রা’আদ রহমান

  ২৩ নভেম্বর, ২০২১

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ প্রথম নারী কবি মেহেরুন্নেসা

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া প্রথম নারী কবি কে ছিলেন? আমাদের অনেকেরই এই প্রশ্নের উত্তর অজানা। কখনো এই প্রশ্নটা মাথায় এসেছে কি না, সেটাও একটি ভালো প্রশ্ন হতে পারে। যে স্বাধীন দেশে আমরা স্বাধীন নাগরিকের পরিচয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, যে মুক্ত আলো-হাওয়ায় বুকভরে শ্বাস নিচ্ছি, আমার-আপনার এই পরিচয়, এই স্বাধীনতা কিনতে অকুতোভয় সাহসে প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন শহীদ মেহেরুন্নেসা। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ নারী কবি।

ষাটের দশকে যখন বাংলা সাহিত্যে ঝড় তুলেছিলেন কিছু শক্তিমান কবি, তাদের মধ্যেও আলাদা করে নজর কেড়েছিলেন মেহেরুন্নেসা। বাংলা একাডেমির কবিতা পাঠের আসরে, প্রাণবন্ত হাস্যোজ্জ্বল এই কবিকে প্রায়ই পাওয়া যেত। একাত্তরের মার্চে বাঙালি জাতি যখন মুক্তির সংগ্রামে উত্তাল আন্দোলনের জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সবকিছু, তখন তিনিও একটা স্বাধীন দেশের স্বপ্ন চোখে নিয়ে রাজপথে, মিছিলের অগ্রভাগে সাহসের সঙ্গে হেঁটে গেছেন, স্লোগানে স্লোগানে ঝরিয়েছেন আগুনের ফুলকি।

১৯৪২ সালের ২০ আগস্ট জন্ম নেওয়া মেহেরুন্নেসা ছোটবেলা থেকেই মুখোমুখি হয়েছেন জীবনের কঠিন সংগ্রামের। বাবা আবদুর রাজ্জাক এবং মা নূরুন নেসারের চার সন্তানের মধ্যে মেহেরুন্নেসা ছিলেন দ্বিতীয়। তখনকার সময়ে মেয়েদের পড়ালেখার সুযোগ খুব বেশি ছিল না, বিশেষ করে মুসলিম মেয়েদের পড়ালেখার ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধিনিষেধ ছিল সবচেয়ে বেশি। স্কুলে ভর্তি হওয়া সত্ত্বেও মেহেরুন্নেসা পড়তে পারেননি, বেশ কয়েকটা স্কুল থেকে তাকে ফিরে আসতে হয়েছিল। মেহেরুন্নেসার বড় বোন মোমেনা বেগমও বিভিন্ন স্কুল ঘুরে কিছু পড়ালেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। ফলে বাবা এবং বড় বোনের উৎসাহ ও সহায়তায় একপর্যায়ে ঘরেই পড়ালেখা শুরু করেন তিনি এবং স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হন। মেহেরুন্নেসাদের কলকাতার কালিবাজারে কাপড় ও ভবানীপুরে জুতার দোকান ছিল। দোকানের আয়ে তাদের সংসার ভালোই চলছিল। কিন্তু ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় দাঙ্গায় পুড়িয়ে দেওয়া হয় তাদের দোকান এবং লুট হয়ে যায় বাড়ি। নিঃস্ব হয়ে পড়েন তারা। এ সময় জীবিকার জন্য কয়লার দোকানে বাবার সঙ্গে কাজ করতেন শিশু মেহেরুন্নেসা।

বাঙালি মুসলমান সমাজের ক্ষেত্রে একটি পরিবারের মেয়ে ঘরের বাইরে বাবার সঙ্গে কাজ করছে এই দৃশ্য খুব সহজ ছিল না। ফলে আশপাশের অনেক দোকানদার এবং এলাকাবাসী এর বিরোধিতা করে। কিন্তু আধুনিক ও উদার মানসিকতার বাবা আবদুর রহমান কারো বিরোধিতায় কান না দিয়ে এটিকে খুবই সহজভাবে নিয়েছিলেন। কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, গোঁড়ামিমুক্ত অসাম্প্রদায়িকতা এবং মানুষে মানুষে ভেদাভেদহীন সমতা ও মানবিকতার কবি হিসেবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাবার এই শিক্ষা ছিল মেহেরুন্নসার প্রথম পাঠ। একপর্যায়ে টিকতে না পেরে নামমাত্র মূল্যে কলকাতার বাড়ি বিক্রি করে সপরিবারে ১৯৫০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশে চলে আসে মেহেরুন্নেসার পরিবার। জানা যায়, তাদের বাড়িটি বর্তমানে সেখানকার বিধানসভার কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

