দিপক রায়

  ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২১

গরুর খামারে সফল আক্তারী খানম

নিজের জমানো ৮৪ হাজার টাকা দিয়ে বাছুরসহ কেনা একটি গাভি থেকেই অর্ধশতাধিক গরু এখন তার খামারে। এরমধ্যে কিছু গরু বিক্রি করে এ পর্যন্ত আয় হয়েছে প্রায় ৩০ লাখ টাকা। বর্তমানে তার খামারে রয়েছে আরো ৩৭টি গরু। যার মধ্যে ১২টি ফিজিয়ান গাভি, ১০টি ষাঁড়, সাতটি বকনা, ছয়টি বাছুর ও দুটি গর্ভবতী ভারতীয় মুন্ডী প্রজাতির গাভি। এগুলো দেখাশোনা করার জন্য তার খামারে কর্মসংস্থান হয়েছে ৩ বেকার যুবকের। যাদের প্রত্যেকের (একেক জনের) মাসিক বেতন দেন ৭ হাজার টাকা। উপরোক্ত গল্পটি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার এক নারী খামারির। তিনি উপজেলার হাড়িয়ারকুঠি ইউনিয়নের জুম্মাপাড়া গ্রামের আসাদুজ্জামান আসাদের স্ত্রী আক্তারী খানম। তিনি একজন সফল গরুর খামারির পাশাপাশি হাড়িয়ারকুঠি ইউনিয়ন পরিষদের তথ্য কেন্দ্রের নারী উদ্যোক্তা।

হাড়িয়ারকুঠি ইউনিয়নের ডাংগীরহাট বাজার থেকে মাত্র অর্ধ কিলোমিটার পশ্চিম-দক্ষিণে জুম্মাপাড়া গ্রামের নিজ বাড়িসংলগ্ন তার গরুর খামারটি। খামারটির প্রধান ফটকের ওপরে টাঙানো রয়েছে খামারের নাম সংবলিত একটি সাইনবোর্ড; যাতে লেখা রয়েছে ‘আরএফটি ডেইরি ফার্ম’ এবং স্মারক নং-খামার রেজি/খ-৪/১৬-১৭/৫০০ ও নিবন্ধন নং/রং সিডি-২১১৩(তারিখ: ১৯-৩-১৭), একটি বাড়ি একটি খামার সদস্য নং ২৫ (তারিখ : ২৬-১০-২০১০)। আধুনিক পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়েছে খামারটি। গরু চুরি থেকে রক্ষা করতে নেওয়া হয়েছে করা নজরদারি। বাড়িসহ খামারটির চারদিকে স্থাপন করা হয়েছে কয়েকটি সিসি ক্যামেরা। খামার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, গরুগুলোকে সময়মতো খাদ্য দেওয়া, গরুগুলোর যত্ন নেওয়াসহ খামারের বিভিন্ন কাজের জন্য সেখানে নিযুক্ত রয়েছে তিন যুবক। গরুর খাদ্য তৈরিতে ব্যবহারের জন্য রাখা হয়েছে খড় কাটার ৪টি মেশিন।

খামারি আক্তারী খানম ও তার স্বামী আসাদুজ্জামান আসাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আক্তারী খানমের স্বামী আসাদ কর্মসূত্রে ঢাকায় থাকেন। আসাদ ঢাকার গাজীপুরে অবস্থিত এমএ মজিদ স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ এবং ঢাকার উত্তরায় অবস্থিত উত্তরা ইউনাইটেড কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। স্বামীকে ছেড়ে একা গ্রামের বাড়িতে সময় কাটছিল না তার। গরু দেখাশোনা করে সময় কাটানোর জন্য ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি তার জমানো টাকা এবং স্বামীর কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে ৮৪ হাজার টাকা একত্র করে বাছুরসহ একটি ফিজিয়ান প্রজাতির গাভি ক্রয় করেন। গাভিটি প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫ লিটার করে দুধ দিত। গাভি দেখাশোনা করে ভালো সময় কাটানোর পাশাপাশি প্রতিদিন মোটামুটি তার বাড়তি আয় হতে শুরু করে। এ থেকে তিনি উৎসাহিত হয় আরো কয়েকটি গাভি কেনার। কিছুদিন পর স্বামীর কাছে আবদার করে কিনে নেন আরো দুই ফিজিয়ান প্রজাতির বকনা বাছুর। কয়েক মাস পর এই বাছুর দুটিও প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে বাচ্চা প্রসব করে। এভাবে তার খামারে একে একে বৃদ্ধি পেতে থাকে গরুর সংখ্যা। বর্তমানে তার খামারে ছোট-বড় মিলে মোট ৩৭টি গরু রয়েছে। এরমধ্যে কিছু টাকার প্রয়োজন হলে খামারের কয়েকটি গরু বিক্রি করে তিনি পেয়েছেন ৩০ লাখ টাকা। তার বাড়ির রান্নার কাজে ব্যবহৃত হয় বায়োগ্যাস। যা এই খামারের গোবর থেকে ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে খামারটি থেকে প্রতিদিনের আয় সম্পর্কে জানতে চাইলে আক্তারী খানম বলেন, তার খামারের ফিজিয়ান গাভিগুলো প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫ লিটার পর্যন্ত দুধ দেয়। আর ভারতীয় মুন্ডি প্রজাতির গাভি দুটি প্রতিটি দুধ দেয় ৪০ লিটার পর্যন্ত। তার খামার থেকে সাধারণত প্রতিদিন প্রায় ২৫০ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। তবে যখন কোনো গাভি গর্ভবতী হয় তখন খামারে দুধ উৎপাদনের পরিমাণ কমে গেলেও সর্বনিম্ন দুধ উৎপাদন হয় ১৫০ লিটার পর্যন্ত। যা এই খামার থেকে তার আয়ের উৎস।

