reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ১৭ আগস্ট, ২০২২

ফ্রোজেন শোল্ডার থেকে মুক্তির উপায়

কাঁধ বা শোল্ডার আমাদের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমাদের সব কাজের জন্য হাতের সাহায্য নিয়ে থাকি। হাত নড়াচড়ার সঙ্গে কাঁধের নড়াচড়া খুবই স্বাভাবিক। এজন্য কাঁধের কোনো সমস্যা বা ব্যথা হলে তা থেকে হাতের মুভমেন্ট বাধাগ্রস্ত হয়। আর গঠনগতভাবে কাঁধ ইনজুরি বা আঘাতের জন্য ঝুঁঁকিপূর্ণ। কাঁধে ব্যথা খুবই সাধারণ একটি বিষয়। আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান, প্রতি হাজার মানুষের মধ্যে ১৫ জন প্রতি বছর কাঁধে ব্যথার সমস্যায় ভুগে থাকে। এই ব্যাথা নিয়ে লিখেছেন ডা. মোহাম্মদ আহাদ হোসেন

কাঁধে ব্যথার কারণ কী?

যেকোনো রোগের কারণ ছাড়াও ব্যথার মূল তিনটি কারণ হচ্ছে মাংসপেশি বা লিগামেন্টস ইনজুরি, হাড় ভেঙে যাওয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং স্নায়ুতে চাপ বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া।

আঘাতজনিত ব্যথা কীভাবে হয়?

আঘাত পাওয়া যেকোনো ব্যথার অন্যতম কারণ। আঘাতের কারণে মাংসপেশি, লিগামেন্টসে বড় ধরনের বা ছোট ধরনের ইনজুরি হতে পারে। কাঁধ বা শোল্ডার জয়েন্টকে ঘিরে রাখে চারটি টেনডন বা লিগামেন্টস। এগুলোকে একত্রে বলে ‘রোটেটর কাফ’। আঘাতের কারণে এই রোটেটর কাফের যেকোনো লিগামেন্ট ইনজুরি হতে পারে। কাঁধে বা শোল্ডারে যে কারণে সাময়িক ব্যথা হতে পারে। ইনজুরি ঠিক হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় বা বিশ্রাম না দিলে বা নিয়মিতভাবে ব্যথার অঙ্গ দিয়ে কাজ চালিয়ে গেলে সেই ইনজুরি থেকে দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা বা ক্রনিক পেইন হতে পারে। আবার অত্যধিক ভারী জিনিস তুলতে গিয়ে বা জোরে হাত টানের কারণে শোল্ডার ডিসলোকেশন বা ছুটে যেতে পারে।

যেসব আঘাতের কারণে হতে পারে ইনজুরি

বাচ্চাদের জন্মের সময় শোল্ডারে ইনজুরিসহ হাড় ভেঙে যেতে পারে। ছোট বাচ্চাদের হাত ধরে ওঠানোর সময় জোরে টান লাগলে শোল্ডারে ইনজুরিসহ ডিসলোকেশন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাচ্চাদের কাঁধ ধরে ওঠাতে পারেন। অত্যধিক ভারী জিনিস তোলার কারণে মাংসপেশি ও লিগামেন্টস ইনজুরি হতে পারে। ব্যায়াম করার সময় অধিক চাপের কারণে মাংসপেশি বা লিগামেন্টস ইনজুরি হতে পারে। ক্রিকেট খেলায় যারা বেশি গতিতে বল করে, তাদের ইনজুরি হতে পারে।

ফ্রোজেন শোল্ডার

ফ্রোজেন শোল্ডার কাঁধের একটি সাধারণ সমস্যা। সাধারণত মাঝবয়সী থেকে অধিক বয়সীদের এটি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে কাঁধের জয়েন্টে প্রথম দিকে ভেতরের আবরণীতে প্রদাহ হয়ে ব্যথা অনুভূত হয়। এ কারণে হাত নড়াচড়া করা থেকে বিরত থাকেন আক্রান্ত ব্যক্তি। দীর্ঘদিন এ সমস্যা থাকলে কাঁধের জয়েন্ট শক্ত হয়ে যায়। তখন চাইলেও নাড়ানো যায় না। প্রচণ্ড ব্যথা হয়।

