reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২৫ মে, ২০২১

ক্ষুদ্রশিল্পের বৃহৎ মানব জাহানারা বেগম

‘আড়ং’ প্রতিষ্ঠা পায় ১৯৭৮ সালে আর ‘জাহানারা কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ’ প্রতিষ্ঠা পায় ১৯৫২ সালে কুমিল্লা শহরের নানুয়ার দিঘির পাড়ে। মাত্র ৭৫ পয়সা পুঁজি নিয়ে জাহানারা বেগম তার হস্ত ও কারুশিল্প প্রতিষ্ঠান ‘জাহানারা কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ’ শুরু করেন। লক্ষ্য নারীর ক্ষমতায়ন।

জাহানারা বেগম কারো ভাষায় কুটিরশিল্পের অগ্রসৈনিক, কারো কাছে কুটিরশিল্পের রানি, কারো কাছে দিনবদলের সারথি, কারো কাছে পথপ্রর্দশক, কারোবা কাছে ছোট শিল্পের বড় মানুষ, কারো দৃষ্টিতে তিনি মানুষ গড়ার কারিগর। অথচ সারা দেশের কথা বাদ দিলাম তার শহর কুমিল্লার বর্তমান প্রজন্মের কজনইবা জানেন কুমিল্লার গর্ব বাংলাদেশের জাতীয় এবং সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’-এ ভূষিত এই মহীয়সী নারী সম্বন্ধে।

বাংলাদেশের কুটিরশিল্প আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা, সমাজ উন্নয়নকর্মী জাহানারা বেগম নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে কুটিরশিল্পের কাজে হাত লাগিয়ে এ শিল্পকে নিয়ে গেছেন বিশ্বদরবারে। দেশের কুটিরশিল্পের বিকাশ ও অগ্রগতিতে তার অসামান্য অবদান সর্বজনস্বীকৃত। তার এই মহতী অবদানের জন্য তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অজস্র পুরস্কার, স্বীকৃতি ও সম্মান পেয়েছেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা স্বাধীনতা পদক, ১৯৬২ সালে রানি এলিজাবেথ গভর্নর স্বর্ণপদক, জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ সমবায়ী পুরস্কার, পল্লী উন্নয়নে শ্রেষ্ঠ কর্ম হিসেবে বার্ড সম্মাননা পদক ইত্যাদি। সমাজসেবী ও নারী সংগঠক হিসেবে জীবনে প্রায় ১২৬টি পদক লাভ করেন তিনি। এ ছাড়া দুস্থ ও অসহায় মানুষ বিশেষ করে নারীদের কর্মসংস্থান, শিক্ষা বিস্তারে তার অসমান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে জাহানারা বেগমকে ‘সাদা মনের মানুষ’ সম্মাননায় ভূষিত করা হয়।

এতসব সম্মাননা তিনি গ্রহণ করেছেন নীরবে। এ সম্মাননা তাকে করেছে বিনম্র। স্বশিক্ষায় শিক্ষিত এই মহীয়সী নারী প্রতিষ্ঠান ও কর্মমুখী শিক্ষা বিস্তারে কাজ করেছেন অবিরামভাবে। গড়ে তুলেছেন জাহানারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, জাহানারা কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ, মনির কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ এবং ট্রেনিং সেন্টার, বরুড়া উপজেলার আড্ডা গ্রামে আড্ডা ওমেন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুল, বজ্রপুর মহিলা সমবায় সমিতি লিমিটেড, কুমিল্লা সদর (দ.) কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি লিমিটেড, জাহানারা ফিমেল এডাল্ট স্কুল অ্যান্ড হ্যান্ডি ক্রাফটস ট্রেনিং সেন্টারের মতো অনেক প্রতিষ্ঠান।

জাহানারা বেগম বলতেন, মানুষকে শক্তিশালী করতে কর্মশিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্র বিস্তারে প্রতিষ্ঠান গড়া প্রয়োজন। আর এই বিশ্বাসকে ধারণ করে তিনি নিরন্তর কাজ করেছেন দুস্থ ও অসহায় মানুষ বিশেষ করে নারীর জীবন সাজাতে। অজস্র দুস্থ ও অসহায় নারীর হাতকে তিনি পরিণত করেছেন কর্মীর শক্তিশালী হাতে।

