মাওলানা মানযার হাসিন
নিয়ত ভালো পুণ্যে আলো
ভালো নিয়তই পুণ্যময় জীবন লাভ হয়। ভালো নিয়ত ছাড়া মানুষ সফল হতে পারে না। জীবনের সফলতার জন্য, কামিয়াবির জন্য, অর্জনে-বর্জনে পরিচ্ছন্ন নিয়তের বিকল্প নেই। মানুষের সবই নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। প্রত্যেক কাজে নিয়ত বিশুদ্ধ হতে হবে। আল্লাহতায়ালা মানুষ ও জ্বিন সৃষ্টি করেছেন শুধু তার উপাসনার জন্য। আর নিয়ত হলো ইবাদতের মগজ। নিয়ত ছাড়া ইবাদত পরিপূর্ণতা পায় না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিয়ত ছাড়া কোনো আমল গৃহীত হয় না।’ (সুনানে কুবরা, ৬/৪১)
প্রত্যেক কাজের নিয়ত হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি। তা না হলে কোনো সওয়াব নেই। নামাজ পড়বেন? নিয়ত করুন আল্লাহর সন্তুষ্টি, দান-সদকা করবেন? নিয়ত করুন আল্লাহর সন্তুষ্টি। এভাবে প্রত্যেকটি ভালো কাজের নিয়ত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হলে সওয়াব হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টির পরিবর্তে লোক দেখানো হলে কিংবা দুনিয়াবি কোনো স্বার্থ সম্মানের জন্য হলে ওই ভালোকাজের তো সওয়াব নেই-ই, উপরন্তু কঠিন গুনাহ হবে। নবীজি বলেছেন, ‘আমি যে বিষয়টি তোমাদের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি ভয় পাই, তা হলো শিরকে আসগর তথা ছোট শিরক। সাহাবিরা প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! শিরকে আসগর কী? তিনি বলেন, রিয়া বা লোক দেখানো আমল। কেয়ামতের দিন যখন মানুষকে তাদের কর্মের প্রতিফল দেওয়া হবে, তখন মহান আল্লাহ তাদের বলবেন, তোমরা যাদের দেখাতে (দেখানোর জন্য আমল করতে) তাদের কাছে যাও, দেখো তাদের কাছে তোমাদের পুরস্কার পাও কি না!’ (আহমদ, আল-মুসনাদ ৫/৪২৮-৪২৯; হাইসামি, মাজমাউয যাওয়াইদ, ১/১০২। হাদিসের মান সহিহ)
নিয়ত কীভাবে করবেন? নিয়তের জন্য মুখে কোনো বাক্য উচ্চারণ করতে হয় না। নিয়ত অর্থ ইচ্ছা, স্পৃহা, মনের দৃঢ় সংকল্প। শরিয়তের পরিভাষায়, আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি লাভের জন্য কোনো কাজ বা আমলের দিকে মনোনিবেশ করাকে নিয়ত বলে। নিয়ত বিশুদ্ধ না হলে কোনো ভালো কাজেরও দাম আল্লাহর কাছে নেই। তাই আল্লাহতায়ালা বলেন, বলে দাও যেন প্রত্যেকেই নিজ নিজ নিয়ত অনুযায়ী কাজ করে। (বনি ইসরাইল, ৮৪)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘যে আখেরাতের ফসল কামনা করে, আমি তার জন্য তার ফসলে প্রবৃদ্ধি দান করি, আর যে দুনিয়ার ফসল কামনা করে, আমি তাকে তা থেকে কিছু দিই এবং আখেরাতে তার জন্য কোনো অংশই থাকবে না। (সুরা আশ শুরা, ২০)
মহান রাব্বুল আলামিন আরো বলেন, যে ব্যক্তি দুনিয়ার নিয়ত রাখবে, আমি তাকে ইহজগতে যতটুকু ইচ্ছা প্রদান করব। অতঃপর তার জন্য দোজখ নির্ধারণ করব। সে এতে দুর্দশাগ্রস্ত বিতাড়িত অবস্থায় প্রবেশ করবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আখেরাতের নিয়ত রাখবে এবং তার জন্য যেমন চেষ্টার প্রয়োজন তেমন চেষ্টাও করবে। যদি সে প্রকৃত মুমিন হয় এরূপ লোকদের চেষ্টা কবুল হবে। (সুরা বনি ইসরাইল, ১৮-১৯)
হাদিস শরিফে নিয়তের ব্যাপারে বিশদ আলোচনা রয়েছে। হজরত ওমর (রা.) বলেন, ‘আমি মহানবী (সা.)-কে বলতে শুনেছি, প্রত্যেক কাজের ফলাফল নিয়ত অনুসারে হয়। প্রত্যেক মানুষ তার কাজের ফলাফল আল্লাহর কাছে তদ্রুপ পাবে, যেরূপ সে নিয়ত করেছে। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসুলকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে হিজরত করবে, সে অবশ্যই আল্লাহ ও তার রাসুলের সন্তুষ্টি পাবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি পার্থিব ফায়দা হাসিল করার অথবা কোনো রমণীকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে হিজরত করবে, সে তার ফল তা-ই পাবে, যা সে নিয়ত করেছে।’ (বোখারি, ১)
নিয়ত এমন এক বিষয়, যার সঠিক ব্যবহারে অভ্যাসগত প্রত্যেক কাজকে ইবাদতে পরিণত করা যায়। যেমন- মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থীরা যদি তাদের অর্জিত জ্ঞান দ্বারা ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর সেবা করার নিয়ত করে, তাদের পড়াশোনা ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে। ঘুম মানবজাতির অবিচ্ছেদ্য কাজ। এতে মূলত কোনো সওয়াব নেই। কিন্তু তাহাজ্জুদের নিয়তে, ঘুমের দোয়া পড়ে ইবাদতের শক্তি বৃদ্ধির ইচ্ছায় ঘুমালে এই ঘুম ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়, আমলনামায় সওয়াব লেখা হবে। সন্তানকে ভালোবাসা যদি নবীজির অনুসরণের নিয়তে হয়, পানি পান যদি ইবাদতের স্পৃহা বাড়ানোর নিয়তে হয় সবই ইবাদতে পরিণত হবে। এভাবে কৃষক, শ্রমিক, মজুর, মৎস্যজীবী, নাপিত, কামার, কুমার, গৃহিণী সবাই যে যার কাজে বিশুদ্ধ নিয়ত করলে ইবাদতে রূপ নেবে এবং সওয়াব লাভ করবে। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সব আমল (এর ফলাফল) নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। প্রত্যেক ব্যক্তি যা নিয়ত করবে তাই পাবে।’ (সহিহ বুখারি, ১)
কোরআন ও হাদিসের আলোচনা থেকে বোঝা যায়, নিয়ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশুদ্ধ নিয়ত ছাড়া কোনো নেক আমলই আল্লাহতায়ালার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায় না। কিন্তু বিশুদ্ধ নিয়তের কারণে সবকিছুই পাওয়া হবে। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে প্রতিটি কাজে নিয়ত শুদ্ধ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
"