মুফতি যাকারিয়া ইদরিস
শাবান মাসের শিক্ষা

রমজান মাসের মতো বরকতময় সময় আমাদের সামনে আসছে। রজব এবং শাবান মাস হলো রমজানের প্রস্তুতির সময়। এ মাসগুলোয় আমাদের উচিত নিজেদের আত্মশুদ্ধি করা, নফল ইবাদত বৃদ্ধি করা, রমজানের জন্য মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুত হওয়া। সাহাবি হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) রজব মাস এলে বলতেন, ‘হে আল্লাহ! রজব ও শাবান মাসকে আমাদের জন্য বরকতময় করুন এবং আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন।’ (মাজমাউয যাওয়ায়িদ)
এ দোয়া আমাদের শেখায়, রমজানকে শুধু একটি মাস হিসেবে নয়, বরং আধ্যাত্মিক উন্নতির একটি সোপান হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। আমাদের উচিত, রজব এবং শাবানের প্রতিটি মুহূর্তকে ইবাদত ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে রমজানের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
জরি বর্ষপঞ্জির অষ্টম মাসের নাম শাবান। মাসটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। মাসটির নামকরণের প্রতি লক্ষ করলেই এর গুরুত্বের বিষয়টি বোঝা যায়। ‘শাবান’ আরবি শব্দটির অর্থ ছড়িয়ে পড়া। বস্তুত শাবান মাসের আগের মাস অর্থাৎ রজব মাসে যুদ্ধবিগ্রহ নিষিদ্ধ বা হারাম হওয়ার কারণে আরবদের ওই সময়ে ঘরে বসে সময় কাটাতে হতো। আর শাবান মাসের পরের মাস রমজান ছিল প্রচণ্ড গরমের মৌসুম। বিধায় প্রকৃতির রুক্ষতার কারণে রমজানেও তারা ঘর থেকে বের হতে পারত না। মাঝখানের এই মাসটিই ছিল তাদের জন্য জীবিকা উপার্জনের মোক্ষম সময়। তাই তারা এই সময়ে জীবিকার সন্ধানে এই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ত।
সুতরাং মাসটির নামকরণ করা হয়েছে শাবান। জীবন ও জীবিকার জন্য আরবদের কাছে শাবান মাসটি যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, ধর্মীয় দিক দিয়ে মুসলিম সমাজের কাছে তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এর অতীব গুরুত্বের কারণেই রাসুলুল্লাহ (সা.) শাবানকে নিজের মাস বলে অভিহিত করেছেন। হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছে। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, রজব হলো আল্লাহর মাস। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহর মাস রজবকে সম্মান করল, সে আল্লাহর বিধানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করল। আর যে আল্লাহর বিধানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে, মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতুন নাঈমে প্রবেশ করাবেন। আর শাবান হলো আমার মাস। আর যে ব্যক্তি শাবান মাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করল সে আমার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করল। আর যে আমার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে, কিয়ামতের দিন আমি হব তার অগ্রবর্তী এবং নেকির ভা-র। আর রমজান মাস হলো আমার উম্মতের মাস। (শুআবুল ঈমান, হাদিস : ৩৫৩২)
শাবান মাসে যেসব করণীয় রয়েছে সেগুলো নিচে দেয়া হলো- (১) দিন গণনা : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা রমজানের (প্রস্তুতির উদ্দেশ্যে) শাবানের দিনগুলো গণনা করতে থাকো। (মুসান্নেফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭৩০৩, সুনানে তিরমিযি, হাদিস : ৬৭৮, আল-মুজামুল আওসাত, হাদিস : ৮২৪২)। (২) বেশি বেশি করে নফল রোজা রাখা : রাসুলুল্লাহ (সা.) শাবান মাসে অন্যান্য মাসের তুলনায় বেশি নফল রোজা রাখতেন। হজরত আয়েশা (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে রমজান মাস ছাড়া অন্য কোনো মাসে পুরো মাস রোজা রাখতে দেখিনি এবং আমি তাকে শাবান মাসের মতো এত অধিক নফল রোজা অন্য কোনো মাসে রাখতে দেখিনি। (সহিহ আল-বোখারি, হাদিস : ১৯৬৯, সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১১৫৬, সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ২৪৩৪, সুনানে তিরমিযি, হাদিস : ৭৩৬)। (৩) নামাজ, রোজা, জিকির, তিলাওয়াতসহ বেশি বেশি নফল ইবাদত করা। যেন মাহে রমজানের আমলের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সম্ভব হয় এবং গতিশীলতা হারিয়ে না যায়। (৪) স্বাস্থ্যের দিকে বিশেষ করে লক্ষ্য রাখা। যেন সুস্থ থেকে স্বাভাবিকভাবে গোটা মাহে রমজানের যাবতীয় আমল পালন করা যায়। (৫) শাবান মাসের ১৫ তারিখের পরে আর বেশি নফল রোজা না রাখা। হজরত কাতাদাহ (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, তোমরা রমজান মাস ও শাবান মাসের মাঝে এক বা দুই দিনের ব্যবধান বজায় রাখো (রোজা রাখা বর্জন করে)। (মুসান্নেফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭৩১৬)। (৬) নফল সাদাকাহ করা : শাবান মাসে বেশি বেশি দান-খায়রাত করা। যাতে সমাজের দরিদ্র শ্রেণির মুসলমানরা প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহ করে মাহে রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে। (৭) বেশি বেশি দোয়া করা : মহান আল্লাহর দরবারে রমজান মাসপ্রাপ্তির জন্য বেশি বেশি দোয়া করতে হবে। হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রজব মাস আরম্ভ হলেই রাসুলুল্লাহ (সা.) দোয়া করতেন, হে আল্লাহ। আমাদের রজব ও শাবান মাসে বরকত দান করো এবং রমজান মাস পর্যন্ত আমাদের পোঁছে দাও।
"