ফ্রোজেন শোল্ডারের ঝুঁকিতে কারা

বয়স ৪০ বা তার ঊর্ধ্ব বয়সীরা এ সমস্যার জন্য ঝুঁকিতে থাকেন। যেসব কারণে শোল্ডারের মুভমেন্ট কমে যায়, যেমন- রোটেটর কাফ ইনজুরি, হাত ভেঙে যাওয়া, স্ট্রোকের কারণে এবং অপারেশনজনিত কারণে দীর্ঘদিন শোল্ডারের মুভমেন্ট কমে যাওয়া। বিভিন্ন রোগের কারণে হতে পারে, যেমন- ডায়াবেটিস, থাইরয়েড গ্রন্থির রোগ, হার্টের রোগ, যক্ষ্মা ও পারকিনসন রোগ। যারা দীর্ঘদিন অস্টিওআর্থ্রাইটিস বা রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসে ভুগে থাকেন, তাদের ক্ষেত্রেও এ সমস্যা হতে পারে।

ফ্রোজেন শোল্ডার থেকে রক্ষার উপায়

একটু সতর্ক থাকলেই এ সমস্যা থেকে নিজেদের রক্ষা করে চলা যায়। আঘাতজনিত সমস্যা থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা। নিয়মিত শোল্ডারের ব্যায়াম শোল্ডার ভালো রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কাঁধ বা শোল্ডার যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ, তাই এটির কোনো সমস্যাকে হালকা করে না দেখা। দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া। নিজে নিজে শুধু ব্যথার ওষুধ খেয়ে চিকিৎসা না করা। এখন সমস্যা হচ্ছে যদি ফ্রোজেন শোল্ডার হয়ে যায়, তবে কী করার আছে? এ ক্ষেত্রে সমাধান হচ্ছে শোল্ডারকে মুভমেন্ট করানো, যেহেতু ব্যথা হয়। ব্যথা দূর করে নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে যারা ব্যথার চিকিৎসা করেন, তাদের পরামর্শ নিয়ে লোকাল ইনজেকশন নিয়ে ব্যথা কমিয়ে নিয়ে নিয়মিত এক্সারসাইজ করে এই ফ্রোজেন শোল্ডার থেকে রেহাই পেতে পারেন। নিয়মিত ফিজিওথেরাপি এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে।

বাইসেপস টেনডিনাইটিস

ফ্রোজেন শোল্ডারের সঙ্গে বাইসেপস টেনডিনাইটস সমস্যাটি সহসাই সংযুক্ত থাকে। আমাদের কাঁধে বা শোল্ডারে রোটেটর কাফের চারটি মাংসপেশির শেষের অংশ বা টেনডন ঘিরে রাখে। বাইসেপস টেনডন এদের মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি সামনের দিক থেকে শোল্ডারকে রক্ষা করে। কোনো কারণে এটি আঘাতপ্রাপ্ত হলে, যেমন- অত্যধিক ভারী কিছু ওপরে তোলা, বারবার মাথার ওপরের দিকে হাত জোরে জোরে ঘোরানো অথবা সরাসরি কোনো আঘাতে এতে প্রদাহ হয় ও ব্যথা হয়। সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এটি সমাধান না করলে এটি শোল্ডারের দীর্ঘমেয়াদি ব্যথার কারণ হতে পারে। বাইসেপস টেনডিনাইটিসের চিকিৎসাপদ্ধতি অন্যান্য ব্যথায় ব্যায়ামের কথা বলে থাকেন চিকিৎসকরা। কিন্তু বাইসেপস টেনডিনাইটিস হলে ব্যায়াম করা যাবে না। তাই এটি নির্ণয় করা জরুরি। যারা ব্যথার চিকিৎসা করেন, তারা দেখে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে পারেন। আবার প্রয়োজনে আলট্রাসাউন্ড করে নিশ্চিত হওয়া যায়। নিশ্চিত হওয়ার পর রোগীকে ব্যথামুক্ত ছোট্ট ইনজেকশনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয় এবং কিছুদিন বিশ্রাম নিতে হয়। যদি দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা হয় সে ক্ষেত্রে পিআরপি চিকিৎসা নিতে পারেন রোগী।

