সিদ্দিকুর রহমান
সামাজিক অবক্ষয়রোধে ইসলাম
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে একের পর এক ঘটে যাওয়া বীভৎস, নির্মম, পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড, নারী-শিশু ধর্ষণ ও হত্যা, মা-মেয়ে ধর্ষণ, গণ-ধর্ষণ (গ্যাং রেপ), পরকীয়ার জেরে স্বামী, স্ত্রী, সন্তান হত্যা, সন্তান কর্তৃক বাবা-মা হত্যা, স্বামী কর্তৃক স্ত্রী হত্যা ও স্ত্রী কর্তৃক স্বামী হত্যার ঘটনা, পারিবারিক সহিংসতা, অহরহ যৌন নির্যাতন আর দেশব্যাপী ক্রমবর্ধমান আত্মহত্যার ঘটনা দেশের সুশীলসমাজকে ভাবিয়ে তুলেছে। এসব ঘটনা সৃষ্টি করছে এক ধরনের সামাজিক অস্থিরতা। এ অস্থিরতার মাত্রা এখন ক্রমেই ছড়িয়ে যাচ্ছে। গত সপ্তাহে রাজধানীর কাকরাইলে দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হন মা-ছেলে। বলা হচ্ছে, এর পেছনে রয়েছে সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ। বাড্ডায় খুন হন বাবা-মেয়ে। পুলিশ বলছে, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে পরকীয়া। গত ২৭ অক্টোবর মোবাইল ফোন চুরির অপবাদে নরসিংদীতে খুন হয় আজিজা নামে এক কিশোরী। সম্প্রতি ময়মনসিংহের শ্রীরামপুরে সাগর নামে এক কিশোরকে মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগে গাছে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। বরগুনার আমতলীতে কলেজছাত্রী মালা আক্তারকে সাত টুকরো করে হত্যা করা হয়। গত সপ্তাহে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগে চার বছরের শিশু পিয়াসকে বস্তাবন্দি করে নির্যাতন করা হয়। এটি অতি সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া সহিংস, নৃশংস ও অমানবিক ঘটনার খণ্ডচিত্র মাত্র। এ ছাড়া এ সময়ে দেশে ঘটেছে আরো অনেক শিশু ধর্ষণ, নারী ধর্ষণসহ মর্মন্তুদ অনেক আত্মহননের ঘটনা, যা প্রতিদিনই ঘটছে। কুমিল্লায় তনু হত্যা ও টাঙ্গাইলে বাস কর্মচারীদের লালসার বলি রূপাসহ সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা অনেক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা, ক্রমবর্ধমান সহিংস যৌন নির্যাতনসহ বিভিন্ন পৈশাচিক নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনা এখন আর সামাজিক অবক্ষয়ের কথাই জানান দিচ্ছে না, জানান দিচ্ছে সমাজে মানবিক মূল্যবোধ নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপক্রমেরও কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্রটি থেকে বলা হয়েছে, সমাজের অস্থিরতা, সহিংসতার বিরূপ প্রভাব পড়েছে পরিবারেও। এখন দেশে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাচ্ছে। নিকট প্রতিবেশীর সঙ্গেও কেউ তেমন যোগাযোগ রাখেন না। প্রতিযোগিতামূলক সমাজ, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের কারণে সহিংসতার স্বরূপ বদলাচ্ছে। সহজ-সরল বৃত্ত থেকে এখন সবকিছুই জটিল হয়ে উঠেছে। মানুষের জীবন হয়ে পড়েছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক, যেখানে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য প্রাধান্য পাচ্ছে। জীবন হয়ে পড়েছে প্রযুক্তিনির্ভর। এখন পরিবারে মায়া-মমতার বন্ধনও ক্রমেই শিথিল হয়ে যাচ্ছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশে আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়ছে। আত্মহত্যায় বর্তমানে বিশ্বে বাংলাদেশ দশম অবস্থানে, যা ২০১১ সালে ছিল ৩৮তম অবস্থানে। গত ছয় বছরে দেশে ৬০ হাজার আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী আত্মহত্যার কারণ মনোবৈকল্য, বেকারত্ব, পারিবারিক ও মানসিক অশান্তি, দারিদ্র্য, নিঃসঙ্গতা, ক্ষোভ, অভিমান, যৌন