reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১

র‍্যামন ম্যাগসেসে বিজয়ী বিজ্ঞানী ফেরদৌসী কাদরী

প্রতিষেধকবিদ্যা ও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ফেরদৌসী কাদরী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টিকাবিষয়ক বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ছিলেন তিনি। তাকে এবার দেওয়া হলো এশিয়ার নোবেলখ্যাত র‌্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার। গত ৩১ আগস্ট ফিলিপাইন থেকে এ পুরস্কারটি ঘোষণা করা হয়। পুরস্কার ঘোষণার সময় কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘লাখো মানুষের উপকারে টিকার উন্নয়নে কাদরীর নিবেদিত ভূমিকার জন্য এই পুরস্কার দেওয়া হলো।’

পুরস্কার পাওয়ার পর বিজ্ঞানী কাদরী ম্যাগসেসে কমিটির কাছে একটি ভিডিও বার্তা পাঠিয়ে বলেন, ‘আমি আনন্দিত ও সম্মানিত বোধ করছি। র‌্যামন ম্যাগসেসেকে ধন্যবাদ। এই পুরস্কার আমি বাংলাদেশ, আমার জন্মভূমির প্রতি উৎসর্গ করলাম। সেইসঙ্গে পুরস্কারটি আমার প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআর-বিকে উৎসর্গ করছি। এই প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে আমার কাজ এগিয়ে নিতে সহযোগিতা করেছে। আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ বাংলাদেশ এবং পুরো বিশ্বের কাছে। আমি ঋণী আমার পরিবারের কাছে, আমার স্বামী ও তিন সন্তানের কাছে। তারা আমাকে বিগত দিনগুলোতে অনেক সহযোগিতা করেছে।’ ফেরদৌসী কাদরী তার বার্তায় বাকি জীবন জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে উৎসর্গ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জানান, ‘জনস্বাস্থ্য, উদ্ভাবনের মাধ্যমে বিশ্বের মানুষের মঙ্গলে আমি আমার বাকি জীবন উৎসর্গ করব।’

দীর্ঘ অভিযাত্রা

ডক্টর ফেরদৌসী কাদরী বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশের অন্তত ৫০ শতাংশ নারীর বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখা উচিত। দীর্ঘ সময় কর্মক্ষেত্রে নারীরা কাজ করলে তাদের নিয়ে পুরুষ সহকর্মীদের এক ধরনের ভুল ধারণা জন্মে। তিনি বলেন, ‘গবেষণার ব্যাপারগুলো আমার খুবই ভালো লাগত। বাংলাদেশে নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন হলে খুশি হতাম। চিকিৎসা বিজ্ঞানেও নতুন কিছুর আবিষ্কার, ইনসুলিনের জন্য নোবেল পুরস্কার এসব আমাকে খুব নাড়া দিত। এসবই আমাকে টানত। তাই বিজ্ঞানী হয়েছি। আমাদের সমাজে এক ধরনের ধারণা আছে। মেয়েরা এক ধরনের এবং ছেলেরা অন্য ধরনের কাজ করবে। আমি বেশি সময় ল্যাবে কাজ করলে পুরুষ সহকর্মীরা বলত, আপনি এতক্ষণ এখানে থাকলে আপনার বাচ্চাকে মানুষ করবে কে? সেসব কথা আমি কখনো ভুলতে পারব না। আমাদের সমাজে নারীদের বেড়ে ওঠা, নারীদের নিয়ে চিন্তাভাবনা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এটা আদিকাল থেকেই হয়ে আসছে। এটার প্রভাব এত বেশি কাজ করে যে, এটা থেকে আমরা খুব সহজে বের হয়ে আসতে পারব না।’

বিজ্ঞানে নারীদের নিয়ে যত ভুল ধারণা আছে সেসব দূর করার জন্য নারীদের বিজ্ঞানে আরো বেশি যুক্ত হওয়া উচিত। অভিভাবকদের তিনি বেশি উৎসাহিত করেন মেয়েদের বিজ্ঞানে ক্যারিয়ার তৈরি করার জন্য। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আমাদের প্রচুর সম্ভাবনা আছে। আজ আমি একটি পুরস্কার পেয়েছি। কাল মেয়েদের আরো বড় পুরস্কার জেতার সুযোগ আছে।’

