reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২৪ আগস্ট, ২০২১

আমৃত্যু মানুষের পাশে ভ্যালেরি টেইলর

১৯৬৯ সালের কথা। তখন সুদর্শনা ভ্যালেরি টেইলরের বয়স ২৫ বছর। লন্ডনের সেন্ট টমাস হাসপাতাল থেকে ফিজিওথেরাপির ওপর পড়াশোনা শেষ করেছেন। বাবার মতো তারও ইচ্ছা মানবসেবা করবেন। এ উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকারের ভলান্টারি সার্ভিস ওভারসিজে (ভিএসও) আবেদন করেন। প্রতিষ্ঠান থেকে তাকে জানানো হয়, অন্তত দেড় কিংবা দুই বছরের কাজের অভিজ্ঞতা ছাড়া কেউ ভিএসওতে যোগ দিতে পারবে না। ১৯৬৯ সালের মাঝামাঝি সুযোগ এসে যায়। চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনার খ্রিস্টান হাসপাতালের জন্য একজন ফিজিওথেরাপিস্টের দরকার হয়। তখন অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন ভ্যালেরি। দেড় বছরের জন্য বাংলাদেশে এসে কাটিয়ে দিলেন ৫০ বছর!

প্রথম দর্শনেই বাংলাদেশের প্রেমে পড়েছিলেন ভ্যালেরি এন টেইলর। ৫০ বছর আগের স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামের এক নিভৃত গ্রাম চন্দ্রঘোনায় এসেছিলাম। বিমান থেকে নেমে এ দেশের সবুজ প্রকৃতির প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। একদিনের কথা। আমি যে হাসপাতালে কাজ করতাম, তার পাশেই ছিল নদী। একদিন নদীতে ঘন কুয়াশা ছিল। আশপাশে আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ একটি সাম্পান আমার চোখে পড়ল। মাঝি দাঁড় বাইছেন, আমার মনে হলো যেন সাম্পানটি ভেসে আছে পানির দু-তিন ফুট ওপরে। কারণ চারপাশে কুয়াশার মধ্যে শুধু সাম্পানটি দেখা যাচ্ছিল। এ দৃশ্য এখনো পরিষ্কারভাবে মনে আছে আমার।’

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভ্যালেরিকে যেমন মুগ্ধ করেছিল, তেমনি এ দেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ও চিকিৎসাব্যবস্থার দুরবস্থা তাকে ব্যথিত করেছিল। তাই তো এ দেশে পা দিয়েই স্বপ্ন দেখেছিলেন, মানবসেবায় কাজ করবেন। নিজের জীবন উৎসর্গ করবেন মানুষের জন্য। বাংলাদেশে এসেছিলেন দেড় বছরের জন্য। এরপর সিদ্ধান্ত নিলেন, এ দেশের মানুষের জন্যই তিনি কাজ করে যাবেন। এরপর আর পিছু ফিরে তাকাননি।

সেই ২৫ বছর বয়সি ভ্যালেরির এখন বয়স ৭৫ পেরিয়ে। দীর্ঘ পাঁচ দশকে তিনি এ দেশের চিকিৎসাসেবায় যে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, গড়ে তুলেছেন নানা সেবামূলক প্রতিষ্ঠান- তার তুলনা মেলা ভার। এখন তার একটিই উদ্দেশ্য- বাংলাদেশের মানুষের জন্য আমৃত্যু কাজ করে যেতে চান এ মহীয়সী নারী।

সত্তরের দশকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত কিংবা নানাভাবে আঘাতপ্রাপ্ত মানুষের চিকিৎসার জন্য তেমন ব্যবস্থা ছিল না বাংলাদেশে। দুর্ঘটনায় কত মানুষের জীবন বিপন্ন হয়, অচল হয়- তাদের কাছে আলোকবর্তিকা হয়ে দেখা দেন ভ্যালেরি। নিজ উদ্যোগে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য ‘সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড (সিআরপি)’ নামক দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। তার গড়া সেই প্রতিষ্ঠানের বয়সও ৪০ বছর পেরিয়ে গেল। দীর্ঘ চার দশক ধরে অসংখ্য মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন, নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছেন ভ্যালেরি।