ফ্রোজেন ও বাইসেপস টেনডিনাইটিসের অত্যাধুনিক চিকিৎসা

ফ্রোজেন শোল্ডার ও বাইসেপস টেনডিনাইটিস সমস্যাটির প্রথম দিকে কিছু ব্যথার ওষুধ সেবন, ফিজিওথেরাপি ও প্রয়োজনীয় ব্যায়াম করলে এই সমস্যাটি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে যদি এই সমস্যাটি আমলে নেওয়া না হয় বা খেয়াল করা না হয় অথবা ব্যথা সহ্য করে চলতে চলতে কোনো এক সময় এই ব্যথা প্রচণ্ড আকার ধারণ করে। ফ্রোজেন শোল্ডার ও বাইসেপস টেনডিনাইটিস যদি তীব্র আকার ধারণ করে, তাহলে হাত নড়াচড়া একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। আক্রান্ত ব্যক্তি হাত পেছনে নিতে পারেন না, এমনকি স্বাভাবিক পোশাক পরিধানের সময়ও প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করেন। এ অবস্থায় অত্যাধুনিক একটি চিকিৎসাপদ্ধতি রয়েছে, যার মাধ্যমে এই ফ্রোজেন শোল্ডারের সমাধান করা সম্ভব। এই চিকিৎসাপদ্ধতিতে আমাদের বাহুর হাড় যে ক্যাপসুলের মধ্যে প্রোথিত থাকে, সেই ক্যাপসুলে কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধ ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয় এবং এই ইনজেকশনের পর ক্যাপসুলটি মোটা হয় ও জায়গা তৈরি করে। সে কারণে বাহুর হাড় এই ক্যাপসুলের মধ্যে আবার স্বাভাবিক নড়াচড়ায় ফিরে আসে। ইনজেকশনের মাধ্যমে ব্যথামুক্ত হয়। ইনজেকশন-পরবর্তী সময়ে রোগীকে ফিজিওথেরাপি ও ব্যায়ামের পরামর্শ দেওয়া হয়। এতে তার ফ্রোজেন শোল্ডারের পুরোপুরি উন্নতি হওয়া সম্ভব। উল্লেখ্য, পুরো প্রক্রিয়াটি অত্যাধুনিক আলট্রাসনোগ্রাম মেশিনের সাহায্যে করা হয় এবং ব্যথামুক্ত পদ্ধতিতে করা হয়।

কাঁধের ব্যথায় পিআরপি

পিআরপি হচ্ছে প্লাটিলেট রিচ প্লাজমা। পিআরপি চিকিৎসা ঘাড়ের ব্যথাসহ অন্যান্য ব্যথার চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এতে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। আমাদের শরীরের নিজস্ব উপাদান দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। এটি যাকে দেওয়া হবে তার শরীর থেকে ২০ সিসি রক্ত নিয়ে মেশিনে দিয়ে রক্ত থেকে প্লাজমা আলাদা করা হয়। এই প্লাজমায় প্লাটিলেটসহ অনেক গ্রোথ ফ্যাক্টর থাকে। এটি ইনজুরির জায়গায় দিলে সেখানে লোকাল গ্রোথ ফ্যাক্টর রিলিজ করে স্থায়ী ক্ষত পূরণে সাহায্য করে। এটি নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। ব্যথা নিরাময়ের স্থায়ী চিকিৎসায় এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

কখন ব্যায়াম করবেন না?

* ব্যায়ামের সময় হাতে বা কাঁধে ব্যথা হলে।

* ফ্রোজেন শোল্ডার অনুভব করলে।

* হঠাৎ আঘাত পেলে।

লেখক : চিফ কনসালট্যান্ট ও ব্যথা বিশেষজ্ঞ

বাংলাদেশ সেন্টার ফর রিহ্যাবিলিটেশন, ঢাকা

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close