মাওলানা মানজুম উমায়ের
ইসলামের দৃষ্টিতে চরিত্রমাধুরিমা ও নেতৃত্ব
নেতৃত্বের জন্য নিজের চরিত্রমাধুরিমা হবে অতিসুন্দর। সচ্চরিত্রবান মানুষই পারেন নেতৃত্বদানে নিজেকে মেলে ধরতে। জীবনের প্রতিটি লিডারশিপ পর্যায়-ই মানুষকে সাধারণত সুন্দর করে তোলে। কোনো পাত্র যদি আগে থেকে বস্তুর ধারণের জন্য উপযোগী না হয়, তাহলে তো তা পাত্রে রাখা যাবে না। উপযোগিতা সবার আগে জরুরি। যিনি নেতৃত্ব দেবেন, পরিচালনা করবেন, যিনি সমাজকে সামনের দিকে এগিয়ে নেবেন- তাকে সচ্চরিত্রবান হতেই হবে। যিনি নিজের ভেতরে সুপ্ত প্রতিভাকে নেতৃত্বদানে কাজে লাগাতে চান, আগ্রহী হন- তার চরিত্রগত দিক থেকে উন্নত ও সহনশীল শান্ত সুন্দর মানুষ হতে হবে। তাহলেই বিজয়ী হওয়া সম্ভব। সাফল্য লাভ করাও সম্ভব। আল্লাহতায়ালা কোরআনুম মাজিদে বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কুড়িজন সহনশীল থাকলে তারা ২০০ জনের ওপর বিজয়ী হবে এবং তোমাদের মধ্যে ১০০ থাকলে এক সহস্র কাফেরের ওপর বিজয়ী হবে। কারণ তারা এমন এক সম্প্রদায়, যার বোধশক্তি নেই।’ (সুরা আনফাল : আয়াত ৬৫)
আমরা এই বাঙালি সমাজে দেখতে পাই, সমাজের ভালো মানুষটি হলেন ধৈর্যশীল, সহনশীল। সহনশীলতার চাদরে ঢেকে রাখে পুরো সমাজ। মানুষ চেষ্টা করলেই নিজেকে বদলাতে পারে। নিজের নেতৃত্বগুণের পরিধি আরো সুন্দর মজবুত করে নিতে পারে। তাই মানুষ নিজের মনোভাব পরিবর্তন করে এই অঙ্গীকার করবে, ‘আমি বিজয়ী বা সফল হতে চাই’। তাহলেই কাঙ্ক্ষিত ভূষণে নিজেকে সুসজ্জিত করতে সমর্থ হবে। হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উইলিয়াম জেমস বলেন, ‘আমাদের প্রজন্মের সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার হলো যে, মানুষ মনোভাবের পরিবর্তন ঘটিয়ে তার জীবনযাত্রার পরিবর্তন ঘটাতে পারে।’
একজন তরুণ পড়াশোনায় অনেক ভালো, কিন্তু মিথ্যায় অভ্যস্ত। তাকে কেউই গ্রহণ করতে চায় না। আচরণে ত্রুটিপূর্ণ হলে কেউ তাকে দেখতে পারে না। তাই সদাচার নিজের মাঝে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ইসলামের বিধিবিধান সম্পর্কে দুর্বলতা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। সামান্য ত্রুটি নিজের জীবনের ওজন কমিয়ে দেবে। চলার পথকে করে দেবে রুক্ষ। অনেক তরুণকে দেখা যায়, কথা দিয়ে কথা রাখতে পারেন না। হাদিসে এটিকে মুনাফিকের আলামত বলা হয়েছে। ইজা ওয়াদা আখলাফা- অঙ্গীকার ভঙ্গ করা মুনাফিকের আলামত। কোনো হাদিসে তিনটি আবার কোনো হাদিসে চারটি আলামতের কথা বলা হয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এই আলামাত বা নিদর্শন যার মধ্যে দেখা যায়, তাকে সমাজ বা উঠতি বয়সি তরুণরা গ্রহণ করতে চায় না। তাকে এড়িয়ে যেতেই পছন্দ করে। দোষী, দাগি বা কোনো অপরাধীকে কেউ পছন্দ করে না।
সচ্চরিত্র সম্পর্কে মহান আল্লাহতায়ালা রাসুল (সা.)-কে সম্বোধন করে বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি সর্বোত্তম চরিত্রে অধিষ্ঠিত।’ (সুরা আল কলাম : আয়াত ৪) আদর্শবান মানুষের পরিচয় দিতে গিয়ে মহান আল্লাহতায়ালা এভাবে বলেন, ‘যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় ব্যয় করে এবং যারা ক্রোধ সংবরণকারী এবং মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল; আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের ভালোবাসেন।’ (সুরা আল ইমরান : আয়াত : ১৩৪)
কথায় কথায় রাগ করেন না, অন্যের প্রতি ক্ষমাশীল যারা হন তারাই নেতৃত্বের সুফল লাভ করতে পারেন। আজকের সমাজে যারা ছোট কোনো প্রতিষ্ঠান চালান, তারা রাগের তোড়েই নিজের খেই হারিয়ে ফেলেন। সামলাতে না পেরে প্রতিষ্ঠানই বন্ধ করে দেন। পরে মাথা হাতড়াতে থাকেন। ক্রোধ সংবরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সচ্চরিত্রবান অযথাই ক্রোধান্বিত হবেন না।
