মুফতি এনায়েতুল্লাহ

  ২৯ নভেম্বর, ২০২৪

ইসলামে কর্মপ্রচেষ্টার তাগিদ

মুমিন ব্যক্তি সব সময় কর্মব্যস্ত থাকে। যে কাজ করে তার শক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে। জীবিকার কার্যকারণ হলো কাজ। অর্থাৎ কাজের সঙ্গে জীবিকার সম্পর্ক। তাই জীবিকা অর্জন করতে হলে সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করতে হবে। বিমর্ষতা এবং অলসতা পরকালকে ধ্বংস করে দেয়। জনৈক বুজুর্গ বলেছেন, ‘মানুষ যদি তার পেশায় ও কাজের ক্ষেত্রে আল্লাহর দেওয়া বিধান এবং মানবীয় মূল্যবোধগুলোর সীমারেখা ঠিকমতো মেনে চলে, তাহলে এটাও ইবাদত বলে গণ্য।’ এ ধরনের পেশাজীবী লোক আল্লাহতায়ালার প্রিয়ভাজনও বটে। কারণ, ‘আল্লাহতায়ালা পেশাজীবী লোক এবং আমানতদারিতার অভ্যাসকে ভালোবাসেন।’

ইসলামের দৃষ্টিতে কাজের গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলামের ইতিহাসের দিকে নজর দিলে দেখা যায়, দুনিয়ায় আগত নবী-রাসুলরাসহ আল্লাহর প্রিয় অলি-আওলিয়ারা কাজ করেছেন এবং কাজ করাকে ইবাদত মনে করেছেন। তবে কাজ করার ক্ষেত্রে আল্লাহর ওপর নির্ভর করার আলাদা একটি গুরুত্ব রয়েছে। কাজের ক্ষেত্রে আল্লাহর ওপর ভরসা করার মানে এই নয়, মানুষ তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যে আল্লাহর দেওয়া শক্তিমত্তা আর বস্তুগত সুযোগ-সুবিধাকে কাজে না লাগিয়ে বসে থাকবে। বরং এর অর্থ হলো, একজন মুমিন আল্লাহর ওপর পুরোপুরি ভরসা করবে এবং তার ওপর আস্থা ও ভরসাকে অন্য সবকিছুর ওপর অগ্রাধিকার দেবে। এ প্রসঙ্গে সুরা আল ইমরানের ১৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর কাজেকর্মে তাদের অর্থাৎ মুসলমানদের সঙ্গে পরামর্শ করুন। এরপর যখন কোনো কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন, তখন আল্লাহতায়ালার ওপর ভরসা করুন! কেননা আল্লাহ ভরসাকারীদের ভালোবাসেন।’

এ আয়াতে আল্লাহতায়ালা হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলছেন, পর্যালোচনার ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জমাদি প্রস্তুত করার পর আল্লাহর ওপর ভরসা করে কাজ বাস্তবায়ন করুন। মুফাসসিররা এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘ভরসার একটা জীবন্ত তাৎপর্য রয়েছে। তাহলো, কোরআন যখন চায় মানবজাতিকে কাজ করার ব্যাপারে বাধ্য করতে, তখন মানুষের মন থেকে ভয়-ভীতিগুলো দূর করার জন্যে আল্লাহর ওপর ভরসা করতে বলে। বলে, অগ্রসর হও! চেষ্টা করো।’

ভরসার প্রকৃত তাৎপর্য হচ্ছে পরিপূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস। তবে ভরসা কেবল আল্লাহর ওপর করতে হবে। এ অবস্থায় পার্থিব জগতের সব বস্তুর সহায়তাও গ্রহণ করা যেতে পারে। কেননা বস্তুজগতের সব উপায়-উপকরণ আল্লাহর অধীন। তেমনিভাবে ভরসাকারী ব্যক্তিরও জানা উচিত, বস্তুজগতের সব উপায়-উপকরণ আল্লাহর ইচ্ছায় নিয়ন্ত্রিত এবং সেসব মানুষের সেবায় নিয়োজিত। এমতাবস্থায় আল্লাহর ওপর ভরসা করার ফলে কাজকর্ম ছেড়ে অলস বেকার জীবনযাপন করার কোনো কারণ কিংবা সুযোগ নেই।

মানুষ প্রায়ই বিভিন্ন কাজ বাস্তবায়নের জন্যে কর্মসূচি প্রণয়ন করে। গৃহীত পরিকল্পনা ভালোভাবে পর্যালোচনা করে তা বাস্তবায়নে কাজ শুরু করে। তার পরও দেখা যায়, কোনো না কোনো কারণে তার নেওয়া সব পরিকল্পনা উলট পালট হয়ে গেছে। এর কারণ হলো, মানুষের জ্ঞান সীমিত, তাই সে সম্ভাব্য সমস্যা সম্পর্কে অবহিত নয়। তা ছাড়া মানুষ যখন কাজ করা বা কাজ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সে ঠিক জানে না কোনটাতে তার কল্যাণ নিহিত। ধর্মীয় দৃষ্টিতে মানুষ আশাবাদী বাস্তবতার সম্মুখীন হয়। ফলে সে এই চিন্তা করে যে, সৃষ্টিজগতের একজন পালনকর্তা রয়েছেন, তার জ্ঞান, শক্তি এবং কৌশল সীমাহীন। তিনি বান্দাদের সব কাজ আঞ্জাম দেওয়ার সামর্থ রাখেন এবং বান্দার প্রকৃত কল্যাণ সম্পর্কে জানেন। এরকম একজন পালনকর্তার ওপর ভরসা করে মানুষ মূলত সীমাহীন এক শক্তির সঙ্গে সম্পর্কসূত্র নির্মাণ করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে, সে তার কাজকর্মে আল্লাহর শক্তির দীপ্তি দেখতে পায়।

আরেকটি কথা, ভরসা মানে এমনটি ভাবা ঠিক নয় যে, মানুষ কেবল ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থেকে আল্লাহর কাছে নিজের চাওয়া-পাওয়া ও অভাব-অভিযোগের কথা বলেই ক্ষান্ত হবে, কাজকর্ম করবে না। হাদিসে এসেছে, একবার হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি দলকে দেখতে পেলেন, যারা কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে বেকার বসে আছে। নবীজি (সা.) তাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা তোমাদের জীবন-জীবিকা কীভাবে নির্বাহ করো? তারা বললো, আমরা আল্লাহর ওপর ভরসাকারী লোক। তাদের এই জবাব শুনে নবীজি (সা.) বললেন, ‘তোমরা আল্লাহর ওপর ভরসাকারী নও বরং সমাজের বোঝা।’

হিজরি দ্বিতীয় শতকে মুসলমানদের মাঝে যখন চিন্তা ও আদর্শগত বিচ্যুতি দেখা দিয়েছিল, তখন একদল বলত, ‘কাজকর্ম করাটা পার্থিব স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়, তাই তা ঈমান ও তাকওয়ার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’ অথচ ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, পৃথিবীর প্রতিটি বস্তু আল্লাহর নিয়ামত এবং সেগুলো মানুষের উপকারেই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন, তাদের জন্যে হালাল করেছেন। তবে শর্ত হলো, আল্লাহ প্রদর্শিত পন্থায় সেগুলোকে কাজে লাগাতে হবে এবং আল্লাহর পথে ব্যয় করতে হবে। তাহলে সেগুলো হবে নৈতিক এবং আত্মিক পূর্ণতার উপায়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close