হাফিজ উদ্দীন আহমদ
ডেঙ্গু : আতঙ্ক নয় থাকতে হবে সতর্ক
এই সময়ে ডেঙ্গু রোগের আতঙ্কে সবাই দিন কাটাচ্ছি। আসলে ডেঙ্গু বলে কোনো রোগ নেই। এর প্রকৃত নাম ডেঙ্গি, ভাইরাসজনিত রোগ। ভাইরাস হলো আমিষ খোলসে আবৃত এক রকম সূক্ষ্ম জড় বস্তু, যা দেখতে ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ দরকার হয়। শরীরের কোনো জীবন্ত কোষে ঢুকতে পারলে তা জীবিত হয়ে বংশ বিস্তার করে। এদের কিছু হলো আরএনএআর, কিছু ডিএনএ ভাইরাস। ডেঙ্গি ঘটায় ফ্লেভিভাইরাস। এটা আরএনএ ভাইরাস।
আরএনএ কোষ কেন্দ্রকে মানে নিউক্লিয়াসে থাকে, কিছু আবার তার বাইরে রাইবোজোমে থাকে। এই ভাইরাস ডেঙ্গি ছাড়াও চিকুনগুনিয়া, ইয়েলো ফিভার ও জিকা রোগ সৃষ্টি করে। ৬০ রকমের ফ্লেভিভাইরাস আছে। ডেঙ্গি সৃষ্টি করে ডেন-১, ২, ৩ এবং ৪ প্রজাতি। এটা মশাবাহিত রোগ। পৃথিবীতে ৩৫০০ রকম মশা বাস করে। তবে এ রোগ সৃষ্টি করে এডিস ইজিপ্টি এবং এডিস অ্যালবোপিকটাস তবে মুখ্যত এডিস ইজিপ্টি দায়ী।
ডেঙ্গি রোগের অস্তিত্ব প্রথম ধরা পড়ে ১৬৩৫ সালে। ১৭৭৯ সালে তার নথিভুক্ত বিবরণ জানা যায়। ১৯৪৩ সালে জাপানের নাগাসাকিতে রোগটির ভয়ানক প্রাদুর্ভাব ঘটে এবং রেন কিমুরা ও শুসুমু হট্টা এর কারণ স্বরূপ ভাইরাসটি শনাক্ত করেন। ১৯০৬ সালে জানা যায় এই ভাইরাসের বাহক স্ত্রী এডিস ইজিপ্টি।
এর গায়ে ডোরাকাটা দাগ থাকে বলে তাকে টাইগার মস্কিটো বলে। চর্মের ওপর সমান্তরাল ভাবে বসে এবং দিনের বেলা কামড়ায়। পক্ষান্তরে ম্যালেরিয়ার বাহক স্ত্রী এনোফিলিস বিমান বিধ্বংসী কামানের মতো খাড়াভাবে বসে এবং রাতের অন্ধকারে রক্ত শুষে। মা মশা রক্ত শুষে পেটের ডিমগুলোকে পুষ্টি দিতে যাতে সুস্থ বাচ্চা জন্মে। এ রোগে প্রকাশকাল ৫-৬ দিন, ১০৪ ডিগ্রি পর্যন্ত জ্বর, পেশি ও জোড়ায় মারাত্মক ব্যথা হয় তাই এটাকে ব্রেক বোন ফিভারও বলে। শরীর ম্যাজ ম্যাজ, বমি, মাথা ও চোখের পিছনে ব্যথা, হাত পা, মুখ গহ্বর ও পরে দেহে লাল ফুটকি দেখা দেয়। ৩-৪ দিন পর জ্বর ছেড়ে গেলেও আবার আসতে পারে। রক্ত ক্ষরণমূলক ডেঙ্গিতে কৈশিক রক্ত নালিকা ফেটে নাক দিয়ে রক্ত পাত, রক্ত বমি, পেট ব্যথা, রক্ত-মল (৪৪ শতাংশ) ঘটে, রোগী মূর্ছা যায়।
অবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি করে তাকে শিরায় রক্ত, তরল পদার্থ ও পুষ্টি দিতে হবে। জ্বর ও ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল ছাড়া এনএসএআইডি দেয়া যাবে না। জীবন রক্ষায় কর্টিসোন দিতে হবে। জ্বরের ২ দিন পর আরটি-পিসিআর, এনএস ১, সিবিসি, এলিসা, আইজিএম/আইজিজি পরীক্ষা দ্বারা রোগ শনাক্ত করা যায়। রক্তে শে^ত কণিকা, অনুচক্রিকা, লসিকা কোষ হ্রাস এবং ক্রিয়েটিনিন ও এসজিওটি বৃদ্ধি পাবে। পরীক্ষাগুলো নেগেটিভ হলেও ডেঙ্গি হয়নি বলা যাবে না।
২০২৩ সালে পৃথিবীর ৮০ দেশে ৬.৫ মিলিয়ন লোক এ রোগে আক্রান্ত হয় এবং ৭৩০০ লোক মারা যায়। আমাদের তাই সাবধানতা হিসাবে খেয়াল রাখতে হবে ফুলের টব, পরিত্যক্ত পাত্র/ডাবের খোল, রাস্তা বা কোথাও যাতে পানি জমে মশক উৎপাদন না ঘটে। বাসায় লম্বা হাতা জামা ও পায়জামা পরা, হাতেপায়ে মশার তেল মাখা, রাতে মশারির নিচে শোয়া অভ্যাস করতে হবে। মশার কয়েল জ্বালানো নিষেধ কেননা রক্তের হিমোগ্লোবিন অক্সিজেনের পরিবর্তে কয়েল নির্গত কার্বন মনোক্সাইডের সঙ্গে ২১০ গুণ দ্রুত আকর্ষিত হয়ে মৃত্যু ঘটাতে পারে। এর পরিবর্তে মশা তাড়াবার বৈদ্যুতিক বাতি ব্যবহার বাঞ্ছনীয়।
লেখক : বেসরকারি চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যক্ষ ও অধ্যাপক
"