নবীজি (সা.) নিজের সম্পর্কে ঘোষণা করেছেন, ‘আমি উত্তম চরিত্রের বিধানকল্পেই প্রেরিত হয়েছি।’ (বোখারি)। আল্লাহর নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, নিশ্চয়ই মুমিন তার উত্তম চরিত্রের দ্বারা রাত্রি জাগরণকারী ও দিনের বেলায় সিয়াম পালনকারীর মর্যাদা লাভ করবে। (আবু দাউদ, মিশকাত হাদিস ৫০৮২) বোখারি ও মুসলিম শরিফে আছে, হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.) ছিলেন, মানবজাতির মধ্যে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। (বোখারি ও মুসলিম)
একটি হাদিসে নবীজি (সা.) সচ্চরিত্রকেই নেকি বলে অভিহিত করেছেন। হজরত নওয়াস ইবন সামআন (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবীজি (সা.)-কে নেকি ও গুনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, নেকি হচ্ছে উত্তম চরিত্র। আর গুনাহ হচ্ছে, যা তোমার অন্তরে সন্দেহের উদ্রেক করে এবং অন্যে জেনে ফেলুক, এটা তোমার কাছে খারাপ লাগে।’ (মুসলিম শরিফ)
বাস্তব অর্থে আদর্শের সবটুকু নমুনা ছিলেন রহমাতুললিল আলামিন হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি প্রকৃতিগতভাবেই অশ্লীলতা পছন্দ করতেন না এবং তিনি অশ্লীলভাষীও ছিলেন না। হজরত আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবন আস (রা.) এ রকমই একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রাসুল (সা.) এ সম্পর্কে বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সর্বোত্তম, যার চরিত্র সবচেয়ে ভালো।’ (বোখারি ও মুসলিম, মিশকাত শরিফ, হাদিস ৪৮৫৪)
আচরণে, আদর্শে, ব্যবহারে নিজেকে অনিন্দ্য সুন্দরমাধুরিমায় রূপান্তরিত করাই নেতৃত্বের গুণ অর্জনকারীর প্রধান সোপান। যিনি নেতৃত্ব দেবেন তাকে সবাই মানার মতো করেই দেখতে চায়। কোনো দুর্নীতিবাজের কথা কেউ শুনতে চায় না। কমান্ড মানতে চায় না। নেতৃত্বে কাজ করতে চায় না। সুতরাং যিনি নেতৃত্ব দেবেন, তাকে দুর্নীতিবাজ হলে চলবে না। অন্যায় অপকর্মে লিপ্ত কারো নির্দেশ মানতে কেউ বাধ্য নয়। সত্য ও সুন্দর গ্রহণকারীকেই মানুষ মানে, গ্রহণ করে। আদর্শ হিসেবে মেনে নেয়।
ডেল কার্নেগি ‘বিক্রয় ও জনসংযোগ ও বক্তা হবেন কীভাবে’ বইটিতে বক্তব্যকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পিয়ের মর্গ্যানের বক্তব্য তুলে ধরেছেন, তিনি বলেন- প্রশংসা আদায় করার শ্রেষ্ঠ উপায় হলো চরিত্র। আর শ্রোতাদের বিশ্বাস অর্জন করার ক্ষেত্রেও তার কার্যকর হয়। আলেকজান্ডার উলকট বলেছেন, ‘কোনো মানুষ যখন আন্তরিকভাবে কথা বলেন, তখন তার কথায় যে রং ফোটে, তা কোনো জাদুকরও দেখাতে পারে না।’
আদর্শ-আইডল-কাদওয়া-কায়েদ সেই, যাকে মন থেকে গ্রহণ করা যায়, মানা যায়। যার কথা মোলায়েম। সচ্চরিত্রবান ও কালিমামুক্ত। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ এখনো সচ্চরিত্রবান সুন্দর মানুষের পথ চেয়ে আছে। নেতৃত্বে আসছে না সততার সুন্দরম কোনো গতিপথ। পিচ্ছিল এই পথকে মানুষের সর্বতো উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই যারা নেতৃত্ব দেন, তাদের নড়েচড়ে বসা দরকার। শূন্যতা পূরণে সমাজের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে মানুষ গঠনের প্রক্রিয়ায় আরো অগ্রসর ভূমিকা রাখা অতীব জরুরি।
সমাজ রাঙাতে চাইলে সবার আগে নিজেকে রাঙাতে হয়। নিজেকে গড়তে হয়। নিজেকে গড়তে পারলে সমাজ আলোকিত হয়। সমাজের কাছে ওই ব্যক্তি গ্রহণীয় হয়ে ওঠে। এ জন্য সমাজ গঠনের জন্যই নিজেকে নিয়ে ভাবা উচিত। আল্লাহতায়ালা আমাদের কবুল করুন। আমিন।
"