তার খামারের গরুগুলোর খাদ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৩৭টি গরুর জন্য প্রতিদিন তার খামারে ২ বস্তা চোপর, ২ বস্তা ডাল ও ভুট্টার খোসা ও ২ বস্তা ফিড এবং পরিমাণমতো খড় ও ঘাস প্রয়োজন হয়।

খামারের নামকরণ আরএফটি সম্পর্কে জানতে চাইলে আসাদ ও আক্তারী খানম দম্পতি বলেন, তাদের কোনো ছেলে সন্তান নেই। তিন মেয়ের নামে এই নামকরণ করা হয়েছে। বড় মেয়ে রাবেয়া বশরি তামান্না (১৬), মেজো মেয়ে ফাতেমা আক্তার তিন্নি (১৪) ও ছোট মেয়ে লাবিবা তাবাসসুম (৫)। তিন মেয়ের নামের প্রথম অক্ষর সংযোগ করে খামারের নামকরণ করা হয়েছে আরএফটি ডেইরি ফার্ম।

তারাগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের ভেটেরিনারি সার্জন ডা. সাগরিকা কার্জ্জী বলেন, গরুর খামার একটি সহজে লাভজনক একটি পেশা। এই পেশায় পুঁজি ও জায়গা দুটোই কম লাগে।

নারী ক্ষমতায়নের উন্নয়নের ফলে নারীরা আজ সবদিক দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে। শুধু বাইরে কাজ বা চাকরি করতে হবে তা নয়, এভাবে নিজ উদ্যোগে অল্প পুঁজি নিয়ে খামার গড়ে তোলাটাও একটা কাজ। ডেইরি খামারি আক্তারী খানমের সফলতা তারই একটি দৃষ্টান্ত। আক্তারী খানমকে দেখে অন্যান্য বেকার যুব নারীরাও গরুর খামার করে সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে নিজেদের বেকারত্ব দূর করুক- এই কামনাই করি।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ডা. এ কে এম ফরহাদ নোমান বলেন, বাংলাদেশ সরকার বেকারত্ব দূরীকরণের লক্ষ্যে বেকার যুব নারী-পুরুষদের উদ্যোক্তা হতে উৎসাহ জোগাচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় খামারিদের জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। অনেক খামারি করোনাকালীন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের ক্ষতির দিক বিবেচনা করে প্রণোদনা কর্মসূচির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

খামারিদের তালিকা তৈরি করে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে খামারিরা তাদের প্রণোদনার সুবিধা পাবেন। তাছাড়াও খামারিদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই উক্ত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করা হবে। কিছুদিন আগে আমরা প্রতিটি গ্রামে মাইকিং করে গরু ছাগলের শীতকালীন বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে বিনামূল্যে টিকা দিয়েছি। কয়েক দিনের মধ্যে আবারও বিনামূল্যে খুরারোগসহ কয়েকটি রোগপ্রতিরোধী টিকা বিনামূল্যে দেওয়া হবে। সবশেষে তারাগঞ্জ উপজেলার খামারিদের সর্বাঙ্গীন উন্নতি কামনা করেন তিনি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close