বাংলাদেশে প্রথমে তার পরিবার পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার এলাকায় একটি ছোট্ট ভাড়া বাসায় উঠে। দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়ের সহায়তায় আবদুর রাজ্জাক শুরু করেন কাগজের ব্যবসা। এতে সুবিধা না হওয়ায় তিনি নাবিস্কো কোম্পানিতে এবং পরে হক কোম্পানিতেও সামান্য বেতনে চাকরি করেন। ১৯৫৪ সালে ভালো ঘরে বড় বোন মোমেনা বেগমের বিয়ের পর মেহেরুন্নেসা প্রিয় বাবাকে সাহায্য করার জন্য শুরু করেন কঠোর পরিশ্রম। ছোট্ট মেহেরুন্নেসার হয়তো জীবনের এত কঠিন হিসাবনিকাশ বোঝার বয়স হয়নি, কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে, আপনজনদের জন্য অল্প বয়সেই পরিণত হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সংসার পরিচালনার জন্য একসময় বাংলা একাডেমিতে অনুলিখনের কাজ শুরু করলেন।

দীর্ঘদিন অসুখে ভুগে ১৯৬৯ সালে বাবা আবদুর রাজ্জাক মৃত্যুবরণ করেন। মা ও দুই ভাইয়ের দায়িত্ব এসে পড়ে তার কাঁধে। ভালো জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসার পরও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তার পরিবারের জন্য, নতুন কিছু সৃষ্টির আকাক্সক্ষায়। দায়িত্বের বেড়াজালে সৃজনশীল কবি মনকে শক্ত বাঁধনে বেঁধে পত্রিকায় কপি লেখা আর প্রুফ দেখার কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। সেসময়ের প্রায় সব পত্রিকাতেই তার কবিতা ছাপা হতো, কিন্তু সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে একটা সময় আর শিল্প-সংস্কৃতিতে সময় দিতে পারলেন না। নিজের অপার সম্ভাবনাময় প্রতিভা ছোট ভাই দুটোকে মানুষ করার পেছনেই ব্যয় হচ্ছিল।

তবু এত কষ্টের ভেতরেও মার্চের সেই উত্তাল সময়ে কবিতা লেখা থেমে ছিল না তার। পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনী, বিহারি ও রাজাকারদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ২৩ মার্চ সকাল ১০টায় পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবসে মিরপুরের ৬ নম্বর সেকশনের ডি-ব্লক, ১২ নম্বর রোডে নিজ বাড়িতে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উড়িয়েছিলেন। গিজগিজে বিহারিদের ভেতর স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর মতো অকল্পনীয় দুঃসাহস তিনি দেখাতে পেরেছিলেন কারণ এই জন্মভূমির প্রতি তার নিবেদনটুকু ছিল নিঃশর্ত, নিঃস্বার্থ। অবাঙালি ও বিহারিদের হাতে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত মিরপুরের বাঙালিদের রক্ষার জন্য যিনি প্রিয় বান্ধবী কাজী রোজীকে সঙ্গে নিয়ে গঠন করেছিলেন- ‘অ্যাকশন কমিটি’। ২৩ তারিখেই ‘বেগম’ পত্রিকায় তার শেষ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। বারুদে এই কবিতা রীতিমতো তুমুল সাড়া ফেলে সেই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে।

জনতা জেগেছে...

‘মুক্তি শপথে দীপ্ত আমরা দুরন্ত দুর্বার,/সাত কোটি বীর জনতা জেগেছে এই জয় বাংলার।/পাহাড় সাগর নদী প্রান্তর জুড়ে-/আমরা জেগেছি নব চেতনার ন্যায্য নবাঙ্কুরে/বাঁচবার আর বাঁচাবার দাবী দীপ্ত শপথে জ্বলি-/আমরা দিয়েছি সব-ভীরুতাকে পূর্ণ জলাঞ্জলি-/কায়েমি স্বার্থবাদীর চেতনা আমরা দিয়েছি নাড়া/জয় বাঙলার সাত কোটি বীর, মুক্তি সড়কে খাড়া।/গণতন্ত্রের দীপ্ত শপথ কণ্ঠে কণ্ঠে সাধা-/আমরা ভেঙ্গেছি জয় বাঙলার বিজয়ের যত বাধা।/কায়েমি স্বার্থবাদী হে মহল কান পেতে শুধু শোন/সাত কোটি জয় বাংলার বীর ভয় করিনাকো কোন।

বেয়নেট আর বুলেটের ঝড় ঠেলে-/চির বিজয়ের পতাকাকে দেবো, সপ্ত আকাশে মেলে।/আনো দেখি আনো সাত কোটি এই দাবীর মৃত্যু তুমি,/চির বিজয়ের অটল শপথ ‘জয় এ বাংলা ভূমি।’

