মুনীরুল ইসলাম
মহীয়সী নারীর গল্প
ইসলামের প্রথম প্রেরণা
উম্মত-জননী খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ (রা.)। একজন সেরা পুণ্যবতী নারী। জাহেলি যুগেও তিনি পূত-পবিত্র চরিত্রের জন্য ‘তাহিরা-পবিত্রবতী’ উপাধি পান। তিনি অত্যন্ত সম্মানিত ও সম্পদশালী ব্যবসায়ী নারী। তার ব্যবসার মালামাল সিরিয়ায় যায়। তার একার পণ্যসামগ্রীই কুরাইশদের সবার পণ্যের সমান। অংশীদারি বা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে যোগ্য লোক নিয়োগ করে তিনি দেশ-বিদেশে পণ্য বেচাকেনা করেন। তার ব্যবসার মালামাল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন স্থানে বহন করার জন্য নিজস্ব সত্তর হাজার উট আছে। তার বিশাল একটি গুদাম ঘর আছে, সেখানে আছে সবুজ রেশমি কাপড়ের তৈরি সাইন বোর্ড ঝোলানো। সে ঘরটি বিভিন্ন ধরনের পণ্যসামগ্রীতে ভরপুর। তার আছে অনেক দাস-দাসী বা কর্মচারী, তারা তার ব্যবসার মালামাল বিভিন্ন দেশে আমদানি-রপ্তানি করেন। এর দ্বারা লাভবান হন অন্যরাও।
হজরত মুহাম্মদ (সা.) তখন পঁচিশ বছরের যুবক। এর মধ্যে চাচা আবু তালিবের সঙ্গে বা একাকী কয়েকটি বাণিজ্য সফরে গিয়ে ব্যবসা সম্পর্কে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলেছেন। ব্যবসায় তার সততা ও আমানতদারির কথা মক্কার মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। সবার কাছে তিনি তখন বিশ্বস্ত আল-আমিন। তার সুনামের কথা খাদিজার কানেও পৌঁছে। তিনি ব্যবসার জন্য সিরিয়ায় পণ্য পাঠানোর চিন্তা করলেন। যোগ্য লোকের সন্ধান করছিলেন তিনি। খাদিজা আর দেরি করলেন না। লোক মারফত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে প্রস্তাব পাঠালেন- তিনি যদি ব্যবসার দায়িত্ব নিয়ে সিরিয়া যান, অন্যদের তুলনায় খাদিজা তাকে দ্বিগুণ মুনাফা দেবেন।
মুহাম্মদ (সা.) রাজি হলেন। খাদিজার পণ্যসামগ্রী নিয়ে তার বিশ্বস্ত গোলাম মাইসারাকে নিয়ে তিনি চললেন সিরিয়ায়। পথে এক গির্জার পাশে একটি গাছের ছায়ায় গিয়ে বসলেন তিনি। গির্জার পাদরি অবাক হয়ে এগিয়ে এলেন মাইসারার দিকে। জানতে চাইলেন, গাছের নিচে বিশ্রামরত লোকটি কে?
মাইসারা বললেন, মক্কার হারামবাসী কুরাইশ গোত্রের একজন লোক।
পাদরি বললেন, গাছের নিচে যিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন তিনি একজন নবী ছাড়া আর কেউ নন।
এই পাদরির নাম ছিল বুহাইরা বা নাসতুরা।
মুহাম্মদ (সা.) সিরিয়ার বাজারে পণ্যদ্রব্য বিক্রি করলেন এবং যা কেনার তা কিনে নিলেন। তারপর মাইসারাকে নিয়ে মক্কার দিকে রওনা হলেন। পথে মাইসারা খেয়াল করলেন, মুহাম্মদ উটের ওপর সওয়ার হয়ে চলেছেন, আর দুজন ফেরেশতা দুপুরের প্রখর রোদে তার ওপর ছায়া বিস্তার করে রেখেছেন।
মুহাম্মদ (সা.) মক্কায় ফিরে খাদিজার পণ্যসামগ্রী বিক্রি করলেন। ব্যবসায় এবার দ্বিগুণ মুনাফা হলো। বাড়ি ফিরে মাইসারা খাদিজার কাছে পাদরির মন্তব্য এবং সফরের অলৌকিক ঘটনাবলি বলতে ভুললেন না।
খাদিজা অনেক বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমতী নারী। তার বুদ্ধিমত্তা ও ভদ্রতায় মক্কার সর্বস্তরের মানুষ মুগ্ধ। অনেক অভিজাত কুরাইশ যুবকই তাকে স্ত্রী হিসেবে পাওয়ার আশায় বুক বাঁধে। তিনি তাদের সবাইকে প্রত্যাখ্যান করেন। মাইসারার মুখে সবকিছু শুনে খাদিজা মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে বিয়ের পয়গাম পাঠান। খাদিজার বান্ধবী নাফিসা বিনতে মানিয়া এ ব্যাপারে পুরো উদ্যোগ নেন।
বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে গেল। নির্ধারিত তারিখে মুহাম্মদ (সা.)-এর চাচা আবু তালিব, হামজাসহ তার বংশের আরো কিছু লোক খাদিজার বাড়িতে উপস্থিত হলেন। খাদিজাও তার বংশের ব্যক্তিদের দাওয়াত দিলেন। সবার উপস্থিতিতে আবু তালিব বিয়ের খুতবা পাঠ করলেন। সাহিত্যিক উৎকর্ষের দিক দিয়ে এ খুতবা জাহেলি যুগের আরবি গদ্য সাহিত্যে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বিয়েতে পাঁচ শ স্বর্ণমুদ্রা মোহর ধার্য হয়। খাদিজা নিজেই দুপক্ষের সব খরচ বহন করেন। তিনি দুই উকিয়া সোনা ও রুপা মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে পাঠান এবং তা দিয়ে উভয়ের পোশাক ও ওলিমার (বউভাত) আয়োজন করতে বলেন। মুহাম্মদ (সা.) তখন খাদিজার নিবিড় ভালোবাসা উপলব্ধি করছিলেন। তিনি হৃদয়ে অনুভব করলেন, আসমান থেকে শব্দ এলো, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ পবিত্র নারীকে পবিত্র ও সত্যবাদী স্বামী দান করে থাকেন।’ তখন তাদের চোখের সামনে থেকে পর্দা সরে যায়। তারা বিয়ের অনুষ্ঠানে বেহেশতি হুর দেখতে পায়। চারদিকে বেহেশতি আতরের সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে। সবাই বলাবলি করতে থাকে, ‘এত মনোমুগ্ধকর সুগন্ধ তাদের সততা থেকেই উৎসারিত হচ্ছে’।
হজরত খাদিজা হয়ে গেলেন আগামীর ‘উম্মুল মুমিনীন- মুমিনদের জননী’। এটা মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়তপ্রাপ্তির ১৫ বছর আগের ঘটনা। তখন মুহাম্মদের বয়স ছিল পঁচিশ এবং খাদিজার চল্লিশ। এই বিয়ের আগে খাদিজা এক আশ্চর্যজনক স্বপ্ন দেখেছিলেন। স্বপ্নের কথা তার চাচাতো ভাই ওরাকা ইবনে নওফেলকে জানান। জাহেলি যুগে তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। হিব্রু ভাষায় ইনজিল কিতাবে লেখেন। স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানেন। তিনি বৃদ্ধ ও দৃষ্টিহীন। খাদিজা বলেন, আসমান থেকে আমার কোলে একটি চাঁদ নেমে এলো এবং সেটা আবার সাত ভাগে ভাগ হয়ে গেল।
ওরাকা স্বপ্নের ব্যাখ্যায় বললেন, শেষ যুগে একজন রাসুল দুনিয়ায় তাশরিফ আনবেন, তার সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে। আর সেই বিয়ের ফলে তোমাদের থেকে সাতটি সন্তান জন্ম নেবে।
বিয়ের পর কুরাইশ বংশের একদল দোষ অন্বেষণকারী মূর্খ নারী খাদিজা সম্পর্কে অভিযোগ ও উপহাস করতে লাগল। খাদিজার মতো একজন প্রসিদ্ধ ও উচ্চমর্যাদার অধিকারী বিত্তশালী নারীর এটা শোভনীয় নয় যে, একজন এতিম, রিক্তহস্ত, দরিদ্র ব্যক্তিকে বিয়ে করবে। এটা কি মন্দ একটা বিষয় নয়?...
তাদের নোংরা মন্তব্য হজরত খাদিজার কানে চলে গেল। তিনি দাস-দাসীদের সুস্বাদু খাবার তৈরির নির্দেশ দিলেন, আর ওই নারীদের দাওয়াত করলেন। খাদিজার দাওয়াতে তারা না এসে পারল না। সবাই যখন খাবার গ্রহণে ব্যস্ত, তখন খাদিজা তাদের উদ্দেশে বললেন, নারীরা! তোমরা নাকি মুহাম্মদকে বিয়ে করার বিষয়টি নিয়ে আমাকে উপহাস করছো? আমি তোমাদের কাছে জানতে চাই, মুহাম্মদের মতো এমন ভালো বৈশিষ্ট্যের অধিকারী দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি কি তোমাদের জানাশোনায় আছে? মক্কা ও মদিনার আশপাশে এমন ব্যক্তিত্ববান কেউ কি আছে, যিনি চরিত্র ও মর্যাদার দিক থেকে মুহাম্মদের মতো এত সুন্দর ও পরিপূর্ণতার অধিকারী? আমি তার এই পূর্ণতার কারণেই তাকে বিয়ে করেছি। আর এমন কিছু তার সম্পর্কে শুনেছি ও দেখেছি, যা অনেক উঁচু মর্যাদার অধিকারী ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব। সুতরাং কারো সম্পর্কে যা খুশি তাই বলা এবং না জেনে অশোভনীয় মন্তব্য করা উচিত নয়...।
হজরত খাদিজার এমন হৃদয়গ্রাহী কথা শুনে উপস্থিত নারীরা নির্বাক হয়ে গেল। এ সম্পর্কে তাদের বলার মতো কোনো ভাষা রইল না। খাদিজা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তাদের কৃতকর্মের জবাব দিয়ে দিলেন।
"