প্রীতি রাহা

  ১৮ মে, ২০২১

আমাদের বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার

বীরকন্যা প্রীতিলতা ছিলেন একজন সাহসী বিপ্লবী নারী। এজন্যই তার নামের প্রথমে যুক্ত করা হয় ‘বীরকন্যা’ শব্দটি। বাংলাদেশের এই বীরকন্যা সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? এই বিষয়ে জানতে সবজান্তা গুগলকে জিজ্ঞাসা করতেই উঠে এলো কিছু তথ্য। ২০১৫ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছিল একটি প্রতিবেদন। এর আগে আমি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে এই সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন দেখেছিলাম। ব্যাপারগুলো সত্যিই দুঃখজনক। প্রীতিলতা হলে থাকেন এমন ছাত্রীরাও জানেন না তার সম্পর্কে। তাদের জ্ঞানার্জনের কোনো আগ্রহ নেই। পাঠ্যপুস্তকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে তাদের আগ্রহ। এই ব্যাপারগুলো ভীষণ লজ্জার। আমাদের দেশে বড় পরিসরে বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে স্মরণ করা হয় না। বাংলার এক গর্বের নাম প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে স্মরণ করার উদ্যোগ নেওয়া আবশ্যক।

বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। ১৯১১ সালের ৫ মে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার এবং মার নাম প্রতিভা ওয়াদ্দেদার। বাবা জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল অফিস কর্মকর্তা ছিলেন। ছয় ভাইবোনের মধ্যে প্রীতিলতা ছিলেন দ্বিতীয়। তার পারিবারিক ডাকনাম ছিল ‘রানী’ এবং ছদ্মনাম ছিল ফুলতার।

১৯১৮ সালে চট্টগ্রামের ডা. খাস্তগীর উচ্চবালিকা বিদ্যালয়ে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয়। তিনি অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি এতটাই মেধাবী ছিলেন যে, তার মেধার প্রমাণ পেয়ে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে শুরুতেই তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করে নিয়েছিলেন। ১৯২৬ সালে তিনি মেধাতালিকায় বৃত্তি লাভ করেন। পরে ১৯২৭ সালে ডা. খাস্তগীর উচ্চবালিকা বিদ্যালয় থেকে লেটার মার্কসহ ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন তিনি। এরপর উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে লেখাপড়ার জন্য প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ভর্তি হন রাজধানী ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজে। ১৯২৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মিলিত মেধাতালিকায় পঞ্চম স্থান এবং মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে আইএ পাস করেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। পরে প্রীতিলতা কলকাতার বেথুন কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৩২ সালে তিনি দর্শনে স্নাতক পাস করেন। সেই বছরেই তিনি চট্টগ্রামে ফিরে আসেন এবং নন্দনকানন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপরই তিনি বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে যোগ দেন মাস্টারদার দলে।

১৯৩২ সালে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর ১৯৩৩ সালের ২৫ মার্চ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে তার হাতে তুলে দেওয়ার কথা ছিল স্নাতক ডিগ্রির সনদ। কিন্তু তিনি আর সেই ডিগ্রি সনদ নিতে পারেননি। কারণ, এর আগেই প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার শহীদ হন। তখন ব্রিটিশ সরকার তার পরিবারের হাতে তুলে দেয়নি সেই সনদ। পরে তার এই স্নাতক সনদ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য দাবি তোলে চট্টগ্রামের বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ট্রাস্ট। দাবি তোলে বেথুন কলেজও। এরপরই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রীতিলতার সেই স্নাতক পাসের সনদ ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৮ সালের ২৬ জুলাই, তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট হলে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কলকাতায় বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনের দুই কর্মকর্তার হাতে তুলে দেন বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের স্নাতক পাসের সনদসহ নম্বরপত্র।

স্বদেশি আন্দোলনের ক্ষেত্রে বীরকন্যা প্রীতিলতা ছিলেন প্রথম নারী বিপ্লবী সদস্য। প্রীতিলতা যখন বিপ্লবী দলের সদস্য হতে চেয়েছিলেন তখন মাস্টারদা সূর্যসেন ছিলেন পলাতক। প্রীতিলতার ভীষণ ইচ্ছা ছিল মাস্টারদার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার। প্রীতিলতার প্রবল আগ্রহে এবং বহু চেষ্টার পর ১৯৩২ সালের মে মাসে মাস্টারদার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের। পরে স্বদেশি আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক মাস্টারদা সূর্যসেন প্রীতিলতার দায়িত্ববোধ, সাহসিকতা ও চারিত্রিক দৃঢ়তায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে পাহাড়তলীতে অবস্থিত ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ অভিযানের নেতৃত্বদানকারী হিসেবে নিযুক্ত করেন।