একজন মুক্তিযোদ্ধা, সাহসী বিপ্লবী কবির পরিচয়টা এক পাশে রাখলেও সেই ৫০ বছর আগে একজন নারীর এমন অসামান্য তেজ ও দীপ্তিভরা পথচলা আমাদের বিস্ময়াভিভূত করে। অথচ তাকে ন্যূনতম স্বীকৃতি তো দূরে থাক, আমরা তাকে ভালোভাবে চেনা তো দূরে থাক, আমরা তার নামটাও জানি না! তার এই প্রবল সাহসী যুদ্ধ পাকিস্তানিরা এবং তাদের দোসর রাজাকার আলবদররা মেনে নিতে পারল না। ২৫ মার্চের সেই পৈশাচিকতম গণহত্যার পর মিরপুর এলাকা পুরোপুরি চলে গেল অবাঙালি বিহারি নরপিশাচদের হাতে। তারা মেতে উঠল বাঙালি হত্যার বর্বরোচিত উৎসবে! সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের একপর্যায়ে মার্চের ২৭ তারিখ মিরপুরের কুখ্যাত কসাই কাদের মোল্লার (যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসি হয়েছে) নেতৃত্বে বিহারি এবং রাজাকারদের একটি দল মিরপুর ৬ নম্বর ডি-ব্লকে কবি মেহেরুন্নেসার বাড়িতে আক্রমণ করে। মানুষটা স্বাধীন বাংলাদেশ চেয়েছিলেন, অনলবর্ষী কবিতা বেরোতো তার আঙুল ফুঁড়ে। তাই মুশরিক, কাফের, ভারতের দালাল ইত্যাদি বিশেষণ দিয়ে প্রথমে ওরা মেহেরুন্নেসার ভাই দুজনকে কোপাতে শুরু করল। এটা দেখে মেহেরুন্নেসার মা কোরআন শরিফ বুকে চেপে ধরে ওদের কাছে কাকুতিমিনতি করে বলতে লাগলেন, আমরা মুসলিম, আমাদের মেরো না। কিন্তু ওই বর্বর নরপিশাচগুলো সেদিন কিছুই শোনেনি। চোখের সামনে মেহেরুন্নেসার ভাই দুজনকে জবাই করে ওরা ওই মায়ের সামনেই মেহেরুন্নেসাকে প্রচণ্ড যন্ত্রণা আর নির্যাতনে একটু একটু করে হত্যা করে। মেহেরুন্নেসার দুই ভাইয়ের মাথা নিয়ে ফুটবলের মতো খেলেছিল সেদিন ওরা। আর মেহেরুন্নেসার দেহ থেকে মাথা আলাদা করে চুল দিয়ে ফ্যানের সঙ্গে বেঁধে মাথাটা টাঙ্গিয়ে দিয়েছিল কাদের মোল্লা, আর দেহটা কাপড় শুকানোর তারে কাপড় শুকানোর মতো করে ঝুলিয়ে রেখেছিল বিহারিরা।

এই বীভৎস পৈশাচিকতার পুরোটাই তারা দেখতে বাধ্য করেছিল ওরা মেহেরুন্নেসার মাকে। যখন তিন সন্তানকে মায়ের সামনেই মেরে ফেলা হলো, এরপর ওরা কোরআন শরিফ বুকে চেপে থাকা মাকেও জবাই করে। কত বড় নৃশংস জালিম হলে নিজেকে মুসলমান পরিচয় দিয়ে কিছু মানুষ এমন অচিন্তনীয় নৃশংসতা চালাতে পারে, ভাবতে পারেন? পাশের বাসার এক প্রতিবেশী দেখেছিলেন এই পুরো ঘটনা, পরে তিনি পাগল হয়ে যান, সব সময় বলতে থাকতেন কীভাবে এই পুরো পরিবারের চারজনকে কসাই কাদের মোল্লা এবং বিহারি এবং রাজাকাররা মেরেছে। হা হা অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিল সেদিন কাদের মোল্লাসহ পাকিস্তানিরা। কোরআন শরিফ বুকে জড়িয়ে একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসেবে প্রাণভিক্ষা চেয়েও বাঁচতে পারেননি মেহেরুন্নিসার মা।

প্রিয় পাঠক, আর কিছু না, স্রেফ এটুকু চিন্তা করুন তো, আপনার সামনে আপনার সন্তানকে কেউ জবাই করছে, আর আপনাকে বাঁচিয়ে রেখেছে শুধু আপনার সন্তানকে বীভৎসভাবে জবাইয়ের সেই দৃশ্য দেখার জন্য। একটা সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে ভাবতে চেষ্টা করুন তো দৃশ্যটা! কি, পারছেন? কসাই কাদের মোল্লার বিচার চলাকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দিয়েছিলেন শহীদ কবি মেহেরুন্নেসার বন্ধু কবি কাজী রোজী। তার বর্ণনা থেকে উঠে এসেছে কবি মেহেরুন্নেসার ওপর নির্যাতনের চিত্র।

নিঃশর্ত ভালোবাসা এই জাতির অনাগত ভবিষ্যতের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ী দিকনির্দেশনা হয়ে রবে তখনই, যখন আমরা তার সম্পর্কে জানতে চাইব, জানাতে চাইব। শ্রদ্ধায় স্মরণ করব তাকে ও তাদের সব সময়। কবি মেহেরুন্নেসার প্রতি অতল শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close