কাজের মধ্যেই শুরু হয় বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ। তখন তাকে বাধ্য হয়ে ফিরে যেত হয় ইংল্যান্ডে। কিন্তু তিনি বিপদে দূরে সরে যাননি। যুদ্ধের সময়ই সেপ্টেম্বর মাসে তিনি আবার বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এ দেশে পা দিয়েই বুঝতে পারেন, বিপন্ন মানুষের জন্য কত কী যে করার আছে। যুদ্ধের কারণে বহু মানুষ আহত, পঙ্গু। তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন তাদের চিকিৎসাসেবা দিতে। এ কাজের মধ্যেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন- বাংলাদেশে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের জন্য একটি হাসপাতাল গড়বেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ভ্যালেরি নতুন স্বপ্নের জন্য কাজ শুরু করেন। পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থ সংগ্রহ ও অন্যান্য সাহায্যের ব্যবস্থা করতে ১৯৭৩ সালে তিনি ইংল্যান্ড যান। কিছুদিন পর পুনরায় বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এ সময় তিনি ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে কাজ শুরু করেন। ১৯৭৯ সালে এই হাসপাতালের দুটি পরিত্যক্ত গুদামঘরে তিন-চারজন রোগী নিয়ে শুরু করেন সিআরপি। সেই ছোট্ট সিআরপি এখন এক মহিরুহ।

তিলে তিলে ভ্যালেরি গড়ে তুলেছেন সিআরপি, এখন যেটি দাতব্য চিকিৎসার ক্ষেত্রে সারা বিশ্বের উদাহরণ। নিজের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য ভ্যালেরি সাভারে ১০০ শয্যার স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি সেবা চালু করেন। প্রয়োজনে তিনি শয্যাসংখ্যা বাড়িয়ে নিতে পারেন; যেমনটি করেছিলেন রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আতদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের সময়। সিআরপি রানা প্লাজা ধসে আহত ৫০৯ জন রোগীকে চিকিৎসাসেবা প্রদান এবং ৩৭০ জন ব্যক্তিকে পুনর্বাসিত করেছে। স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি চিকিৎসায় সিআরপি উপমহাদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন হাসপাতাল। গত ৪০ বছরে এ হাসপাতালে (বহির্বিভাগসহ) প্রায় ৪০ লাখ রোগী চিকিৎসাসেবা নিয়েছে।

শুধু ঢাকার সাভারে নয়, দেশের নানা জায়গায় এখন যে পক্ষাঘাতগ্রস্তরা চিকিৎসা পায়, তার পেছনেও একটা বড় অনুপ্রেরণার নাম ভ্যালেরি টেইলর। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সিআরপির সেবাকর্মকে সমগ্র বাংলাদেশে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে সাভার সিআরপি ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ১৩টি শাখা প্রতিষ্ঠা করেছেন।

বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদানের জন্য ১৯৯৮ সালে সরকার ভ্যালেরিকে বাংলাদেশের নাগরিত্ব প্রদান করে। এরপর ২০০৪ সালে তাকে স্বাধীনতা পদক দিয়ে সম্মানিত করা হয়। দুস্থ, দুর্গত মানুষের সেবার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৫ সালে ব্রিটিশ সরকার ভ্যালেরিকে অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার পদকে ভূষিত করে। ১৯৯৬ সালে আর্থার আয়ার ব্রুক স্বর্ণপদক, ২০১১ সালে শেল্টেক্ পদক, জাতীয় সমাজসেবা পুরস্কারসহ নানা পুরস্কার পেয়েছেন। পেয়েছেন অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা। ২০১৩ সালে রোটারি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে ‘দ্য ওয়ান’ পুরস্কার হিসেবে এক লাখ মার্কিন ডলার পুরস্কার পান। এই অর্থ ভ্যালেরি সিআরপিতে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য একটি নতুন আবাসিক হোস্টেল তৈরিতে ব্যবহার করেন। এ ছাড়া মিরপুরে বিশাল ভবন নির্মাণ করেছেন। ভবনের ভাড়া থেকে প্রাপ্ত অর্থ ব্যয় করা হয় চিকিৎসাসেবায়।

