যাটফরম তৈরি করতে চাই, যেখানে সহজেই বাংলা ভাষায় মানুষ ছবি আঁকা শিখতে পারবে। ছবি আঁকাকে সময় নষ্ট নয়, গর্বের একটা কাজ বলে মনে করতে পারবে। মুক্তির চ্যানেলে বিভিন্ন রঙের রিভিউও আছে। এতে করে রং কেনার আগে ধারণা লাভ করা সম্ভব। তিনি এই চ্যানেলটিকে বড় প্ল্যাটফরমে রূপ দিতে চান। যেখানে আগ্রহীরা বিনে পয়সার ছবি আঁকা শিখতে পারবে।

"