মাসউদুল কাদির
জ্ঞানার্জনের লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি
পড়ো, তোমার প্রভুর নামে। যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। পবিত্র কোরআনের সুরা আলাকের শুরুর আয়াত। পড়া দিয়েই শুরু। মানবজাতিকে পড়ার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। স্কুল, মাদরাসা, মসজিদ, খানকা, পাঠাগার- এসবই নিজেকে আলোকিত করার পাঠশালা। কোরআনের ভাষ্যও তাই। মানুষ যদি পড়ে তাহলে নিজেকে চিনতে পারবে। নিজের দায়িত্ব বুঝে নিতে পারবে। এজন্য অন্ধকার দূর করার জন্য পড়ালেখা, নিরক্ষরতা দূর করা খুবই জরুরি।
আমরা জ্ঞানার্জন করব। কেন? উদ্দেশ্য কী? আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হবে আল্লাহর সন্তুষ্টির মাধ্যমে ইহ ও পরকালীন মুক্তি। অনন্ত জীবনের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্যই দুনিয়ায় আমরা এসেছি। আমাদের জীবনের প্রধান লক্ষ্য হবে পরকালকে রাঙানো। অনন্ত জীবনের সম্বল দুনিয়াতে সংগ্রহ করে পরকালে সফল হয়ে চিরসুখের জান্নাতের অধিবাসী হওয়া। জান্নাত লাভ করতে পারলেই আমরা সফল।
ইসলাম ও জেনারেল শিক্ষার স্কুল কেন প্রয়োজন? সমন্বয় জরুরি। সমন্বিত প্রয়াস ছাড়া একজন মুসলিম বাচ্চা পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান লাভ করতে পারে না। বাংলা, ইংরেজি ও গণিতের সঙ্গে কোরআন, আরবি ও ইসলামিয়াতের দোয়া-মাসাইল থাকলে একটা পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়। ইদানীং মাদরাসাগুলো সে কাজটা করছে। আরো ভালোভাবে করার তাগিদ আছে। তবে স্কুলের মিশনে সমন্বয় হলে সেটা হবে বিপ্লব। এর প্রয়োজনও এখন দেখা দিয়েছে। ইসলামি তারবিয়া বা প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যে স্কুল পরিচালিত হয়, এর চাহিদাও বাড়ছে। পশ্চিমা দেশগুলোতেও এ ধরনের সমন্বিত প্রয়াস প্রশংসা কুড়াচ্ছে।
ফিদায়ে মিল্লাত আসআদ মাদানী (রহ.) ব্রিটেন সফর করতে গিয়ে বলেছেন, ‘ভাইয়ো, মাদরাসা নয় তোমরা স্কুল প্রতিষ্ঠা করো। বদদীন থেকে নিজেদের সন্তানদের বাঁচাও।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শার্লট নর্থ ক্যারোলাইনার ইসলামিক একাডেমি প্রতিষ্ঠাতা ড. আজিম বেগ সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘বর্তমানে ইসলামিক স্কুল নির্মাণ মসজিদ নির্মাণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।’ (আওয়ার ইসলাম, ১৯ আগস্ট ২০১৮)। প্রশ্ন হতে পারে, আমরা কী কারণে ইসলামিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করব? কারণ, দেশে প্রচুর পাবলিক স্কুল রয়েছে। যৌক্তিক অনেক কারণ রয়েছে।