হয়রানি, জীবন-গ্লানি, প্রেমে ব্যর্থতা, মাদকাশক্তি, যৌতুক, বিষণ্ণতা, বাঁচার আগ্রহ হারিয়ে ফেলা। ২০১৪ সালে দেশে আত্মহত্যার ঘটনা ছিল ১২ হাজার, ১৯১৫ সালে ছিল ১৪ হাজার, ২০১৬ সালে ছিল ১৬ হাজারের বেশি। ২০১৭ সালের এ সময়ের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা ১৬ হাজার ছাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নেত্রী ও সমাজসেবী শ্যামলী বড়ুয়া বলেন, সমাজে মনোবিকৃতি ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। ঘরে ঘরে অশান্তি, পারিবারিক কলহ ভয়ানকভাবে বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে পরকীয়া, বিয়েবহির্ভূত দৈহিক সম্পর্কের ঘটনাও। পারিবারিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক, ধৈর্য, সহনশীলতা কমে গেছে। তুচ্ছ ঘটনায় বিয়েবিচ্ছেদের মতো ঘটনার সৃষ্টি হচ্ছে। আগে পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত ছিল উচ্চবিত্তের তরুণ-তরুণীরা। তারা বয়ফ্রেন্ড-গালফ্রেন্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সময় কাটাতে ভ্রমণে যেত। ক্লাবে যেত। এখন নিম্নবিত্ত গরিব শ্রমজীবী মানুষের ঘরে ঘরেও সবার হাতে মোবাইল চলে যাওয়ায় কিশোর-তরুণসহ বয়স্ক নারী-পুরুষদের হাতের নাগালেও এসেছে পর্নোগ্রাফি। এতে ধস নেমেছে তাদের নৈতিক চরিত্রে। বেহায়াপনা, পরকীয়ায় লিপ্ত হচ্ছে তারাও। অথচ ২০ বছর আগেও আমাদের দেশের শ্রমজীবী-গরিব-মেহনতি মানুষ ছিল খুব সহজ-সরল।
সামিনা আক্তার নামে একজন এনজিও কর্মী বলেন, আগে মুখোমুখি হতে হতো ইভটিজিংয়ের। এখন মুখোমুখি হতে হচ্ছে নতুন বিকৃত মানসিকতার। বাস, মার্কেট বা অন্য কোনো স্থানে ভিড়ের মধ্যে মেয়েদের স্পর্শকাতর স্থানে হাত দেওয়া হচ্ছে। আর বাসে পেছন থেকে মেয়েদের সালোয়ার-কামিজ কেটে দিয়ে বিকৃত মানসিকতা চরিতার্থ করছে কুরুচির মানুষ। তিনি বলেন, বাস থেকে নেমে ভিকটিম মেয়েটি বুঝতে পারে তার সালোয়ার-কামিজ বিভিন্ন স্থানে কাটা। ওই অবস্থায় তাকে অফিসে গিয়ে খুবই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়।
পারিবারিক অশান্তি, দাম্পত্য কলহ, সন্তানদের অবাধ্যতা, বিপথে চলে যাওয়া, মাদকাসক্তিসহ সামাজিক নানা অনাচার থেকে মুক্তি পেতে অনেক অভিভাবক দোয়া চাইতে আসেন। যারা আসেন তারা খুবই অশান্তি ও যন্ত্রণার মধ্যে রয়েছেন, যা অন্যদের কাছে বলতেও পারছেন না। বোঝা যাচ্ছে, সমাজ ঘুণে ধরেছে। এ ঘুণে ধরা সমাজে ভ্রষ্টাচার ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। ভোগবাদিতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, চরম স্বার্থপরতায় বেশির ভাগ মানুষ নিমগ্ন। অশ্লীলতা এখন বিকৃত সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। আচার-আচরণ, চলাফেরা, পোশাকপরিচ্ছদে শালীনতা, মার্জিতরূপ ক্রমেই উঠে যাচ্ছে। অবৈধভাবে, অনৈতিকভাবে যে যেমন পারছে ধন-সম্পদ অর্জনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। অনিয়ম, ঘুষ, দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে বাসা বেঁধেছে। অথচ আমাদের দেশ, সমাজ এমন হওয়ার কথা ছিল না। এ অবস্থা থেকে আমাদের উত্তরণ ঘটানোর জন্য কোরআন-সুন্নাহর পথে আসতে হবে। ঘরে ঘরে কোরআনের আলো জ্বালতে হবে। সন্তানদের কোরআন শিক্ষা দিতে হবে। ঘরে ঘরে নামাজ কায়েম করতে হবে। আল্লাহভীতি, মৃত্যুভীতি, আখিরাতভীতি সবার হৃদয়-মনে জাগিয়ে তুলতে হবে। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বিদায় হজে বলেছেন, তোমরা কোরআন-সুন্নাহ আঁকড়ে থাকলে বিপথগামী হবে না। পরিবারে রহমত, কল্যাণ, শান্তি আল্লাহতায়ালা প্রদত্ত। এখন আমাদের উচিত, বেশি করে তওবা করে আল্লাহপাকের করুণা ও রহমত ভিক্ষা করা।
"