জাহানারা কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ নামটি শুনে শিল্পপ্রতিষ্ঠান মনে হলেও মূলত এই প্রতিষ্ঠানে মানুষদের কর্মমুখী শিক্ষা প্রদান করা হয়। টাকার অঙ্কে এই প্রতিষ্ঠানের মূলধন স্বল্প হলেও এই শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ লক্ষ কোটিতে। হাজার হাজার নারী ও পুরুষকে তিনি কর্মক্ষম করেছেন। গড়ে দিয়েছেন জীবনধারণের পথ। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষ মরে যায়, মানুষের কর্ম ধ্বংস হয় না।

দেশীয় উপকরণকে যথাযথ সম্পদে রূপান্তরে তার ছিল সিদ্ধহস্ত। একটি বাঁশের ১২ ইঞ্চি টুকরা হতে তিনি ৬টি স্কেল, গ্লাস প্লেট এবং টুথপিক তৈরি করতে পারতেন। সম্পদের যথাযথ ব্যবহারে এ ধরনের অনেক জাদু তিনি শিখিয়েছেন তার অগণিত শিক্ষার্থীকে।

তিনি বিশ্বাস করতেন, অর্থ মুখ্য কোনো ব্যাপার নয়, প্রয়োজন চিন্তা, ইচ্ছা ও কাজের মনোবল।

জাহানারা বেগমের মতে, নারীদের অগ্রগতির জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তবে সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য শিক্ষা নয়, বরং নিজকে আলোকিত করে এমন ধরনের শিক্ষা প্রয়োজন, যে শিক্ষা নারীকে আত্মবিশ্বাসী করে, সেই কর্মমুখী শিক্ষা। নারীর বিকাশের জন্য সমাজ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া প্রয়োজন বলে তিনি বিশ্বাস করতেন।

পর্দানশীল পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও তার সমাজ তার কাজে কখনো বাধা হয়নি। পিতা মৌলভী নাসির উদ্দিন ও মাতা সুলতানা রেজিয়া বেগমের সহযোগিতায় কিশোরী বয়সে তিনি বাড়িতে গড়ে তোলেন মেয়েদের শিক্ষালয়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে পিতা-মাতাকে উদ্বুদ্ধ করতেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেয়েদের পাঠাতে।

কোনো কাজকেই তিনি ছোট মনে করতেন না। ছোট-বড় সব কাজেই তিনি সক্রিয়ভাবে এগিয়ে যেতেন। যাতে অন্য মানুষও কাজের প্রতি উৎসাহী হন। কাজ শেখার প্রতি ছিল তার অফুরন্ত আগ্রহ, কাজ শেখার জন্য ছুটে গেছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

অনেক মানুষকে বিভিন্ন কাজ করে দিয়েছেন নতুন একটি কাজ শেখার জন্য। নির্মাণের নেশায় নিজের হাতে বাড়ির মসজিদের দেয়ালের ইট গেঁথেছেন। নিজের বাড়ির ও স্কুলের দেয়াল গড়তে নিজেও কাজ করেছেন একজন নির্মাণশ্রমিকের মতো।

আজীবন কাজ করেও কাজের নেশা থামেনি জাহানারার। অসুস্থ হয়েও হুইলচেয়ারে বসে মেয়েদের কাজ শিখিয়েছেন। বার্ধক্য ও অসুস্থতা তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি, মানুষ গড়ার এই কারিগর মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত মেয়েদের কাজ শিখিয়েছেন।

তিনি বলতেন, আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ কিন্তু আমার মন ও চিন্তা অসুস্থ নয়, আমি মানুষের জন্য চিন্তা করতে পারি। বলতেন, নেতিবাচক নয় বরং ইতিবাচক ও দিকনির্দেশনামূলক কাজের সম্পর্কে আলোচনা করা উচিত।

কুমিল্লা শহরের গাংচর এলাকায় জন্মগ্রহণকারী এই মহীয়সী নারী ২০১০ সালে ১৭ জানুয়ারি মানবতার তরে অর্পিত দায়িত্ব পালন শেষে ৭৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

আজও দেশি-বিদেশি গণ্যমান্য অগণিত ব্যক্তি কুমিল্লা শহরের নানুয়ার দীঘির পাড়ের ‘জাহানারা কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ’ পরিদর্শন করেন।

সূত্র : বাঙালিয়ানা

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close