সত্যিকথা হলো, বর্তমানে ইসলামি স্কুল নির্মাণ মসজিদ নির্মাণের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। একটি মসজিদ ইবাদতের স্থান হিসেবে কাজ করে। আর দীনের মৌলিক জ্ঞান শেখানোর জন্য একটি ইসলামিক স্কুল খুবই দরকার। সামাজিক বিপ্লব তৈরি করে এই স্কুল। পাবলিক স্কুলে চাইলেই আপনি যথাযথভাবে বিশুদ্ধ উচ্চারণে কোরআন পড়াতে পারবেন না। একটি সমাজকে দীনের শিক্ষা দিতে ইসলামিক স্কুলের বিকল্প নেই। অনেক পরিবারের মানুষকে পূর্ণ সময়ের ইসলামিক স্কুল একটি পরিবেশ দান করে। যেখানে শিশুরা ইসলামিক সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠে। আদব-আখলাকে বেড়ে ওঠে। সালাম শিখে, বড়দের শ্রদ্ধা করা শিখে, ছোটদের স্নেহ করা শিখে। মা-বাবাকে শ্রদ্ধা করা শিখে। ইসলামিক স্কুলে পড়ুয়া একটি শিশু বা সন্তান তার ব্যবহার আচার-আচরণে সাধারণ শিশু বা সন্তান থেকে অনেক আলাদা হয়। তারা একটি দীনি পরিবেশে বেড়ে ওঠায় দীনের প্রতিটি পদক্ষেপে পারদর্শী হয়ে ওঠে। এটাই সমন্বিত প্রয়াসের সফলতা। এখানে বাড়তি কোনো কথা নেই। অতিরঞ্জিত কোনো বক্তব্য নেই। আপনি ভাবতে পারেন, অন্য স্কুলে এসব কি শেখায় না। হ্যাঁ, শেখায়। তবে পার্থক্য আছে অনেক। বিশেষ তারবিয়ার কারণেই ইসলামিক স্কুলগুলো বিশ্বজুড়ে অগ্রসর হয়ে যাচ্ছে।
ব্রিটিশ সরকারের স্ট্যান্ডার্ডস ইন এডুকেশন, চিলড্রেনস সার্ভিসেস অ্যান্ড স্কিল (অফস্টেড) বিভাগ ব্রিটেনে একটি ইসলামিক স্কুল পরিদর্শন করে বিবৃতি দিয়ে বলেছে, ‘আচরণ ও মনোভাবে’র দিক থেকে ‘ভালো’ ও ‘অসামান্য’ ইসলামিক স্কুলগুলো। ‘শিক্ষার্থীরা এসব স্কুলে অনেক উন্নতি লাভ করছে। তারা অনুকরণীয় নাগরিক হওয়ার চেষ্টায় স্কুলের মূল্যবোধ ধারণ করছে। এখানে শিক্ষার্থীদের সামাজিক কার্যক্রমের সক্রিয় সদস্য হতে এবং নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে উৎসাহিত করা হয়। এখানকার সবার মধ্যে অন্যদের সম্মান করার বিষয়টি খুবই গুরুত্ব দেওয়া হয়। আচরণ ও একাডেমিক কৃতিত্বের বিষয়ে পরিচালনা পর্ষদের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রত্যাশা থাকে। (কালেরকণ্ঠ, ১০ অক্টোবর ২০২৩)
কোরআনে যে ইকরার কথা বলা হয়েছে, সে ধারা থেকে মুসলমানরা পিছিয়ে পড়েছে। কোরআনের গবেষণা হচ্ছে না। অথচ আল্লাহর কোরআনের গবেষণা যত বেশি হবে, ততই মানুষের হৃদয়ের জানালা সম্প্রসারিত হবে। পবিত্র কোরআনে ‘ইকরা’ শব্দের মাধ্যমে পড়া ও পড়ানোর প্রতি আর ইলম (জ্ঞান) শব্দের দ্বারা লেখা ও লেখানোর প্রতি ইঙ্গিত পাওয়া যায়। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক। অর্থাৎ ‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।’
আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষকে আলোকিত করার প্রথম শব্দই ছিল ‘ইকরা’। ইকরা শব্দকে ধরেই মূলত জেনারেল ও ইসলাম শিক্ষার সমন্বিত প্রয়াসের স্কুলগুলো আলো ছড়াচ্ছে। ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সাউথ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা, ভারত ও পাকিস্তানে এ শিক্ষাধারার একটি নবযৌবন শুরু করতে সক্ষম হয়েছে। আশা করা যায়, এ ধারার শক্তি যদি পাবলিক স্কুলগুলোয় সম্প্রসারণ করা যায়, তাহলে শিক্ষাবিপ্লব শিগগিরই হবে।
ইসলামি স্কুলের কিছু সুবিধা-