সেই সময়কার কিছু কথা উল্লেখ করছি। তখন দলের প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয়েছে। অভিযান সফল করার লক্ষ্যে তাদের অস্ত্রচালনা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আট সদস্যের এই দলের দলপতি প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ছাড়াও বাকি সাতজন হলেন বিপ্লবী কালিকিঙ্ককর দে, শান্তি চক্রবর্তী, বীরেশ্বর রায়, প্রফুল্ল দাস, সুশীল দে, মহেন্দ্র চৌধুরী এবং পান্না সেন। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নেতৃত্বে এই অভিযান শুরু করা হয় ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, রাত ১০টায়। সেদিনের বিপ্লবীদের সেই অভিযান সফল হয়েছিল। নিয়মানুসারে, সামরিক কায়দায় আক্রমণের সময় নেতা থাকবে সবার আগে এবং ফেরার পথে সাথিদের নিরাপদে সরে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে নেতা ফিরবে সবার পরে। এই নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। অভিযান সফল হওয়ার পর হুইসেল বাজিয়ে সদস্যদের ফিরে যাওয়ার ইঙ্গিত দেন তিনি। পরে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন প্রীতিলতা নিজেও। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আত্মগোপনকারী এক ইংরেজ সৈনিকের গুলিতে বিদ্ধ হন তিনি। এরই মধ্যে দলের অন্য সদস্যরা নিরাপদ স্থানে পৌঁছে যেতে সক্ষম হয়েছেন। দলের সব সদস্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরই প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার তার সঙ্গে বহন করা ‘পটাশিয়াম সায়ানাইড’ পান করে আত্মাহুতির পথ বেছে নেন।

উল্লেখ্য, আগে থেকেই নির্দেশ দেওয়া ছিল যে, কোনোভাবেই বিল্পবী সদস্যদের শত্রুর হাতে জীবিত ধরা দেওয়া যাবে না। আহত অবস্থায় যাতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে জীবিত বন্দি করতে না পারে সেজন্য তিনি পূর্বনির্দেশের প্রতি অবিচল থেকে সায়ানাইড বিষপান করে আত্মাহুতি দেন। প্রীতিলতা প্রমাণ করেছেন মাস্টারদার সিদ্ধান্ত একদম সঠিক ছিল। প্রীতিলতা এই অভিযানের যোগ্য নেতৃত্বদানকারী ছিলেন। পরদিন ২৪ সেপ্টেম্বর ভোরে ব্রিটিশ পুলিশ প্রীতিলতার মৃতদেহ খুঁজে পায়। একজন নারীকে আক্রমণকারী হিসেবে শনাক্ত করে তারা হতভম্ব হয়ে পড়েছিল বলে জানা গেছে।

বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের আত্মাহুতির কথা মানুষকে মানসিকভাবে দৃঢ় করে। পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানলাম, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে প্রীতিলতার শেষ বিবৃতি (চিঠি) তার পকেটে ছিল। সেখানে তিনি লিখেছিলেন‘নারীরা আজ কঠোর সংকল্প নিয়েছে যে, আমার দেশের বোনেরা আজ নিজেকে দুর্বল মনে করবেন না। সশস্ত্র ভারতীয় নারী সহস্র বিপদ ও বাধাকে চূর্ণ করে এই বিদ্রোহ ও সশস্ত্র মুক্তি আন্দোলনে যোগদান করবেন এই আশা নিয়ে আমি আজ আত্মদানে অগ্রসর হলাম।’

যে দেশে এমন একজন বীরকন্যার জন্ম সে দেশের মেয়েরা আজও ঘরে নিরাপদ নয়, বাইরে নিরাপদ নয়। তারা নিজেদের নির্ভীক করে তৈরি করতে সক্ষম হয়নি। যারাও দু-একজন দৃঢ় মেয়ে আছেন তাদেরও সমাজ ভালোভাবে নেয় না। সময়ের পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি।

সমাজের ভালো পরিবর্তনের অপেক্ষায় থাকুক আগামীর দিন। লাল সালাম, বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close