বিজ্ঞানচর্চায় ব্যস্ত থাকলেও নিজের তিন সন্তানকেও সুশিক্ষিত করেছেন এই নারী বিজ্ঞানী। তাদের একজন ডাক্তার, একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার এবং একজন ব্যাংকার হিসেবে কাজ করছেন।

গবেষণার জীবন

বাংলাদেশি প্রতিষেধকবিদ্যা এবং সংক্রামক রোগ গবেষণাকারী বিজ্ঞানী ফেরদৌসী কাদরীর জন্ম ১৯৫১ সালের ৩১ মার্চ। ড. ফেরদৌসী কাদরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও আণবিক জীববিদ্যা বিভাগ থেকে ১৯৭৫ সালে বিএসসি ও ১৯৭৭ সালে এমএস ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮০ সালে যুক্তরাজ্যের লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন/প্রতিষেধকবিদ্যা বিভাগ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। আইসিডিডিআর-বির প্রতিষেধকবিদ্যা বিভাগ থেকে পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা শেষ করার পর, তিনি একই প্রতিষ্ঠানে ১৯৮৮ সালে সহযোগী বিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দেন। পরে তিনি একই প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী এবং মিউকোসাল ইমিউনোলজি এবং ভ্যাকসিনোলজি বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান।

তিনি প্রায় ২৫ বছর কলেরার টিকা উন্নয়নে কাজ করেছেন। এ ছাড়া তিনি ইটিইসি, টাইফয়েড, হেলিকোব্যাক্টার পলরি, রোটাভাইরাস ইত্যাদি অন্যান্য সংক্রামক রোগে বিশেষজ্ঞ। তিনি ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডাইরিয়াল ডিজিজ রিসার্চের (আইসিডিডিআর-বি) মিউকোসাল ইমিউনোলজি এবং ভ্যাকসিনোলজি ইউনিটের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার বৈজ্ঞানিক সাফল্য আন্ত্রিক ও ডায়রিয়াজনিত প্রতিষেধক, টিকাসহ ভাইব্রিও কলেরা এবং এন্টারোটক্সিজেনিক এশেরিশিয়া কোলাই যেগুলো ডায়রিয়াসহ আন্ত্রিক রোগের প্রধান কারণ। তার প্রধান অধ্যয়নের বিষয় ছিল বাংলাদেশে হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি এবং টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের প্রতিক্রিয়ার ওপর গবেষণা ও প্রতিষেধক প্রস্তুত করা।

পড়াশোনা

ফেরদৌসী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও আণবিক জীববিদ্যা বিভাগ থেকে ১৯৭৫ সালে বিএসসি ও ১৯৭৭ সালে এমএস ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮০ সালে যুক্তরাজ্যের লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন/প্রতিষেধকবিদ্যা বিভাগ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। আইসিডিডিআর-বির প্রতিষেধকবিদ্যা বিভাগ থেকে পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা শেষ করার পর, একই প্রতিষ্ঠানে ১৯৮৮ সালে সহযোগী বিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দেন। পরে তিনি একই প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী এবং মিউকোসাল ইমিউনোলজি ও ভ্যাকসিনোলজি বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান।

অবদান

ফেরদৌসীর প্রধান গবেষণার বিষয় অন্ত্রের রোগ। বিশেষ করে ইমিউনোলজি, জিনোমিকস, প্রোটোমিক প্রযুক্তি এবং ডায়াগনস্টিকস ও ভ্যাকসিনে উন্নতি সাধন। তিনি বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের জন্য নতুন ধরনের সহজলভ্য কলেরা টিকা উন্নয়নে কাজ করেছেন। তিনি ব্যয়বহুল ‘ডকোরাল’ টিকার পরিবর্তে ‘স্যাংকল’ নামক একটি টিকা ঢাকায় ব্যবহার করে সফলতা লাভ করেন। পরে টিকাটি বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।

সম্মান ও পুরস্কার

২০০৮ সালে ফেরদৌসী বাংলাদেশ বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির গোল্ড মেডেলপ্রাপ্ত হন। ২০০২ সালে উন্নয়নশীল দেশে সংক্রামক আন্ত্রিক রোগ গবেষণার জন্য অর্জন করেন ক্রিস্টোফ মেরিইউক্স পুরস্কার। ২০১৩ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য বিশ্ব বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির বার্ষিক সিএন রাও পুরস্কার পান, যেটা তাওস থেকে দেওয়া হয়। জাতিসংঘের প্রস্তাবিত একটি প্রযুক্তি ব্যাংক এবং বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনের সাপোর্টিং ব্যবস্থাগুলো সাংগঠনিকভাবে আরো কর্মক্ষম করে তুলতে ২০১৪ সালে তাকে উচ্চপর্যায়ের একটি প্যানেলের পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ক্রিস্টোফ অ্যান্ড রোডোলফ ফাউন্ডেশনের গ্র্যান্ড প্রাইজ লাভ করেন। ২০১২ সালে আইসিডিডিআর-বির শ্রেষ্ঠ নারীকর্মীর স্বীকৃতি পান।