ক. ইসলামি স্কুলগুলোয় প্রধানত বাংলা, ইংরেজি ও গণিতকে অন্য স্কুলগুলোর মতোই গুরুত্ব দিয়ে পাঠদান করা হয়। অনেকের ধারণা, শুধু আরবিতে জোর দেওয়া হয়। এটি সত্য নয়।
খ. জেনারেল ও ইসলাম শিক্ষার বিষয়ে একটি সুসমন্বয় থাকে। সমন্বিত প্রয়াসের কারণে শিক্ষার্থী অনেক যোগ্য হয়ে ওঠে। যোগ্য শিক্ষকমণ্ডলী ছাড়া কাউকে নিয়োগ দেওয়াও সম্ভব হয় না। বিশেষ বহুমাত্রিক, বহুভাষিক জ্ঞানের অধিকারী শিক্ষক সমন্বিত স্কুলগুলোয় প্রাধান্য পায়। দিন দিন আলেম ও জেনারেল শিক্ষার সমন্বিত শিক্ষকেরও কদর বাড়ছে।
গ. কোরআন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পাঠ। ফরজ বিধান। কোরআন তেলাওয়াত না জানলে সালাত বিশুদ্ধ করে আদায় করা যায় না। পাবলিক স্কুলগুলোয় কোরআন অধ্যয়ন একটি কঠিন বিষয়। অথচ ইসলামিক স্কুলগুলোয় অনায়াসে একটি বাচ্চা নিয়মতান্ত্রিক ক্লাসেই কোরআন পড়ে ফেলতে পারে। অভিভাবকের অগোচরেই কোরআনের পাখি হয়ে ওঠে নিজের সুসন্তান। এটা অনেক বড় একটি সংযোজন। মুসলিম বাচ্চার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ঘ. আরবি ভাষা শিক্ষাদান ছাড়া একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামিক স্কুল হয় না। কোরআনের ভাষা আরবি, নবীজি (সা.)-এর ভাষা আরবি, আল্লাহর ভাষা আরবি ও জান্নাতের ভাষা আরবি। তাই মোমিন মুসলমানের শিশুদের জন্য আরবি ভাষা শেখাটা অতীব জরুরি। এটা ইসলামিক স্কুলগুলোর সুখপাঠ্য।
ঙ. প্রয়োজনীয় মাসআলা-মাসাইল জানা জরুরি। মাসআলা না জানলে আমরা কীভাবে প্রকৃত মুসলমান হবো? ইসলামিক স্কুলগুলোয় দোয়া, দরূদ ও মাসআলা-মাসাইলসংক্রান্ত ইসলামিয়াত পড়ানো হয়।
চ. তারবিয়া বা প্রশিক্ষণ ছাড়া শিক্ষার্থী গড়ে উঠে না। ইসলামিক স্কুলগুলোয় এ প্রশিক্ষণ গুরুত্বের সঙ্গে দেওয়া হয়। বাচ্চার সঙ্গে আপনার দেখা হলেই, বাসায় বিদ্যুৎ চলে গেলে, খাবারের সময়, ঘুমুতে গেলে বা মসজিদে, টয়লেটে প্রবেশের সময় বুঝতে পারবেন- সে কোথায় পড়ে। শিশুর ভেতরে ইসলামিক স্কুলের একটা বড় প্রভাব পড়ে। কেবল পোশাকে নয়, মানসিকতায় আসে বড় পরিবর্তন।
ছ. আদর্শ বা নমুনা কী? নবীজী (সা.)-কে দেখে দেখে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) শিখেছেন। পর্যায়ক্রমে আমাদের কাছে পর্যন্ত এই দীন এসেছে। নিজেদের উস্তাদ যদি আদর্শিক হয়, ঈমানদার হয়, সুন্নাহভিত্তিক গঠনশৈলির হয়- তাহলে শিক্ষার্থীও সেভাবে গড়ে উঠবে। ডেডিকেডেট শিক্ষক ছাড়া ত্যাগী মানসিকতার শিক্ষার্থী কীভাবে গড়বে?
জ. ইসলামিক স্কুল কেবল শিক্ষার্থী গড়ে না, অভিভাবকদের মধ্যেও সাড়া ফেলে। নির্ধারিত নিয়ম মানতে গিয়ে দেখা যায়, অভিভাবকরা দীনের পথে, সত্যের পথে, কল্যাণের পথে ফিরে আসেন।
একটা সুন্দর ইসলামিক স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য আপনি স্বপ্ন দেখতে পারেন। এ স্বপ্নময় সিঁড়ি বেয়েই সামাজিক অগ্রগতির ভিত্তি নির্ভর করে। ভালো স্কুল ভালো মানুষ তৈরি করে। একটি স্বনির্ভর জাতি গঠনে সুশিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।
"