চিকিৎসা ও পুনর্বাসনসেবা প্রদানের পাশাপাশি ভ্যালেরির স্বপ্ন ছিল সিআরপিতে একটি অ্যাকাডেমিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা। তিনি বলেন, ১৯৯৯ সালে বিএসসি কোর্স (ফিজিওথেরাপি ও অকুপেশনাল থেরাপি) চালু করা হয়। স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি কোর্স চালু হয়েছিল ২০০৪ সালে। মূলত স্পাইন কর্ড ইনজুরির রোগীদের পরিপূর্ণ পুনর্বাসনসেবা ত্বরান্বিত করার ব্রত নিয়ে তিনি বিএইচআইতে রিহ্যাব প্রফেশনালস কোর্স শুরু করেছিলেন। প্রতিবন্ধীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এই প্রতিষ্ঠান বর্তমানে ১৩টি বিষয়ে অনার্স, ডিপ্লোমা ও অ্যাসিস্ট্যান্ট কোর্স করাচ্ছে।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মক্ষম করার উদ্দেশে সিআরপি সাভার ও আশুলিয়ার গণকবাড়ি কেন্দ্রে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। এখানে বিনা মূল্যে শারীরিক প্রতিবন্ধিতার শিকার ব্যক্তিদের তাদের নিজ নিজ শিক্ষা, দক্ষতা ও আগ্রহ অনুযায়ী সেলাই, ইলেকট্রনিকস মেরামত, কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন, দোকান ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পাশাপাশি তাদের কর্মসংস্থানের ব্যাপারেও সহায়তা করা হয়।

জানা যায়, সাভারে সিআরপির প্রধান কার্যালয়ে প্রতি মাসে গড়ে পাঁচ হাজার রোগী ফিজিওথেরাপি এবং এক হাজার রোগী অকুপেশনাল থেরাপি চিকিৎসা নিয়ে থাকে। মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য রয়েছে একটি শিশু ইউনিট। সেখান থেকেও প্রতি মাসে শতাধিক শিশু চিকিৎসাসেবা নেয়।

পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিদের সেবা ও কল্যাণের কাজেই ভ্যালেরি জীবনের অধিকাংশ সময় পার করেছেন। সর্বদা অনাড়ম্বর জীবনযাপন করেন। অপচয় একদম পছন্দ করেন না। বাংলাদেশে মাত্র চারজন রোগী নিয়ে যে প্রতিষ্ঠান পথচলা শুরু করেছিল, ভ্যালেরির নিরলস প্রচেষ্টায় ও পরিশ্রমে আজ সেটি বিশ্বের অন্যতম পুনর্বাসনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে সিআরপিতে এক হাজারের বেশি কর্মী কাজ করছেন। তাদের অনেকে এখানে চিকিৎসা নিতে এসে পুনর্বাসিত হয়েছেন।

নিজের স্বপ্নের কথা জানিয়ে ভ্যালেরি টেইলর বলেন, ‘যত দিন বাঁচব, তত দিন বাংলাদেশের মানুষের জন্যই কাজ করে যাব। আশা করি, আমি না থাকলেও বাংলাদেশে শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের সুচিকিৎসা সুবিধা বাড়বে।’ ভ্যালেরি টেইলর চান, সিআরপির সঙ্গে সম্পৃক্তরা এটিকে এগিয়ে নেবেন। এজন্য চালু করেছেন নতুন স্লোগান- ‘আমরাই সিআরপি’। তার বিশ্বাস, সিআরপি থেকে যারা চিকিৎসাসেবা নিয়েছে, যারা এখানে কর্মরত, তারাই এ প্রতিষ্ঠানের আলো সারা দেশে ছড়িয়ে দেবেন।

নওশাদ জামিল ও তায়েফুর রহমান

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close