উন্নয়নশীল দেশে শিশুদের সংক্রামক রোগ চিহ্নিতকরণ ও বিশ্বব্যাপী এর বিস্তার রোধে প্রাথমিক চিকিৎসা কার্যক্রম এবং টিকাদান কর্মসূচি জোরদারে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ২০২০ সালে তিনি ‘লরিয়েল-ইউনেসকো উইমেন ইন সায়েন্স অ্যাওয়ার্ড’ (এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল) লাভ করেন। ২০১৩ সালে অনন্যা শীর্ষ ১০ পুরস্কার পান। এ ছাড়া ২০২১ সালে সিঙ্গাপুরভিত্তিক বিজ্ঞান সাময়িকীতে এশিয়ার শ্রেষ্ঠ ১০০ বিজ্ঞানীর তালিকায় তিনি অন্তর্ভুক্ত হন। বাংলাদেশ আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজির আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রদূত এবং বাংলাদেশের বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির একজন সদস্যও ফেরদৌসী।

র‌্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার

১৯৫৭ সালের এপ্রিল মাসে প্রবর্তিত হয় র‌্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার। এটি প্রবর্তন করেন নিউইয়র্ক শহরভিত্তিক রকফেলার ব্রাদার্স ফান্ডের সম্মানিত ট্রাস্টিরা। এই পুরস্কারটির প্রবর্তন করা হয় ফিলিপাইনের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি র‌্যামন ম্যাগসেসেকে স্মরণ করে। এ পুরস্কারটিকে এশিয়ার নোবেল পুরস্কার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রতি বছর র‌্যামন ম্যাগসেসে অ্যাওয়ার্ড ফাউন্ডেশন এশিয়ার বিভিন্ন ব্যক্তি এবং সংগঠনকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান ও কৃতিত্বের জন্য এই পুরস্কার প্রদান করে। ছয়টি শ্রেণিতে এই পুরস্কার দেওয়া হয়- সরকারি সেবা, জনসেবা, সামাজিক নেতৃত্ব, সাংবাদিকতা, সাহিত্য এবং যোগাযোগে উদ্ভাবনী কলা, শান্তি ও আন্তর্জাতিক সমন্বয়, নতুন নেতৃৃত্ব।

১৯৫৭ সালের মে মাসে ফিলিপাইনের সাতজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিকে র‌্যামন ম্যাগসেসে অ্যাওয়ার্ড ফাউন্ডেশন (আরএমএএফ) ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য করা হয়। এই অলাভজনক প্রতিষ্ঠানটি পুরস্কারটির বাস্তবায়নে কাজ করে। প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রদায়, লিঙ্গ, জাতীয়তা ইত্যাদিকে পাশ কাটিয়ে এশিয়ার বিভিন্ন ব্যক্তি এবং সংগঠনের স্বীকৃতি ও সম্মাননা দেয়। শুরুতে পাঁচটি শ্রেণিতে দেওয়া হলেও ২০০০ সালে ম্যাগসেসে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে ‘নশংন নেতৃত্ব’ নামে নতুন আরো একটি শ্রেণিতে পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা দেওয়া হয়। ব্যক্তিগতভাবে অনূর্ধ্ব ৪০ বছর বয়সিকে তার সম্প্রদায়ের সামাজিক পরিবর্তনে অসামান্য অবদানকে স্বীকৃতি জানাতে ফোর্ড ফাউন্ডেশন সহযোগিতা ও অর্থায়ন প্রদান করে। এ পুরস্কারের ক্ষেত্রে ব্যক্তির নেতৃত্ব অবশ্যই নিজ সম্প্রদায়ের বাইরে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত ও পরিচিত হতে পারবে না। ২০০১ সালে প্রথমবারের মতো নতুন নেতৃত্ব শ্রেণিতে পুরস্কার দেওয়া হয়।

তথ্য সূত্র : সংগৃহীত

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close